
“Bengal has hundred gates open for entrance but not one for departure.”
ষোড়শ শতকের শেষের দিকে ভ্রমণে আসা জ্যাঁ ব্যাতিস্ত টার্ভানিয়ার প্রাচীন বাংলাদেশ সম্পর্কে এমনই মন্তব্য করেছিলেন। প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস ঘাটালে আমরা দেখতে পাই বাংলার আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ নানা সময়ে এই বাংলায় ছুটে এসেছেন।
কী ছিলো প্রাচীন বাংলায় যাতে মুগ্ধ হতেন পর্যটকেরা? স্বর্ণ-হীরার খনি কিংবা রূপার পাহাড় কিছুই ছিলো না; ছিলো উদার প্রকৃতি, নদীবিধৌত উর্বর সবুজ ফসলের মাঠ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নদী, ইলিশ এবং আভিজাত্যের প্রতীক মসলিন। আর ছিলো এ দেশের সহজ সরল মানুষ, তাদের আবহমান সংস্কৃতি। সংস্কৃতি আর ঐশ্বর্যের এই মহা সমারোহের অমোঘ আকর্ষণে তারা ছুটে আসতেন আমাদের এই বাংলায়। ঠিক কবে থেকে বাংলায় ভিনদেশীরা আসতে শুরু করেছেন সেই সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা মুশকিল। তবে বাংলার ইতিহাস, তথ্যপ্রবাহ ইত্যাদি থেকে আমরা বেশ কয়েকজন ভিনদেশী পর্যটক সম্পর্কে জানতে পারি। এই লেখাটিতে থাকছে প্রাচীন বাংলার কয়েকজন পর্যটক আর তাদের চোখে দেখা বাংলার কথা।

অর্থনীতিবিদ চাণক্য; ছবিসূত্রঃ Wikimedia Commons
খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে এসেছিলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌটিল্য (তার আরেক নাম চাণক্য)। কৌটিল্যের বর্ণনামতে তৎকালীন সময়ে এই ভূখন্ড থেকে প্রবাল, শঙ্খের মালা, কাছিমের ছাল ইত্যাদি সংগ্রহ করা হতো। পুন্ড্রে (বগুড়া, দিনাজপুর ও রাজশাহী অঞ্চল) রেশমী বস্ত্র তৈরী হতো। কামরূপের জঙ্গল থেকে হাতির দাঁত সংগ্রহ করা হতো এবং সেগুলো অলংকার তৈরীতে কাজে লাগতো।

চীনের পরিব্রাজক ফা হিয়েন; ছবিসূত্রঃ Special Interest Holidays to India
আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৩৯৯ অব্দে পায়ে হেঁটে বাংলা ভ্রমণে আসেন চীন দেশের ফা হিয়েন। তিনি মূলত একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন। তিব্বতের পামীর মালভূমির দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সঙ্গীদের সাথে তিনি এখানে আসেন। ৩৯৯–৪১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেন। তার লেখা ভ্রমণকাহিনীতে প্রাচীন বাংলার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন- সে সময়ে এখানে চণ্ডাল ছাড়া কেউ প্রাণীহত্যা করতো না।

চীন দেশের হিউয়েন সাং; ছবিসূত্রঃ Pinterest
হিউয়েন সাং একাধারে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, পর্যটক এবং অনুবাদক ছিলেন। ৬৩০-৬৪০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে চীনের এই পরিব্রাজক বাংলা ভ্রমণ করেন। চীন ও ভারতের মধ্যকার যোগসূত্র স্থাপনে তার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। মূলত গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও নিদর্শন পরিদর্শন এবং অন্যান্য ভিক্ষুদের রচনাবলী সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি এই ভ্রমণ শুরু করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি সমতট (কুমিল্লার কিছু অংশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী ও চাঁদপুর অঞ্চল), পুণ্ড্র, হরিকেল (চট্টগ্রাম, কুমিল্লার কিছু অংশ, ত্রিপুরা এবং তৎসংলগ্ন এলাকা) ও চন্দ্রদ্বীপ (বরিশাল) জনপদ ভ্রমণ করেন। তার লেখা ভ্রমণকাহিনী থেকে জানা যায় ঐ সময়ে তিনি সমতটের প্রায় ৩৫টি বিহার ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি বিশ্বখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ও পরিদর্শন করেন। সেখানে তার সাথে অধ্যাপক শীলভদ্রের সাক্ষাৎ হয়। সেখানে প্রায় ৭০০ ভিক্ষু দেখেছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

