এ পৃথিবী বড়ই রহস্যময়। পাহাড়, সাগর,পাতাল, অন্তঃরীক্ষ- কোথায় নেই প্রকৃতির এই রহস্যময়তা। রহস্য আর বৈচিত্রময়তায় ঘেরা এই পৃথিবীর সবটুকু কি এখনও জানা সম্ভব হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই ‘না’। আজকে মাটির নীচে থাকা তেমনি এক অজানা রহস্যের গল্প শোনাবো।
পৃথিবী যেমন বিচিত্র, তেমনি বিচিত্র এই গ্রহে বসবাসকারী মানুষরাও। নানা হাজারো বৈচিত্রময় কাজের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকে প্রতিনিয়ত বৈচিত্রময় করে তুলছে। বাঁচার তাগিদে ভয়ঙ্কর জীবজন্তু থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য প্রথম মানুষ গুহায় বাস করতে শুরু করে। কিন্তু মানুষ যখন একটু একটু করে সভ্য হয়ে উঠলো, তখন পরিবর্তন হতে থাকলো এই অবস্থার। সে গুহা থেকে বের হয়ে এসে নিজের প্রয়োজনমতো আবাসস্থল গড়ে তুলতে লাগলো সে। এই আবাসভূমি সে গড়ে তুলতে লাগলো মাটির উপরিভাগেই।
কিন্তু মানুষ বরাবরই অনুসন্ধিৎসুপরায়ণ এবং নব আবিষ্কারে বিশ্বাসে। আর তাই কিছু কিছু মানুষ এর ব্যতিক্রম ঘটাতে লাগলো। তারা তাদের আবাসস্থল গড়ে তুলতে লাগলো মাটির নিচে। অস্ট্রেলিয়াতেই রয়েছে এমন একটি শহর যেখানে গোটা শহরটি গড়ে উঠেছে মাটির নিচে। এই শতাব্দী প্রাচীন মাটির নিচের শহরটির নাম কুবার প্যাডি। শহরটিতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজারের অধিক মানুষের বসবাস। এই শহরের সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো শহরটিতে সবুজের কোনো অস্তিত্ব নেই, নেই কোনো গাছপালা, শুধু আছে তৈলাক্ত বালি।
তবে মাটির নিচের এই শহরটি আপনাআপনি গড়ে উঠেনি। এই শহরটির বিশেষত্ব প্রথম আবিষ্কার করেন জিম হাচিসন ও তার চৌদ্দ বছরের ছেলে উইল হাচিসন। তাহলে এই শহরের গোড়াপত্তন কিভাবে হলো? কিভাবে শহরের বিন্যাস ঘটলো? কিভাবে আধুনিক এক শহরে পরিণত হলো? সেই না জানা কাহিনীই আজ জানাবো আপনাদের।
বিস্ময়ভরা কুবার প্যাডি অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড থেকে ৮৪৬ কিলোমিটার উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের মরুভূমিতে অবস্থিত ছোট একটি শহর। ১৯১৫ সালে এই শহরের গোড়াপত্তন হয়। জিম হাচিসন ও তার চৌদ্দ বছরের ছেলে উইল হাচিসন মরু এলাকার উষর ভূমিতে সোনা খুঁজতে বের হয়েছিলেন। সোনা না পেলেও এই পিতা-পুত্র যা পেয়েছিলেন তা কোনো অংশেই ফেলনা ছিল না। অলংকারের জন্য ঝলমলে এক পাথরের খোঁজ পান তাঁরা। পরবর্তীকালে ওই পাথর জনপ্রিয় হয় সারা বিশ্বব্যাপী। তবে অভিযানের সময় এই বাবা-ছেলে ভিন্ন ধরনের এক সমস্যার মুখোমুখি হন। পরবর্তীতে এই সমস্যার মুখোমুখি হয় আরো অনেকে।
শহরের চারদিকে বিস্তীর্ণ মরুভূমি। আর এই মরুভূমিতে প্রতিনিয়ত চলতো ধূলিঝড়ের উৎপাত। এখানে দিনের বেলায় তাপমাত্রা হতো ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি, আর রাতের বেলায় পড়তো প্রচন্ড শীত। এ কারণে এটি ছিল মানুষের একেবারেই বসবাসের অনুপযুক্ত। ১৯১১ সালের পূর্বে এই এলাকায় কেউ বাস করতে সাহস করতো না। তখন বাসিন্দা বলতে ছিল মরুভূমির সাপ, বিষাক্ত পোকামাকড়, টিকটিকি আর এমু পাখি।
কিন্তু মরুভূমিতে পিতা-পুত্রের পাওয়া ওপাল নামক সেই রত্ন মরুভূমিটিকে অন্য সব মরুভূমি থেকে আলাদা মাত্রা দিয়েছিল। ওপাল হচ্ছে একধরনের খনিজ পদার্থ যা মাটির সঙ্গে মিশে থাকে। তা থেকেই তৈরি হতো ওপাল নামক রত্ন। ১৯১৬ সালের দিকে “ওপাল” নামের এই খনিজ পদার্থের খনির সন্ধান পাওয়া যায়। মরুভূমির এক বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল এই রত্নের খনি। বিশ্বের রত্নের বাজারে প্রায় ৮০ শতাংশ ওপালই আসে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এই কুবার প্যাডি এলাকা থেকে। আর সে কারণেই কুবার প্যাডি পৃথিবীর ওপাল রাজধানী নামেও ব্যাপক পরিচিত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রেলিয়ান সৈনিকরা যখন দেশে ফিরে আসলো, তখন তাদের এই মরুভূমির খনিতে লুকিয়ে থাকা রত্নের উপর চোখ পড়লো। এই ওপাল সংগ্রহের জন্য স্থানটিতে তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে আনতে লাগলো। প্রতিদিন ওপাল সংগ্রহের জন্য কুবার প্যাডিতে অনেক শ্রমিক আসতো।
