“ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক
চলে রেল গাড়ি
এতে চড়ে আমি এবার পৌঁছে যাব বাড়ি।।
রেল গাড়ি রেল গাড়ি চলে এঁকে বেঁকে
বাঁশি বাজায় জোরে জোরে একটু থেকে থেকে ।।
নিয়ে যাবে সঙ্গে করে মিষ্টি যে সাত হাড়ি
সবাই মিলে মজা করে যাবো মামার বাড়ি।।”
ছোটবেলায় এই ছড়াগানটি কম-বেশি সকলেই স্কুলের বার্ষিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে শুনে থাকবেন। আমার যতদূর মনে পড়ে আমার স্কুলের কোনো এক প্রতিযোগিতায় এই একই গান ৫ থেকে ৭ জন প্রতিযোগী এককভাবে গেয়েছিল! এতই প্রচলিত গান এটি। গানটির গীতিকার ও সুরকার এ. এফ. এম. আলিমউজ্জামান। ছেলেবেলার কথা আসলেই একটু বেশি আনন্দে কাটানো মুহূর্তের কথাগুলোই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে যায়।
আর ছোটবেলায় রেলগাড়ির গল্প পড়া বা রেলগাড়ি চড়া মানেই মনে হতো অন্যরকম একটা আনন্দ। কিন্তু আমরা কি জানি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যবাহী নানা রেলগাড়ির কথা? এসব রেলগাড়ি চালুর ইতিহাস যেমন অনেক পুরনো, তেমনি সময়ের সাথে সেই প্রাচীনত্বকে ধারণ করে সময়োপযোগী বিলাস-ব্যসনে আর আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে এগুলো এখনও নতুন যুগের রেলগাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে চলেছে। আজ আমরা তেমন কিছু বিশ্বসেরা কু-ঝিক ঝিক রেলগাড়ির গল্প করবো, জানতে চেষ্টা করবো সেসব রেলগাড়ি সম্পর্কে অনেক কিছু।
ভেনিস সিম্পলন- দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস, ১৮৮৩
এই বিলাসবহুল ট্রেনটি ভেনিস সিম্পলন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস নামেও পরিচিত। ইউরোপের এই ট্রেন পৃথিবীর সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ট্রেনেগুলোর মাঝে অন্যতম। ১৮৮৩ সাল থেকে শুরু হয় এই ট্রেনের পথচলা। সমস্ত ইউরোপ থেকে প্যাসেঞ্জার তুলে রোমানিয়াতে গিয়ে পৌঁছে ট্রেনটি। যাত্রাপথের মাঝে পড়ে স্ট্রাসবুর্গ, ভিয়েনা, বুদাপেস্ট এবং বুখারেস্ট সহ আরও কিছু স্থান। মূলত এই ট্রেনটি ছ’টি ভিন্ন ভিন্ন দেশ এবং দশটি পৃথক পৃথক রেল লাইনের চলার পথ অতিক্রম করে। প্রাচীন ইউরোপীয় শৈলীতে ট্রেনের ভেতরের অংশ ডিজাইন করা, যা কিনা বিশ্বনন্দিত ডিজাইনার রেনে লালিকের মস্তিষ্কপ্রসূত।
এই ট্রেনে অপূর্ব সব খাবার সার্ভ করা হয় শুধু চিনেমাটি এবং রূপোর বাসনে। ডাইনিং কার সাজানো হয় দুধ সাদা লিনেনের কাপড় দিয়ে। সান্ধ্যভোজের সময় আবার ড্রেস কোড আছে। ছেলেরা কালো স্যুট আর মেয়েরা ফরমাল গাউন পরেই কেবল সেই ভোজনে অংশ নিতে পারেন।ট্রেনটি বিলাসবহুল ব্যবস্থা বিখ্যাত হওয়ার পেছনে রয়েছে এর অসাধারণ স্লিপিং কার সিস্টেম আর পাঁচ কোর্সের লাক্সারি মিলের আয়োজন। এছাড়া আছে এর রয়্যাল ট্রাভেলার্স সুবিধা যার মাঝে অন্তর্ভুক্ত আছে অভিজাত শ্রেণী, আমলা ও কূটনীতিকদের জন্য অসাধারণ শৈলীতে বিশেষ আপ্যায়ন ব্যবস্থা।
