Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কম এল শকাফা: মধ্যযুগীয় সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম একটি নিদর্শন

১৯০০ সালের কোনো এক দুপুর, স্থান মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া। দুপুরের রোদে পিঠে পাথরের বোঝা নিয়ে হেলে দুলে চলছিল একটি গাধা। হঠাৎ গাধাটি একটি স্থানের উপর দিয়ে হেটে যেতেই ওই স্থানটি ধ্বসে গিয়ে গাধাটি মাটির নিচের এক গর্তে পড়ে যায়। আর ঠিক সেই সাথেই আবিষ্কৃত হয় মধ্যযুগের ৭টি আশ্চর্যজনক নির্দশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নিদর্শন ‘কম এল শকাফা’, মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এক মৃতের নগরী

প্রচলিত এই গাধার গল্পটি সত্য নাকি মিথ্যা সেটি বড় কথা নয়। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো গাধাটি যে গর্তে পড়ে গিয়েছিল সেই গর্তে আসলে কী ছিল। ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, আস সাঈদ আলী গিবারাহ নামে এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম ১৯০০ সালে স্থানীয় জাদুঘরে উক্ত স্থানটি সম্পর্কে অবহিত করেন। জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে তিনি জানান, উক্ত স্থান থেকে পাথর খননের সময় তিনি মাটির নিচে একটি সমাধির খোঁজ পেয়েছেন। জাদুঘরের তৎকালীন কর্মকর্তা প্রথম দিকে তার কথা বিশ্বাস না করলেও তার দুই কর্মচারীকে তিনি পাঠান স্থানটি দেখতে। এরপর তাদের অনুসন্ধানে খোঁজ মেলে মাটির নিচের চমৎকার এই সমাধিস্থলটির।

কম এল শকাফার প্রবেশপথ; Source: Roland Unger CC BY-SA 3.0

প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, কম এল শকাফার এই মাটির নিচের সমাধিস্থানটি হলো গ্রেকো-রোমান সময়কালীন সবচেয়ে বড় সমাধিস্থান। আর আলেকজান্দ্রিয়ার মতো প্রাচীন ও সমৃদ্ধ এক শহরে আবিষ্কৃত হওয়া মাটির নিচের এই সমাধিস্থানটিতে কয়েক শতাব্দী ধরে যা লুকিয়ে ছিল, তা বিভিন্ন প্রাচীন শিল্প ও সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ হবে এটাই স্বাভাবিক।

সমাধিকক্ষের ভিতরের দেয়ালে খোদাইকৃত চিত্র; Source: tripvisor.com

আলেকজান্দ্রিয়া শহরটির নামকরণ করা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত যোদ্ধা ও বিজয়ী আলেকজান্ডার দি গ্রেটের নাম অনুসারে। ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্ডার দি গ্রেট এই স্থানটি জয় করেন এবং আলেকজান্দ্রিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠিত এই শহরটি ছিল তৎকালীন শক্তি, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের এক কেন্দ্রবিন্দু। এখানেই সর্বপ্রথম গ্রিক শাসকরা গ্রিক ও মিসরীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটান। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৩১ অব্দের দিকে রোমানরা এই শহরের ক্ষমতা লাভ করে এবং ধীরে ধীরে আলেকজান্দ্রিয়ায় রোমান সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। ফলে এই তিন জাতির সংস্কৃতির এক অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটে আলেকজান্দ্রিয়ায়। সেসময় মিশরের রাজধানী ছিল এই আলেকজান্দ্রিয়া। নানা সংস্কৃতির এই মিশ্রণের ফলে অনেকে আলেকজান্দ্রিয়াকে ‘অনাদিকালের প্যারিস’ নামেও আখ্যা দিয়ে থাকেন।

সমাধিকক্ষে প্রবেশের করিডর; Source: wikimedia.org

তবে আলেকজান্দ্রিয়ার এই এল কম শকাফা ভূগর্ভস্থ সমাধিস্থানটির ব্যবহার শুরু হয় দ্বিতীয় শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে এবং পরবর্তী ২০০ বছর ধরে এটি ব্যবহৃত হয়েছিল। মিশরীয়, গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির সংমিশ্রণযুক্ত এমন চমৎকার সমাধিক্ষেত্র আর খুব বেশি দেখা যায় না। তাই প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এটি। এই স্থানটির নাম ‘কম এল শকাফা’ এসেছে প্রাচীন গ্রিক ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘ভাঙ্গা টুকরার স্তুপ’। প্রাচীনকালে এই স্থানটি ভাঙ্গাচোরা মাটির পাত্রে পরিপূর্ণ ছিল। এসব মাটির পাত্র সাধারণত মদ পানে ও বিভিন্ন খাবার খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো। মৃতের আত্মীয়রা যারা এই সমাধিস্থান দেখতে আসতো তারাই সেসব পাত্র এখানে ফেলে যেত। যার ফলে পরিত্যক্ত এসব ভাঙ্গা মাটির পাত্রের স্তুপে পরিণত হয়েছিল এই স্থানটি।

মৃতদেহ সংরক্ষণের কুঠুরি; Source: wikimedia.org

বিভিন্ন গবেষকের মতে, এই স্থানটি প্রথমে শুধু একটি নির্দিষ্ট পরিবারের পারিবারিক সমাধিস্থান হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। কিন্তু পরে কোনো এক অজানা কারণে এটিকে আরো বড় আকারের করা হয় ও অন্যদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তবে এই কম এল শকাফাই কিন্তু আলেকজান্দ্রিয়ার একমাত্র সমাধিস্থান নয়। বরং এটি ছিল ‘মৃতের নগরী’ নামে পরিচিত বিশাল এক নেক্রোপলিসের একটি অংশ। এই নেক্রোপলিস বা মৃতের নগরীটি ছিল শহরের পশ্চিম দিকে, যা এক সময় কোনো কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। শুধু টিকে থাকে মাটির নিচের এই কম এল শকাফা।

