অদ্ভুত কিছু পাখির কথা

বিশ্বে পাখির অন্তত হাজার দশেক প্রজাতি আছে। এদের কেউ আকাশে বেশিরভাগ সময়টা কাটায়, কেউ বা মাটিতে চড়ে বেড়ায়। কেউ জলচর তো কেউ পরিযায়ী, কেউ পতঙ্গভোজী তো কেউ ফলভোজী বা মাংসখেকো। সব মিলিয়ে পাখিদের বৈচিত্র্য ব্যাপক। এমনই কিছু বৈচিত্র্যময় কিছু পাখি নিয়ে আজকের আলোচনা। 

দাড়িওয়ালা শকুন

দাড়িওয়ালা শকুনের কাছে পর্বত খুবই পছন্দের জায়গা। ভারতের হিমালয় থেকে আফগানিস্তান, দক্ষিণ ইউরোপের আল্পস থেকে ককেশাস হয়ে জাগরোস পর্বতমালা, আরব ভূমি, ইথিওপিয়ার পার্বত্য অঞ্চল এবং উত্তর আফ্রিকার আটলাস পর্বতমালা; দেড়েল শকুন দেখতে হলে এদের যেকোনো একটিতে গেলেই হবে। হিমালয়ে ২৪ হাজার ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় এদেরকে উড়তে দেখা গেছে।

হাড়খেকো শকুন; Source: media.wired.com

এরা আর দশটা শকুনের মতোই মৃত পশুর সন্ধানে উড়ে বেড়ায়। তবে মাংস এদের মূখ্য খাবার নয়। অন্য প্রাণীরা যখন মৃত পশুর মাংস খেয়ে শেষ করে ফেলে, তখন এরা জুড়ে বসে। হাড়গোড় এদের প্রধান খাদ্য। অন্যান্য পশুপাখি বা কচ্ছপও খুব পছন্দ। শক্ত হাড় বা কচ্ছপের খোলস ভাঙ্গবার জন্য এরা প্রথমে অনেক ওপরে উড়ে যায়, তারপরে সেখান থেকে হাড় বা খাদ্যবস্তুটা ফেলে দেয়। পাথরে পড়ে হাড় বা খোলস ফেটে গেলে তখন এরা নেমে আসে। ছোটখাট পাখি বা পশুও এরা খায়। আকারে এরা বিরাট, প্রায় ৪ ফুট লম্বা, দুই ডানা মেলে ধরলে মোট বিস্তৃতি দাঁড়ায় নয় ফুটেরও বেশি। বিরাট ডানার প্রবল ঝাপটায় শিকারকে হত্যা করে অনেক সময়। 

এরা প্রায় বিপন্ন পাখি। প্রাচীন পারস্যের হুমা পাখির ধারণা মূলত এই দেড়েল শকুনদের ওপরে ভিত্তি করেই এসেছে। গ্রীক পুরাণে এবং বাইবেলেও এদের উল্লেখ দেখা যায়।

হোয়াটজিন

হোয়াটজিন দেখতে পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাংশের গহীন জঙ্গলে। ওরিনকো আর আমাজন নদীর তীরবর্তী ঘন জঙ্গলে বাস করে এরা। ফুটখানেক লম্বা মুরগী সাইজের পাখিগুলো ভালো উড়তে পারে না। তবে সাতারেঁ পটু। প্রধান খাদ্য গাছের পাতা, তবে ফলফুলও খেয়ে থাকে।

হোয়াটজিন; Source: tambopatalodge.com

পাখাগুলো দেখতে মন্দ নয়। তবে হোয়াটজিনের বিশেষ পরিচিতি হয়েছে তাদের গায়ের জঘণ্য গন্ধের জন্য। সেটা নাকি হুবহু গরুর গোবরের মতো। এদের হজম প্রক্রিয়াও গরুর মতো। গায়ের ভয়ানক গন্ধের জন্যেই বোধহয়, হোয়াটজিন শিকারের ব্যাপারে মানুষের তেমন আগ্রহ নেই।

