বিশ্বব্যাপী পর্যটন একটি অন্যতম বৃহত্তম শিল্প, যা বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে খুলে দিচ্ছে অসীম সম্ভাবনার দুয়ার। পর্যটন শিল্পের প্রবৃদ্ধির হার এমনকি জিডিপির চেয়েও বেশি, এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রতি বছর এর গড় অবদান ৮ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
আমাদের বাংলাদেশেও পর্যটন শিল্পকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে জাতীয় আয়ের সম্ভাব্য প্রধান উৎসের একটি হিসেবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো স্থানে একজন পর্যটক এলে তার বদৌলতে বিভিন্ন খাতে চারজন ব্যক্তির কর্মসংস্থান হয়। সে হিসাবে আমাদের দেশে বছরে যদি এক লক্ষ পর্যটক আসে, তাহলে বছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে চার লক্ষ।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের এক হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আট বছরে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ ৬ হাজার ৬৯৯ দশমিক ১৬ কোটি টাকা আয় করেছে। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপ প্রতিবেদন দেখে প্রাপ্ত তথ্যমতে, পর্যটন খাতের মাধ্যমে হয়েছে এই দেশের কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৪১ শতাংশ বা প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান। এছাড়া এই শিল্পের মাধ্যমে জিডিপির ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা মূল্য সংযোজন হচ্ছে ১৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা।
সুতরাং পর্যটন শিল্প আমাদের বাংলাদেশের জন্য এক আশীর্বাদের নাম। পর্যটন শিল্পের উন্নতির সাথে সাথে এই দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হবে। তাই আমরা সকলে চাই যেন বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প ক্রমান্বয়ে আরো উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে ওঠে।
তবে মজার (কিংবা দুঃখের) ব্যাপার হলো, সব দেশের জন্যই কিন্তু পর্যটন শিল্প আশীর্বাদের নাম নয়। বরং হিতে বিপরীত হওয়ারও রয়েছে অজস্র দৃষ্টান্ত। পর্যটন শিল্পের কারণে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শহরের উপরই পড়ছে নিদারুণ প্রভাব। প্রতিবছর ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি পর্যটক এসে ভিড় জমানোর ফলে ধ্বংস হতে বসেছে সেসব শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ, ব্যহত হচ্ছে স্থানীয় মানুষদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও।
এখন আপনাদের সামনে তুলে ধরব তেমনই কিছু শহরের বৃত্তান্ত, পর্যটন শিল্প যাদের জন্য আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হয়ে উঠেছে।
আমস্টারডাম
নেদারল্যান্ডসের এই শহরে স্থানীয় অধিবাসীর সংখ্যা ১ মিলিয়নেরও কম। অথচ ২০১৮ সালে এই শহরে বিদেশ থেকে পর্যটক এসেছে ১৮ মিলিয়ন। ফলে শহরটি এখন যতটা না এর মূল অধিবাসীদের, তার থেকে বেশি পর্যটকদের। এভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে স্থানীয় অধিবাসীদের স্বকীয়তা। তাই সব ধরনের প্রচেষ্টা চলছে পর্যটকদেরকে এই শহরের প্রতি অনাগ্রহী করে তুলতে।
সাময়িক সময়ের জন্য পর্যটকদের কাছে যেসব রিয়েল এস্টেট ভাড়া দেয়া হয়, সেগুলোর ফি প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া পর্যটকদের স্রোত ঠেকাতে শহরটির পর্যটন কর্তৃপক্ষ আরো একটি অভিনব উপায় বের করেছে। তারা এয়ারবিএনবি’র উপর শর্তারোপ করেছে যে, কোনো রেন্টাল লিস্টিংয়ে একই সময়ে চারজনের বেশি মানুষ থাকতে পারবে না, এবং কোনো অ্যাপার্টমেন্ট বছরে ৬০ দিনের বেশি ভাড়া দেয়া যাবে না।
স্যান ফ্রান্সিসকো