দ্য ট্রান্স সাইবেরিয়ান এক্সপ্রেস, ১৮৯৮
রাশিয়ার মানুষদের অন্যতম লাইফ লাইন এই বিলাসবহুল ট্রেন ট্রান্স সাইবেরিয়ান এক্সপ্রেস। ট্রেনটি মস্কো থেকে রাশিয়ার সুদূর পূর্ব উপকূলে ভ্লাদিভস্টক পর্যন্ত চলে একটানা। যাত্রাপথে প্রায় ৫,৭৭৮ মাইল অতিক্রম করে ট্রান্স সাইবেরিয়ান এক্সপ্রেস। সব মিলিয়ে এটি এর রেগুলার ট্রিপে ৯১টি স্টেশনে বিরতি নিয়ে চলতে মোট সময় নেয় ৯ দিনের মতো। এই যাত্রার সৌজন্যে গোটা রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের বৈচিত্রময় সংস্কৃতির সাথে পরিচয় হয়ে যায় যাত্রীদের। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো সাইবেরিয়ার বিখ্যাত বৈকাল হ্রদও এই যাত্রাপথের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সুতরাং একে নিঃসন্দেহে সুন্দর একটা ট্রিপ বলা যেতেই পারে।
দ্য ব্লু ট্রেন, ১৯২৩
দক্ষিন আফ্রিকার পর্যটন শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো এই জমকালো বিলাসবহুল ব্লু ট্রেন। কেপটাউন থেকে জোহানেসবার্গ পর্যন্ত এই ট্রেন যাত্রা করতে সময় নেয় ২৭ ঘণ্টা। আর এই সময়ে ট্রেনটি অতিক্রম করে ৯৯৪ মাইল। দুরন্ত গতিময় ট্রেনের যুগে এসেও এই ট্রেন কিন্তু ঘণ্টায় অতিক্রম করে মাত্র ৬৮ কিলোমিটার।
তবে এমন গতির পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। এই মন্থর গতিসম্পন্ন ট্রেন জার্নির একমাত্র কারণ হলো দক্ষিণ আফ্রিকার নৈসর্গিক রূপ সৌন্দর্য। এতে করে প্রত্যেক যাত্রীই সুন্দর মতো প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। ট্রেনে থাকার ব্যবস্থা দু’রকম- ১) ডিলাক্স স্যুট, এতে রয়েছে লাউঞ্জ ও বাথটাব সহ স্নানঘর এবং ২) লাক্সারি স্যুট, এতে লাউঞ্জ না থাকলেও থাকে ব্যক্তিগত স্নানঘরের সুব্যবস্থা। প্রতিটি বগিতেই চারটি করে স্যুট থাকে। তবে গিরি-উপত্যকা, সমুদ্রের উপর দিয়ে ছুটে চলা যাত্রাপথই হলো এই ট্রেনের মূল আকর্ষণ।
দ্য ফ্লায়িং রয়্যাল স্কটসম্যান, ১৯২৮
লন্ডনের কিংস অতিক্রম করে এডিনবরা হয়ে চলা এই ফ্লায়িং রয়্যাল স্কটসম্যান ট্রেনটি হলো সর্বপ্রথম নন-স্টপ এক্সপ্রেস ট্রাভেলিং ট্রেন। স্কটল্যান্ডের সংস্কৃতিকে বুঝতে হলে এই ট্রেনে যাত্রা করা চাই অবশ্যই। তবে মজার ব্যাপার হলো, সর্বসাকুল্যে মাত্র ৩৬ জন যাত্রী সফর করতে পারেন এই ট্রেনে।
এই ট্রেন বিলাসবহুল ট্রেনগুলোর কাতারে পড়ার কারণ হলো এর প্যাসেঞ্জারদের দেওয়া সব সুযোগ সুবিধা। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে হেয়ার ড্রেসিং স্যালুন, বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট ও বার। এমনকি কিছু সময়ের জন্যে মুভি কোচেরও সুব্যবস্থা রয়েছে ট্রেনটিতে। তাছাড়া ট্রেনে ওঠার সময় রেড কার্পেট রোল বিছিয়ে দেওয়া হয়, ইউনিফর্ম পরা ব্যাগপাইপাররা স্কটিশ সংগীত বাজিয়ে অভ্যর্থনা জানান। খাবার হিসেবে থাকে স্কটল্যান্ডের কুইজিনের বিশেষ কিছু পদ। এসব কিছু দিয়েই স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় ট্রেনটির।