এদের বাচ্চাদের একটা দারুণ বৈশিষ্ট্য আছে। প্রাগৈতিহাসিক পাখিদের মতো এদের ডানার সামনে দুটি ছোট্ট থাবা থাকে, এই দিয়ে তারা গাছ বেয়ে খুব দ্রুত ওঠানামা করতে পারে। 

কাকাপো

কাকাপো পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী টিয়া পাখি। থাকে নিউজিল্যান্ডে। কাকাপো আর দশটা টিয়ার মতো না। এরা ফুট দুয়েক লম্বা, ওজন চার কেজির মতো এবং নিশাচর। ফলভোজী এই পাখির ওড়বার প্রয়োজন হয় না। ওড়বার ক্ষমতা নেইও তাদের। গাছে চড়তে পারদর্শী। প্রয়োজনে গাছের ডগা থেকে লাফ দিয়ে ডানায় ভেসে বেশ কিছুদূর গ্লাইড করে নামবার ক্ষমতা রাখে। নিরীহদর্শন এই পাখিটি বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।

কাকাপো; Source: Theo Thompson

এককালে গোটা নিউজিল্যান্ড জুড়েই কাকাপো দেখা যেত। কিন্তু অভিবাসীদের সাথে আসা কুকুর, বিড়াল এবং ধেড়ে ইদুঁরের আক্রমণে এরা প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে শ’ দেড়েক কাকাপো বেচেঁ আছে।

এরা বহুদিন বাঁচে। নব্বই বছর পর্যন্ত বাঁচবার রেকর্ডও আছে। নিউজিল্যান্ডের রিমু গাছে ফল এলেই কেবল এরা ডিম পাড়ে। রিমু গাছে ফল সাধারণত তিন বছরে একবার ধরে। ফলে কাকাপোরাও কয়েক বছর পর পর ডিম পাড়ে। ধীর জন্মহারের কারণে কাকাপোর সংখ্যা খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে।

গ্রেটার হানিগাইড

২০ সেন্টিমিটারের এই পাখিটা দেখতে অত্যন্ত সাদামাটা। তবে এর একটি বিশেষ গুণ আছে। এর মূখ্য খাবার হচ্ছে মধু, মোম এবং মৌমাছির লার্ভা। মৌমাছি তাড়িয়ে এ খাবার করায়ত্ত করবার সাধ্য এদের নেই। তাই তারা অপেক্ষা করে কখন আশপাশ দিয়ে মানুষ যাবে। মানুষ গেলেই এরা ডাকাডাকি করে তাদেরকে মৌচাকের কাছে নিয়ে আনবার চেষ্টা চালায়। মধু যারা সংগ্রহ করে, তারা জঙ্গলে ঢুকেই হানিগাইডের বিশেষ ডাকের জন্য অপেক্ষা করে।

হানিগাইড; Source: Pinterest

পূর্ব আফ্রিকার বোরান জাতের লোকেরা হানিগাইডের সাহায্যে মধু সংগ্রহ করেন। মধু নেওয়া হয়ে গেলে তারা চাকের একটা বড় অংশ পাখিটির জন্য বাইরে বের করে রাখেন। লোকজ বিশ্বাস, কেউ যদি হানি গাইডকে তার যথাযথ প্রাপ্য বুঝিয়ে না দেয়, তাহলে হানিগাইড পরবর্তীতে তাদেরকে সিংহ, বিষাক্ত সাপ কিংবা খ্যাপা হাতির সামনে ভুলিয়ে নিয়ে যাবে। উপকারী এই পাখিটি অবশ্য মধু সংগ্রহের জন্য বেবুন বা অনুরুপ মধুলোভী প্রাণীর সাহায্যও নিয়ে থাকে।  

