রাজধানী ঢাকার মধ্যে প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের তালিকায় তারা মসজিদ অন্যতম। দর্শনার্থীদের কাছে এটি বেশ পরিচিত একটি স্থান। পুরান ঢাকার মহল্লা আলে আবু সাইয়েদ (বর্তমান নাম আরমানিটোলা) এলাকার ১১ আবুল খয়রাত সড়কে এই মসজিদটির অবস্থান। এর নির্মাতা ও নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, তৎকালীন ঢাকার সম্ভ্রান্ত জমিদার মির্জা গোলাম পীর আঠারো শতকের প্রথমাংশে মসজিদটি নির্মাণ করেন।
সতের শতকে দিল্লি, লাহোর ও আগ্রায় নির্মিত মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এর নাম তারা হলেও কেউ বলেন সিতারা মসজিদ আবার কেউ কেউ বলে গোলাম পীরের মসজিদ। তারা মসজিদ, সিতারা মসজিদ ও গোলাম পীরের মসজিদ- তিনটি নামই বেশ পরিচিত মসজিদটি। নির্মাণকালে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ছিল ৩৩ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ১২ ফুট।
মসজিদটিকে বেশ কয়েকবার সংস্করণ করা হয়েছে। প্রথমাবস্থা থেকেই এর আকৃতি ছিল আয়তাকার। মসজিদের উপরিভাগে বৃত্তাকার তিনটি গম্বুজ রয়েছে, সেই সাথে গম্বুজে খোদাই করা হয়েছে নীল রঙের অসংখ্য তারার মোটিফ। এই আকর্ষণীয় নকশার কারণেই মূলত এটি তারা মসজিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মসজিদের পূর্ব দিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে মোট পাঁচটি প্রবেশ পথ রয়েছে যা বহু খাজ বিশিষ্ট ও চারটি অষ্টভুজ আকৃতির খুঁটি থেকে উদ্ধৃত। মসজিদের মুখ্য প্রবেশপথের সম্মুখে রয়েছে বিশাল আকৃতির প্রস্রবণ বিশিষ্ট একটি তারা।
১৯২৬ সালে ঢাকার স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী জান বেপারী মসজিদের পূর্বদিকে সংস্কার করে বারান্দা তৈরি করেন। মসজিদের ভেতরে ও বাইরে জাপানের চিনি টিকরির কৌশলে এবং চীনা মাটির কাঁচ ও টুকরা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মোজাইক। ১৯৮৭ সালে শেষবারের মতো মসজিদটিকে আবার সংস্কার করা হয়। সেই সাথে মসজিদের আদি মেহরাবটি ভেঙে নতুন করে তিনটি মেহরাব তৈরি করা হয়। এ সময় মসজিদের উপরে আরো দুইটি গম্বুজ যুক্ত করা হয়। বর্তমানে মসজিদের সর্বমোট গম্বুজ সংখ্যা পাঁচটি এবং মসজিদের দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট ও প্রস্থ ২৬ ফুট। দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের দেয়ালে রয়েছে ফুলদানি, চাঁদ, তারা ও আরবি লিপির নান্দনিক নকশা।
১৯৮৫ সালের ৮ই মার্চ পুরনো এই মসজিদের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যকরণ কাজের শুভ উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৮৭ সালের ৪ ডিসেম্বর মসজিদটিকে রাষ্ট্রীয়করণ নির্দেশনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৬ সালে ১০ ডিসেম্বর ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ আয়োজিত অনুষ্ঠান খাদি ফ্যাশন শো-তে তারা মসজিদের নান্দনিক ডিজাইনকে ফুটিয়ে তোলা হয়।
আরমানিটোলা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের দ্বারা গঠিত কমিটি বর্তমানে এই মসজিদটিকে পরিচালনা করছেন। মসজিদের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। বাংলাদেশ সরকার মসজিদের বাৎসরিক যাবতীয় খরচ বাবদ তিন লক্ষ টাকা প্রদান করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রিত কাগজের বর্তমান একশো টাকার গায়েও তারা মসজিদকে তুলে ধরা হয়েছে।
কীভাবে যাবেন
রাজধানী ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে সর্বপ্রথম পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় আসতে হবে। সেখান থেকে রিকশায় করে খুব সহজেই যাওয়া যাবে আরমানিটোলায় অবস্থিত তারা মসজিদে। চানখাঁরপুল থেকে রিকশায় তারা মসজিদে যাওয়ার জন্য গুনতে হবে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা। এছাড়াও গুলিস্তান ও বাবুবাজার ব্রিজে বিদ্যমান সিএনজি কিংবা রিকশা করে যাওয়া যাবে তারা মসজিদে।
খাবেন কোথায়
পুরান ঢাকার খাবারের ঐতিহ্য বেশ পুরনো। এখানে খাবারের মান বেশ উন্নত এবং হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলো বেশ ভালোভাবেই খাবার পরিবেশন করে থাকে। খাবারের স্বাদও বেশ। মুখরোচক খাবারের মধ্যে আছে তারা মসজিদের পাশে অবস্থিত জুম্মন মামার চটপটি এবং চানখাঁরপুল এলাকার বাকড়খানি, মাঠা ও মামুন হোটেলের স্পেশাল কাচ্চি। তাছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু বিখ্যাত খাবারের দোকান। হাজি বিরিয়ানি, নান্না বিরিয়ানি, বিউটি বোর্ডিং, সুলতানের চা, ঝুনু পোলাও ঘর, কাশ্মীর কাচ্চি ইত্যাদি। যে কোনো একটাতে বসে অনায়াসে খাবার কার্য সেরে নিতে পারেন। খাবার অর্ডার করার আগে খাবারের দাম জিজ্ঞেস করে জেনে নেওয়া সবসময় উত্তম।
নিকটস্থ কিছু দর্শনীয় স্থান
খাবারের পাশাপাশি দর্শনীয় স্থান ও প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের জন্যেও পুরান ঢাকার বেশ সুনাম আছে। তারই প্রেক্ষিতে, সদরঘাট এলাকার ইসলামপুরে অবস্থিত ঢাকার অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন আহসান মঞ্জিল, শাহবাগে রয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, কার্জন হল, শিশু পার্ক, রমনা পার্ক, চারুকলা ইনস্টিটিউট ও জাতীয় জাদুঘর। আর পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকায় অবস্থিত মুঘল আমলের বাংলাদেশের একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন লালবাগ কেল্লা।