বিশাল এ পৃথিবীতে দর্শনীয় স্থানের কোনো শেষ নেই। তার উপর প্রতি বছরই পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন স্থাপনা, জাদুঘর, পার্ক ইত্যাদি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তৈরি এরকমই ১০০টি স্থানের একটি তালিকা তৈরি করেছে টাইম ম্যাগাজিন। তাদের প্রতিবেদকদের পাঠানো প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে ৪৮টি দেশের ১০০টি স্থানের এ তালিকাটিকে তারা বলছে World’s Greatest Places 2018। চলুন জেনে নিই এই তালিকার সেরা ১৫টি স্থানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
তিয়ানজিন বিনহাই লাইব্রেরি, চীন
চীনের তিয়ানজিনে অবস্থিত এই পাবলিক লাইব্রেরিটি দেখলে মনে হবে যেন একেবারে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জগত থেকে উঠিয়ে এনে বসানো হয়েছে একে। পাঁচতলা উঁচু এই লাইব্রেরিটিতে স্তরে স্তরে সাজানো আছে প্রায় ১৩.৫ লাখ বই। প্রায় ৩৩ হাজার ৭০০ বর্গমিটার ভূমির উপর স্থাপিত লাইব্রেরিটিতে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার দর্শনার্থী ভীড় করে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে চালু হওয়া লাইব্রেরিটিতে এখন পর্যন্ত দেশ-বিদেশের ১৮ লক্ষ মানুষ ভ্রমণ করেছে।
সাইক্লিং থ্রু ওয়াটার, বেলজিয়াম
এটি বেলজিয়ামের ডি উইজার্স নেচার রিজার্ভে অবস্থিত একটি পুকুরের মধ্য দিয়ে তৈরি সাইকেল চালানোর উপযোগী রাস্তা। ২১২ মিটার দীর্ঘ কংক্রিটের এ সেতুটি পানির মধ্যে এমনভাবে নিমজ্জিত অবস্থায় নির্মাণ করা হয়েছে যে, সাইকেল আরোহীদের কাছে মনে হবে তারা বুঝি পানির মধ্য দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে। ২০১৬ সালে চালু হওয়া এ পথটি এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ সাইকেল আরোহীকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।
মর্গান’স ইন্সপাইরেশন আইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র
শারীরিক প্রতিবন্ধী কন্যা মর্গানের বিনোদনের জন্য তার বাবা গর্ডন হার্টম্যান ২০১০ সালে তৈরি করেন মর্গান’স ওয়ান্ডারল্যান্ড নামে একটি থিমপার্ক। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে তার পাশেই নির্মাণ করেন একটি ওয়াটার পার্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অবস্থিত এই পার্কটি সব ধরনের মানুষের জন্য উন্মুক্ত হলেও এর বিশেষত্ব হচ্ছে, এতে সব ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে।
গোল্ডেন ব্রিজ, ভিয়েতনাম
ভিয়েতনামের ‘বা না’ পাহাড়ের উপর অবস্থিত বিশালাকার দুটি হাত দেখলে মনে হতে পারে সেগুলো কোনো প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু বাস্তবে সেগুলো এ বছরের মে মাসে নির্মিত গোল্ডেন ব্রিজের দুটি সাপোর্ট বা খুঁটি। ১৫০ মিটার দীর্ঘ ব্রিজটি একটি ক্যাবল কার স্টেশনকে নিকটস্থ একটি বাগানের সাথে সংযুক্ত করেছে। স্টেইনলেস স্টিলের রেলিং এবং কাঠের পাটাতনের ব্রিজটির সাথে ওয়্যার মেশ এবং ফাইবার গ্লাসের তৈরি বিশালাকৃতির হাত দুটো মূলত নির্মাণ করা হয়েছে পর্যটকদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য।
টিপেট রাইজ আর্ট সেন্টার, যুক্তরাষ্ট্র