লোকালয় থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ার কারণে প্রতিদিন এখানে এসে কাজ করা শ্রমিকদের পক্ষে প্রায় অসম্ভবই ছিল। তাছাড়া দিনের বেলা প্রচন্ড উত্তাপ আর রাতে কনকনে বরফ শীতল ঠান্ডা। বৃষ্টিপাত তেমন হয় না বললেই চলে। ছিল যখন তখন ধুলিঝড়। এলোমেলো আবহাওয়া আর ধুলিঝড়ের কারণে মরুভূমিতে বাস করা শ্রমিকদের পক্ষে একেবারের সম্ভব ছিল না।
প্রচন্ড দাবদাহ আর শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শ্রমিকরা মাটির নিচে ঘর বানানো শুরু করে। একজনের দেখাদেখি আরেকজন। এভাবে দেখতে দেখতে মাটির নিচে গড়ে ওঠে পুরো একটি শহর।
প্রথম দিকে অনেকরকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। বিদ্যুৎ, পানি ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা ছিল না বললেই চলে। ধীরে ধীরে সময়ের ব্যবধানে সেসব আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থাও হতে থাকে। আর এভাবে কালের পক্রিমায় গড়ে ওঠে উন্নত একটি শহর।
প্রথমে গড়ে উঠলো বাজার, তারপর মার্কেট, বিপনী কেন্দ্র, গির্জা, বইয়ের দোকান, বিনোদন কেন্দ্র, ব্যাংক সহ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সবকিছুই গড়ে উঠতে থাকে। এসব নিত্যনৈমিত্তিক প্রায় সবকিছুই মাটির নিচের স্থাপন করা হয়েছে।
এখন দেখা যায় মরুভূমির মাঝে মাঝে গর্ত। আর সেই গর্ত ধরে নিচে নেমে গেলেই চোখে পড়বে ঝাঁ চকচকে আধুনিক এক শহর। কি নেই সে শহরে! তবে ‘কুবার প্যাডি’ এখন আর শুধু খনি শ্রমিকদের শহর নয়। বিভিন্ন শহর থেকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে অথবা চাকরির উদ্দেশ্যে অনেকেই এই শহরে এসে বসতি স্থাপন করেছে।
বর্তমানে পর্যটন স্থান হিসেবে এটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। আবাসিক হোটেল, রেস্তোরা, একাধিক চার্চ নিয়ে পর্যটনের যাবতীয় পসরা পর্যটকদের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে ভূ-গর্ভস্থ এই শহরে। বর্তমানে এখানে সত্তরের ওপর ওপাল খনি রয়েছে।
বাইরে থেকে শহরটি দেখলে অনেকেই চমকে যাবেন। চারদিক জনমানবহীন। মাঝে মধ্যে দুই একটি স্থানে দেখা যাচ্ছে গুহা। সেই গুহাগুলো থেকে নেমে গেছে সুড়ঙ্গের মতো সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি চলে গেছে অনেক গভীরে। সিঁড়ি ধরে নীচে নামলেই আসল চমক।
আদিম যুগের কোনো রূপকথার চরিত্র নয়, এখানে রয়েছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বাসস্থান। রয়েছে উচ্চপ্রযুক্তির সরঞ্জাম, দামি হোটেল, সুইমিং পুল। মোটকথা একটি শহরে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকে প্রায় সবধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে শহরটিতে। কিন্তু এসব কিছুই করা হয়েছে মাটির নিচে।
প্রতি বছর দেশ-বিদেশের বিপুল সংখ্যক পর্যটক এই স্থানটি পরিদর্শন করতে আসেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা সম্পূর্ণ মাটির নিচে থাকা শহর কুবার প্যাডি আর তার আশেপাশের মরুভূমি দেখতে আসেন।নানা নাগরিক সুবিধা সংবলিত শহরটি চাইলে একবার দেখে আসলে মন্দ হয় না! কী বলেন?
তথ্যসূত্র
১) en.wikipedia.org/wiki/Coober_Pedy
২) metro.co.uk/2015/05/28/theres-a-whole-town-in-australia-that-lives-underground-5219091/
৩) smithsonianmag.com/travel/unearthing-coober-pedy-australias-hidden-city-180958162/
৪) cooberpedy.sa.gov.au/page.aspx?u=368