ক্যালিফোর্নিয়ার এই সমুদ্র তীরবর্তী শহরটি সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রে আগত পর্যটকদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল ছিল। তার কারণ এখানকার গোল্ডেন গেট ব্রিজ এবং ফিশারম্যান হোয়ারফ। কিন্তু সম্প্রতি সিলিকন ভ্যালির কল্যাণে এই শহরের প্রতি পর্যটকদের ভালোবাসা যেন এক ধাক্কায় কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে শহরটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়েছে লোমবার্ড স্ট্রিট, যেটিকে বলা হয়ে থাকে “বিশ্বের বক্রতম সড়ক”।
সেই আকর্ষণ এতটাই বেশি হয়ে গেছে যে, যানজট এই শহরের নিত্য অনুষঙ্গে রূপ নিয়েছে। তাই তো স্যান ফ্রান্সিসকো এখন বিশ্বের পঞ্চম যানজট বহুল শহর। এর পেছনে প্রধানত দায়ী অবশ্যই শহরের পর্যটকরা। কিন্তু এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, পর্যটন শিল্প থেকেই শহরটি বার্ষিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। পুঁজিবাদী মার্কিনিরা কি আর হাতের লক্ষ্মী এত সহজেই পায়ে ঠেলবে! তাই নগর পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যানজট সমস্যা নিরসন এবং শহরের অন্যান্য অংশগুলোরও উন্নতি ঘটানোর, যেন সব দর্শনার্থী এসে কেবল হাতেগোনা কিছু জায়গায় ভিড় না জমায়।
সান্তোরিনি
গ্রিসের সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত এক অনন্য সুন্দর দ্বীপ সান্তোরিনি। সাদা সাদা বাড়ি, সেগুলোর নীলরঙা ছাদ, এবং যত দূর চোখ যায় শুধু ফিরোজা রঙের জলরাশি, সব মিলিয়ে একজন পর্যটকের হৃদয়কে অপার্থিব ভালো লাগায় দ্রবীভূত করবার সকল উপাদানই বিদ্যমান এই দ্বীপে। কিন্তু নয়নাভিরাম হলেও নির্জন নয় দ্বীপটি। গ্রীষ্ম মৌসুমে পর্যটকের ভিড়ে রীতিমতো গমগম করতে থাকে দ্বীপ শহরটি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, যে শহরের মূল অধিবাসীর সংখ্যা মেরেকেটে হাজার পনেরোর মতো, সেখানেই কি না ২০১৫ সালে ৬৩৬টি ক্রুইজ শিপে চেপে পর্যটক এসেছিল ৭ লক্ষ ৯০ হাজার। এই বিপুল পরিমাণ পর্যটকের চাপ আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়! তাই গ্রিক পর্যটন অধিদপ্তর থেকে জারি করা হয়েছে এক অলংঘনীয় নীতি। দৈনিক ৮ হাজারের বেশি পর্যটক কিছুতেই পা রাখতে পারবে না এই দ্বীপে।
প্রাগ
কী কারণে পার্টিপ্রিয় পর্যটকদের কাছে অতি পছন্দের গন্তব্য চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ? উত্তরটি খুব সহজ। এখানকার খোলামেলা বার, আর সেখানকার সস্তা বিয়ার। একই সাথে এত আনন্দের ফোয়ারা ছোটে যেখানে, জনসমাগম সেখানে না হয়ে কি আর পারে! কিন্তু মদ্যপরা তো আর শুধু মদ পান করেই সন্তুষ্ট থাকে না। তারা যে মাতাল হয়েছে সেটি মানুষকে চিৎকার করে জানাতেও পছন্দ করে। এভাবে বিদেশী মদ্যপরা দূষিত করে ফেলছিল প্রাগ শহরের রাতের পরিবেশ।
একপর্যায়ে অবস্থা এতটাই বেসামাল হয়ে পড়েছিল যে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এখন পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে গোটা শহরব্যাপী “রাত্রিকালীন নীরবতা” জারি করেছে, যা শুরু হয়ে যায় রাত ১০টা থেকেই। এছাড়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগওয়েজও, এবং বর্তমানে চেষ্টা চলছে শহরের বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত) বিয়ার বাইক (একধরনের পেডেল চালিত যান, যা পর্যটকদের ব্রিউয়ারি ও বারে নিয়ে যায়) যানগুলোকেও নিয়ন্ত্রণে আনার।
ভেনিস