প্রকৃতি, শিল্প এবং সঙ্গীতের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানায় ১১ হাজার ৫০০ একরের বিশাল ভূমির উপর নির্মিত হয়েছে টিপেট রাইজ আর্ট সেন্টার। ২০১৬ সালে চালু হওয়া আর্ট সেন্টারটিতে চিত্র প্রদর্শনীর হল এবং কনসার্ট হল ছাড়াও বাইরের উন্মুক্ত স্থান জুড়ে আছে বিশাল আকৃতির কিছু ভাস্কর্য।
প্যানডোরা: দ্য ওয়ার্ল্ড অব অ্যাভাটার, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড রিসোর্টের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ডিজনি অ্যানিমেল ল্যাণ্ড থিমপার্ক। আর এই ডিজনি অ্যানিমেল ল্যান্ডেরই সর্ব সাম্প্রতিক সংযোজন প্যানডোরা। জেমস ক্যামেরনের অ্যাভাটার চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত ১২ একর আয়তনের এই থিমপার্কে আছে ভাসমান পর্বত, ভিনগ্রহের কৃত্রিম প্রাণী, আলোকোজ্জ্বল গাছপালা ইত্যাদি। ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মাধ্যমে এলিয়েন গ্রহের উপর দিয়ে উড়ে বেড়ানোর সুযোগ এর অন্যতম আকর্ষণ।
এব ফিলহারমনিক হল, জার্মানি
জার্মানীর হামবুর্গে এব নদীর মাঝে গ্রাসব্রুক দ্বীপের উপর অবস্থিত এই কনসার্ট হলটির প্রচলিত নাম এলফি। ইটের তৈরি পুরনো একটি ওয়্যারহাউজের উপরে অবস্থিত কনসার্ট হলটি কাঁচের তৈরি। দেখতে অনেকটা পাল তোলা নৌকার মতো হলটি শুধুমাত্র এর নান্দনিকতাই না, একইসাথে অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেমের জন্যও বিখ্যাত।
মিউজিয়াম মাকান, ইন্দোনেশিয়া
এর পুরো নাম দ্য মিউজিয়াম অব মডার্ন অ্যান্ড কন্টেম্পোরারি আর্ট নসান্ত্রা। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার নসান্ত্রায় প্রায় ৪ হাজার বর্গমিটার ভূমির উপর নির্মিত এই জাদুঘরটি চোখ ধাঁধানো সব চিত্র ও শিল্পকর্মের অপূর্ব সংগ্রহশালা। সব বয়সী দর্শকদের জন্য উপযোগী এ জাদুঘরটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে।
সিউলো ২০১৭ স্কাইগার্ডেন, দক্ষিণ কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া হাইওয়ে ওভারপাসের উপর নির্মিত হয়েছে সিউলো স্কাইগার্ডেন নামের এই এলিভেটেড পার্কটি। প্রায় ১ কিলোমিটার দীর্ঘ পায়ে চলার উপযোগী পথটিতে বিভিন্ন ক্যাফে, ফুটবাথ ছাড়াও আছে প্রায় ২৪ হাজার গাছপালার এক সরলরৈখিক বাগান। ২০১৭ সালের মে মাসে চালু হওয়া স্কাইগার্ডেনটির রাত্রিকালীন দৃশ্য পথচারীদেরকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।
সেন্ট্রাল আইডাহো ডার্ক স্কাই রিজার্ভ, যুক্তরাষ্ট্র
সারা বিশ্বে মাত্র ১২টি স্থান আছে, যেগুলোকে ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক স্কাই অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষ ডার্ক স্কাই রিজার্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্থানগুলোর বায়ুমণ্ডল এতই পরিষ্কার যে, এগুলো থেকে খালি চোখে রাতের আকাশে সবচেয়ে বেশি তারা দেখা সম্ভব। গত বছর এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল আইডাহোর ২ হাজার ২৫০ বর্গকিলোমিটারের একটি এলাকা। এটিই এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম এবং একমাত্র ডার্ক স্কাই রিজার্ভ।
থ্রেড, সেনেগাল