স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখতেই এই ট্রেনে এক থেকে সাতদিনের প্যাকেজ ট্যুর অফার করে থাকে স্কটল্যান্ড ট্যুরিজম। তবে এই ট্রেনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর অবজারভেশান কেবিন, যেখানে আরাম করে বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেন যাত্রীরা। বিভিন্ন প্রাসাদ, মিউজিয়াম, গলফ কোর্স ঘুরিয়ে দেখার রয়্যাল জার্নির অপর নামই হলো ‘ফ্লায়িং রয়্যাল স্কটসম্যান’।
দ্য সুপারচিফ এক্সপ্রেস, ১৯৩৮
আমেরিকার সেরা লং ডিসট্যান্স ট্রেন বলা হয় এই সুপারচিফ এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে। ট্রেনটি শিকাগো থেকে লস অ্যাঞ্জেলস পর্যন্ত চলে। এই ট্রেন জার্নির অন্যতম বিশেষত্ব হলো জিভে জল আনা মুখরোচক একেকটি কন্টিনেন্টাল খাবার। কথিত আছে, এক সময় হলিউড তারকারা এই ট্রেনে যাতায়াত করতেন। আর তাদের দেখার জন্যই বেশির ভাগ মানুষ এই ট্রেনে যাতায়াত করতো।
দ্য রকি মাউন্টেনিয়ার, ১৯৯০
কানাডার রকি পর্বতাঞ্চলের এই ট্রেনটি কেবলমাত্র দিনের বেলাতেই চলে। এই ট্রেনটির জনপ্রিয়তা এতই তুঙ্গে যে একটির পরিবর্তে দুটি রুটে ট্রেনের যাত্রার ব্যবস্থা করা হয়। ট্রেন ছাড়ে ভ্যাংকুভার থেকে। একটি রুটের ট্রেনের গন্তব্য অ্যালবার্টার ব্যানফ শহর এবং অপরটির গন্তব্য থাকে জ্যাসপার।
প্রতিটি ট্রেনে ৫০০ জন করে যাত্রী যেতে পারেন। সূর্যাস্তের পরেই ক্যামলুপস নামের একটি ছোট্ট শহরে যাত্রীদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। পরের দিন ভোরবেলাতে আবার যাত্রা শুরু হয়। তবে বেশিরভাগ সময় রাস্তা বিপদজনকভাবে তুষারে ঢাকা থাকায় এই ট্রেনটি শুধু এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলে। তারপর আবার তুষারপাত কমলে শুরু হয় ট্রেনটির যাত্রা।
দ্য গোল্ডেন ঈগল, ২০০৭
একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সাইবেরিয়ান অঞ্চল ঘুরে দেখার জন্য এই বিলাসবহুল গোল্ডেন ঈগল ট্রেনটিতে ভ্রমণের অন্য কোনো বিকল্পই নেই। ২০০৭ সালে ট্রেনটির যাত্রা শুরু হয় মস্কোতে। এই ট্রেনে ইম্পেরিয়াল ক্লাসের পাশাপাশি গোল্ডেন এবং সিলভার স্যুট রয়েছে। অবশ্য সব ধরনের স্যুটেই বিলাস-ব্যসনের সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া দুটো ডাইনিং কার এবং একটি লাউঞ্জ কারও রয়েছে ট্রেনটিতে।
ট্রেনটি বিখ্যাত ট্রান্স সাইবেরিয়ান রুটে মস্কো এবং ভ্লাদিভস্টকের মাঝে চলাচল করে। তাছাড়া এই ট্রেনের স্পেশাল ট্যুরের অন্তর্ভুক্ত থাকে সিল্ক রোড, রাশিয়া আর্কটিক, ইরান এবং কাস্পিয়ান এলাকার স্থানসমূহ। দুই ধরনের ইমপেরিয়াল স্যুটে রয়েছে বিশাল কিং বেড, ডেডিকেটেড ড্রেসিং টেবিল ও সুদৃশ্য লাউঞ্জ। প্রত্যেক প্যাসেঞ্জারের জন্য ট্রেন যাত্রায় অত্যন্ত আধুনিক সেবা, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজিং, সুস্বাদু আপ্যায়ন এবং খাবার-দাবার উপভোগ করতে করতে জার্নির সময় কাটানোর সুযোগ থাকে।