সমাধিকক্ষের দেয়ালচিত্র; Source: gettimages.com

এখন চলুন দেখি কেমন ছিল এই সমাধিস্থানটি। কম এল শকাফার ভূমির ঠিক উপরেই ছিল এক বিশাল সমাধিস্তম্ভ। তবে এখন সেখানে শুধু ১৮ ফুট চওড়া গোলাকার একটি কাঠামো রয়েছে, যা সরাসরি মাটির নিচে চলে গেছে। এই কাঠামোটি সম্ভবত মৃতদেহ ভূগর্ভে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো। এই কাঠামোটিতে রয়েছে কিছু জানালা, যার মাধ্যমে বাইরের আলো মাটির নিচে যাওয়ার প্যাঁচানো সিঁড়িতে পড়তো। এটি ছাড়া এই সমাধিস্থানের উপরের স্থানে তেমন কিছুই নেই। তবে এটিই এই সমাধিস্থানের মূল অংশ মাটির নিচের সেই সমাধিকক্ষগুলোতে প্রবেশের একমাত্র পথ। এই সমাধিকক্ষগুলো এই স্থানের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। এটি আসলে গ্রিক মন্দিরের আদলে তৈরি। এখানেই রয়েছে এই সমাধিস্থানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো।

হুট করেই আবিষ্কৃত হয় এই স্থানটি; Source: pinterest.com

যে সিঁড়ি দিয়ে সমাধিকক্ষগুলোর এই স্থানে পৌঁছানো যায় সেটি যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখানেই দুটি স্তম্ভের মাঝে রয়েছে মন্দিরে প্রবেশের প্রথম ঘর। এই ঘরটির পেছনে রয়েছে একটি কক্ষ। আর এই কক্ষটিতে রয়েছে এই স্থানের অন্যতম চমৎকার একটি শিল্পকর্ম, পুরুষ ও নারীর বিজড়িত একটি মূর্তি। ধারণা করা হয় এটি এই সমাধিস্থানের সেই প্রথম পরিবারের দুজন সদস্যের মূর্তি। মজার ব্যাপার হলো, মূর্তিটি মিসরীয় ধাঁচে তৈরি হলেও পুরুষটির মাথা তৈরি করা হয়েছে গ্রিক ধাঁচে। একইভাবে নারী মূর্তিটির মাথা তৈরি করা হয়েছে রোমান ধাঁচে। অর্থাৎ একটি ভাস্কর্যের মধ্যেই ঘটেছে তিন সংস্কৃতির মেলবন্ধন।

সাপের ভাস্কর্যের উপরে মেডুসার প্রতিকৃতি; Source: pinterest.com

এছাড়াও এই স্থানের আরেকটি চমৎকার নিদর্শন হলো দুটি সাপের ভাস্কর্য যা মাঝের স্থানটিতে অবস্থিত। ধারণা করা হয়, এটি আসলে ‘ভালো আত্মা’ নামে পরিচিত গ্রিক ‘আগাথোডাইমনের’ আলোকে তৈরি করা হয়েছে। তবে এর সবচেয়ে চমৎকার বৈশিষ্ট্য হলো এটিও অলঙ্কৃত হয়েছে রোমান ও মিশরীয় সংস্কৃতির নানা উপাদানে। এই সাপ দুটির ঠিক মাথার উপরেই রয়েছে অবাক করার মতো আরেকটি অদ্ভুত প্রতিকৃতি। আর সেটি হলো গ্রিক পুরাণের সেই কুখ্যাত মেডুসার, যে কিনা এই স্থানের অনাহূত আগন্তুকদের হাত থেকে এই সমাধিস্থানটিকে রক্ষা করছে।

মন্দিরের প্রবেশপথ; Source: pinterest.com

প্রথমদিকে সমাধিস্থানের এই মাঝের জায়গাটি ছিল ইংরেজি ইউ অক্ষর আকৃতির একটি করিডর। তবে ধীরে ধীরে এখানে সমাধিস্থ মৃতদেহের সংখ্যা বাড়তে থাকায় আরো কক্ষ ও হলঘর তৈরি করা হয়। ফলে গোটা স্থানটি এক গোলকধাঁধার রূপ নেয়। এই মাঝের স্থানটির ঠিক নিচেই রয়েছে আরেকটি স্তর। তবে দুর্ভাগ্যবশত মাটির নিচের এই স্তরটি প্লাবিত হয়ে যাওয়ায় তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে সেখানে ঠিক কী লুকিয়ে রয়েছে তা আজো সবার কাছে অজানা।

মৃতদেহ রাখার সমাধিকক্ষ; Source: wikimedia.org

সে যা-ই হোক, সব মিলিয়ে কম এল শকাফা সমগ্র মিশরের সবচেয়ে সেরা সংরক্ষিত নিদর্শন হিসেবে গণ্য হয়। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির যে অনন্য মিশ্রণ এখানে দেখা যায় সেটিই এই স্থানকে অন্য সব স্থানের তুলনায় আলাদা করেছে। আর এজন্যই এই স্থানটিকে মধ্যযুগীয় সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মধ্যযুগীয় সপ্তাশ্চর্যের বাকি স্থানগুলো হলো, কলোসিয়াম, হাজিয়া সোফিয়া, চীনের প্রাচীর, পিসার হেলান টাওয়ার, নানজিং এর চীনামাটির মিনার এবং বিখ্যাত স্টোনহেঞ্জ।

ফিচার ইমেজ – gattours.com

Related Articles