সিনথিয়ান হচ্ছে সেনেগালের দুর্গমতম এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু সেখানে নির্মিত থ্রেড নামের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কল্যাণে শহরটি এখন হয়ে উঠেছে দেশ-বিদেশের সংস্কৃতিমনা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। স্থানীয় বাঁশ এবং মাটি দ্বারা তৈরি ভবনটি শুধু সংস্কৃতির মিলনমেলা হিসেবেই ব্যবহৃত হয় না, এটি একইসাথে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক শিল্পীদেরকে এখানে বসবাস করার এবং কাজ করার সুবিধাও দেয়।
জারিয়াদাই পার্ক, রাশিয়া
জারিয়াদাই পার্ক হচ্ছে গত অর্ধ শতকের মধ্যে মস্কোতে নির্মিত প্রথম পাবলিক পার্ক। প্রায় ৭৮ হাজার বর্গমিটার ভূমির উপর নির্মিত পার্কটিতে আছে বিশাল একটি কনসার্ট হল, বরফের গুহা, মস্কো নদীর উপর অবস্থিত বুমেরাং আকৃতির একটি ভাসমান ব্রিজসহ আরো নানা আকর্ষণ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে চালু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি মানুষ পার্কটি ভ্রমণ করেছে।
আন্ডারওয়াটার মিউজিয়াম অব আর্ট, যুক্তরাষ্ট্র
ফ্লোরিডার আন্ডারওয়াটার মিউজিয়াম অব আর্ট হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পানির নিচের জাদুঘর। এ বছর চালু হওয়া মিউজিয়ামটি মূলত সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত বিশালাকৃতির সাতটি শিল্পকর্ম। এদের মধ্যে আছে স্টিলের তৈরি একটি আনারসের কাঠামো, একটি মাথার খুলি, একটি অক্টোপাসসহ আরো চারটি ভিন্ন ভিন্ন ভাস্কর্য। প্রতি বছরই এতে নতুন নতুন শিল্পকর্ম যুক্ত হওয়ার কথা আছে। পানির উপর থেকেও ভাস্কর্যগুলো দেখা যায়, কিন্তু এর আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে দর্শনার্থীদেরকে ডুবুরীর পোশাক পরতে হবে এবং সাঁতার কাটতে জানতে হবে।
মারিপোসা গ্রোভ, যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার গ্রোভ হচ্ছে বিরল প্রজাতির সেকুইয়া বৃক্ষের বনাঞ্চল। এই গাছগুলো প্রায় ১০০ মিটার উঁচু হয়ে থাকে এবং ৩ হাজার বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। গাছগুলোকে দূষণ থেকে রক্ষার জন্য ২০১৫ সালে ৪০ মিলিয়ন ডলারের বিশাল প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যার মধ্যে আছে রাস্তা এবং পার্কিং এরিয়াকে অনেক দূরে নিয়া যাওয়া, পায়ে চলা পথের পাশে গাছপালা লাগানো, কাঠের তৈরি সেতু ও কৃত্রিম জলপ্রবাহ তৈরি করা ইত্যাদি। এ বছর জুনে বনাঞ্চলটি পুনরায় চালু করা হয়েছে।
তাই কুয়ান, হংকং
হংকংয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংস্কার প্রকল্প এটি। ১৫০ বছরের পুরানো ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনামলের সেন্ট্রাল পুলিশ স্টেশন, সেন্ট্রাল ম্যাজিস্ট্রেসি এবং ভিক্টোরিয়া প্রিজনের ১৬টি ভবনকে সংস্কার করে রূপান্তরিত করা হয়েছে তাই কুয়ান শিল্প ও ঐতিহ্য কেন্দ্রে। এতে সময় লেগেছে ৮ বছর এবং খরচ হয়েছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বছরের মে মাস থেকে চালু হওয়া তুই কুয়ান হংকংয়ের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র হতে যাচ্ছে বলে আশা করা হচ্ছে।
ফিচার ইমেজ- Time