ইতালির ভাসমান শহর ভেনিস। এই শহর যে ডুবে যাচ্ছে, তা মোটামুটি সকলেরই জানা। প্রতি বছর অন্তত একশোবার বন্যা হয় এখানে। তবে সেই বন্যা তো প্রাকৃতিক। এছাড়া আরেকটি কৃত্রিম বন্যাতেও প্রতিনিয়ত ডুবতে ডুবতে ভাসতে থাকে এই শহর, এবং একদিন হয়তো পুরোপুরি ডুবে যাবে। সেটি হলো পর্যটকদের বন্যা। অতি উৎসাহী পর্যটকরা এই শহরে এসে ওয়াটার ট্যাক্সি ও ক্রুজ শিপে করে ঘুরে বেড়াতে থাকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানে। অথচ তারা বুঝেও বুঝতে চায় না যে, তাদের কারণেই এসব স্থানের অবকাঠামো দিন দিন আরো বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। বিশেষত ক্রুইজ শিপের কারণে ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে শহরটির জলীয় ও বায়বীয় পরিবেশ।
ইদানিং এসব নিয়ন্ত্রণে বেশ কঠোর ভূমিকা পালন করছে শহরের প্রশাসন। যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা, ক্রীড়নকে অংশ নেয়া, প্রকাশ্যে জামা ছাড়া বের হওয়া, লাভ লক ছেড়ে যাওয়া, এবং কোনো গাছ বা দালানের উপর লেখাকে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন হোটেল রুম ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রেও নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে।
বার্সেলোনা
শুধু ক্লাব ফুটবলেই সীমাবদ্ধ নেই বার্সেলোনার জনপ্রিয়তা। এটি ইউরোপের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্রও বটে। তাই তো মাত্র ১.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার শহরটিতে গত বছর ভিড় জমিয়েছিল ৩০ মিলিয়ন দর্শনার্থী। তাদের মূল গন্তব্য অবশ্যই সমুদ্র সৈকত। কিন্তু প্রায় সময়ই অনেক দর্শনার্থী সমুদ্র সৈকতে গিয়ে এত বেশি উদ্দাম উল্লাসে মেতে ওঠে যে, তা সভ্যতা-ভব্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ফলে বার্সেলোনা শহরের স্থানীয়রা এখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে পর্যটকদের যন্ত্রণায়।
ঠিক কতটা অতিষ্ঠ তারা, তার প্রমাণ মিলেছে চলতি বছরের গোড়ার দিকে। পর্যটনবিরোধী আন্দোলন বের করেছিল বার্সেলোনার কতিপয় স্থানীয় অধিবাসী। এবং একপর্যায়ে তা সহিংস রূপ ধারণ করে, যখন তারা হামলা চালিয়ে বসে একটি ট্যুর বাস ও হোটেলে। কেন তারা এ কাজ করেছে, সে বিষয়ে যুক্তিসঙ্গত কারণও তারা উত্থাপন করেছে। পর্যটকদের কাছ থেকে তাদের চাওয়া তো খুব বেশি না। কেবল শহরের যত্রতত্র আবর্জনা না ফেলা, এবং রাতের বেলা একটু নীরব থাকলেই তারা খুশি। অথচ সেটুকু চাওয়াও যেন পূরণ করতে বড্ড আপত্তি বিদেশীদের। এভাবেই স্থানীয়দের সাথে পর্যটকদের সম্পর্ক যেভাবে সাপে-নেউলে হয়ে উঠছে, তাতে আর কতদিন যে বার্সেলোনা পর্যটন শিল্পে নিজের মুকুট ধরে রাখতে পারবে, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়ে যায়।
মাচু পিচু
পেরুতে অবস্থিত প্রাচীন ইনকা সভ্যতার এই গ্রাম মানবসভ্যতার ইতিহাসের এক অমূল্য নিদর্শন। স্বভাবতই ইতিহাসপ্রেমী এবং সৌন্দর্যপিপাসু, দুই শ্রেণীর মানুষের কাছেই এর অনুরক্তি অন্য মাত্রায় বিরাজমান। তাই তো ২০১১ সালে পেরু সরকার ও ইউনেস্কো যৌথভাবে এখানকার দৈনিক দর্শনার্থীর সংখ্যা ২,৫০০ নির্ধারিত করে দিলেও, প্রতিদিন কয়েক গুণ বেশি পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে এই গ্রাম। তাছাড়া গত বছরের জুলাই থেকে পর্যটকদের জন্য কেবল দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে, নির্দিষ্ট কিছু জায়গা উন্মুক্ত করার ঘোষণা এলেও, বাস্তবে তা মানছে না অনেকেই। এবং উদ্বেগের বিষয় হলো, এই বিপুল পরিমাণ জনস্রোত ধারণের ক্ষমতা সত্যিই নেই মাচু পিচুর।
দর্শনীয় স্থানগুলো সবসময়ই থাকছে ঝুঁকির সম্মুখীন: এই বুঝি মূল্যবান কিছু একটা নষ্ট হয়ে গেল! তাছাড়া ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক তো সেই ২০০২ সালেই তাদের এক প্রতিবেদনে সাবধান করে দিয়েছিল যে মানুষের চাপে যেকোনো সময়ে ভূমিধসের সৃষ্টি হতে পারে। তাই প্রশাসনের উচিৎ অতিসত্বর পর্যটন আইন আরো শক্তিশালী করা, এবং তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
ভ্রমণের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/