ব্লু টিট

ল্যাভেন্ডার বা অ্যাপল মিন্টের মতো সুগন্ধী গাছ সাধারণত কোনো স্থানের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য খুবই উপযুক্ত। বিস্তর গবেষণা করে মানুষ এই তথ্য জেনেছে। হাজার বছরের অভিজ্ঞতায় শিখেছে আরেকটি পাখি- ব্লু টিট। পশ্চিম এশিয়া আর ইউরোপ জুড়ে প্রায় সবখানেই ১২ সেন্টিমিটারের এই ছোট্ট পাখিটি দেখা যায়।

ব্লু টিটের বাসা। সবুজ অংশগুলি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঠেকাবার জন্য আনা হয়েছে; Source: dreamstime.com

এই পাখির বাসায় প্রচুর পোকামাকড় বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ দেখা যায়। তাই পাখিগুলো ল্যাভেন্ডার বা মিন্টের মতো সুগন্ধী গাছের পাতা কুড়িয়ে নিয়ে এসে বাসায় মজুত করে। ফলে পাখির বাচ্চার স্বাস্থ্য ভাল থাকে, বাসাও থাকে ব্যাকটেরিয়ামুক্ত।

ক্যাসোয়ারি

উদ্ভট পাখিদের কথা উঠলে ক্যাসোয়ারিকে তালিকায় রাখতেই হবে। ফুট ছয়েক উচুঁ, পঞ্চাশ কেজির বেশি ওজন নিয়ে ক্যাসোয়ারি নিউ গিনির গহীন অরণ্যে চড়ে বেড়ায়। অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ার উষ্ণমণ্ডলীয় জঙ্গলেও এদের এখা যায়। ক্যাসোয়ারি মূলত ফল, পাতা খেলেও সুযোগ পেলে ছোটখাট প্রাণী শিকার করতে দ্বিধা করে না। একেকটা ক্যাসোয়ারি প্রায় বছর চল্লিশেক বা তারও বেশি দিন বাঁচে। এরা উড়তে পারে না। 

ক্যাসোয়ারি; Source: Daintree Safaris

এদের পায়ের জোর অত্যন্ত বেশি। এদের আঙ্গুলে ধারালো নখর থাকে যা দিয়ে তারা মানুষের পেট ফুড়েঁ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এদের জোরালো লাথি খেয়ে ঐসব অঞ্চলের অনেক আদিবাসী মারা পড়েছে বলেও শোনা যায়। যদিও মানুষের ওপরে হামলার ঘটনা অত্যন্ত বিরল।

ক্যাসোয়ারির তিনটি প্রজাতি আছে। অরণ্যঘেরা দুর্গম অঞ্চলে বাস করে বলেই হয়তো বা সব কটি প্রজাতি প্রচুর পরিমাণে টিকে আছে।  

অয়েলবার্ড

অয়েলবার্ড এর দেখা মেলে গোটা দক্ষিণ আমেরিকা আর ক্যারিবীয় অঞ্চলে। পাখিগুলো নিশাচর, এরা গুহায় বাস করে এবং ফলভোজী। বাদুড়ের মতোই এরাও রাতের বেলা খাবারের সন্ধানে বের হয় এবং শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে উড়ে বেড়ায়। এছাড়া এরা অন্ধকারে বেশ দেখতেও পায়। গুহা বা পাহাড়ের গায়ে বড় বড় দল পাকিয়ে থাকে এরা।

অয়েলবার্ড; Source: hbw.com

অয়েলবার্ডদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে অয়েল পামগাছের ফল। আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের কাছে এই পাখিগুলো পরম আরাধ্য। আদিবাসীরা বাচ্চা অয়েলবার্ড থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এক ধরনের তেল বের করে নেয়। গন্ধহীন এই তেল রান্নাবান্না আর আলো জ্বালাবার কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বন জঙ্গল শেষ করে ফেলবার কারণে অনেক স্থানেই অয়েলবার্ডের সংখ্যা কমছে।

ফিচার ইমেজ – Wikimedia Commons

Related Articles

Exit mobile version