চীনের ই-সিং; ছবিসূত্রঃ Richard Hunn Association for Ch’an Study
সপ্তম শতকে বাংলায় আসেন আরেক চীনা নাগরিক ‘ই-সিং’। তিনি হরিকেল ও চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চল ঘুরে দেখেছিলেন। তার বর্ণনামতে তখনকার সময়ে শালি ধানের ভাত বেশ জনপ্রিয় ছিল। মাষকলাই, তিল, মুগ ও যবের চাষ হতো প্রচুর পরিমাণে। নানারকম পিঠা পায়েস ও মিষ্টির চল ছিল। কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছ আর পাট শাক ছিল চরম উপাদেয়। তৎকালীন লোকেরা গবাদিপশু রক্ষায় এবং নানা ধরণের বিপদে-আপদে মন্ত্রের সাহায্য নিতো। নবম শতকে, মতান্তরে ১১৫১ সালে, বাংলা ভ্রমণে এসেছিলেন আরব দেশের পর্যটক সোলায়মান। তার লেখা ভ্রমণ কাহিনীর নাম ‘সিল সিলাত আল তাওয়ারিখ’। এই বইটি পরে লন্ডন থেকে প্রকাশ করা হয়। তিনি বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও এই অঞ্চলের মানুষের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন।

বতুতার ভ্রমণ নিয়ে লেখা বই ‘ট্রাভেল অফ ইবনে বতুতা; ছবিসূত্রঃ Amazon.com
ইবনে বতুতার প্রকৃত নাম শেখ আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ, জন্ম ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে ইবনে বতুতা বাংলা ভ্রমণে আসেন। তার লেখা ভ্রমণকাহিনীর নাম ‘ট্র্যাভেল অব ইবনে বতুতা’। তার লেখায় তিনি প্রাচীন বাংলার চারটি স্থানের কথা উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো কামরূ (কামরূপ), হুবংক (হবিগঞ্জ), সুদকাও (চট্টগ্রাম), সুনুরকাও (সোনারগাঁও)। এছাড়াও কয়েকটি নদীর নাম তিনি তার লেখায় উল্লেখ করেছেন। যুন (যমুনা), গঙ্গা (পদ্মা), নহর উল আয্রুক (মেঘনা) নদীর অপার সৌন্দর্যে তিনি বিমুগ্ধ হয়েছেন। তার বর্ণনামতে তখন সুদকাও অঞ্চলটি জলা ও পাহাড়ে পরিপূর্ণ ছিল। সিলেট শহরে শেখ জালাল উদ্দিন তাবরিজি নামক এক দরবেশের সাথে দেখা হওয়ার কথা তিনি বর্ণনা করেছেন। অনুমান করা হয় যে এই দরবেশই হযরত শাহ জালাল (রহ)। এ দেশের জিনিসপত্রের অতি সস্তা মূল্য তাকে অভিভূত করেছিল। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের পাশাপাশি বন্যা, প্লাবন এবং অতিবৃষ্টির সময়ে এর ভয়ানক রূপও তিনি দেখেছেন। ১৩৬৯ সালে মরক্কোর ফেজ শহরে এই ভ্রমণপিপাসু মানুষটি মারা যান।

চীনের মুসলিম পর্যটক মা-হুয়ান; ছবিসূত্রঃ Indonesian Studies
আনুমানিক ১৪৩১ সালে চীনা পর্যটক মা-হুয়ান বাংলা ভ্রমণে আসেন। ধারণা করা হয় তিনি জন্মগতভাবে মুসলিম না হলেও পরবর্তী জীবনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার নামের প্রথমাংশে ‘মা’ পদবি থাকায় তার সম্পর্কে এই অনুমানটি করা হয়েছে। তার লেখা বই ‘Yingyai Shenglan’ বিশ্বব্যাপী মিং রাজবংশের সামুদ্রিক আবিষ্কার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রাথমিক উৎস বলে বিবেচনা করা হয়। ১৪৩১ সালে তিনি চট্টগ্রাম, সোনারগাঁও এবং কালিকট ভ্রমণ করেন। তার বর্ণনামতে সে সময়কার মেয়েরা প্রসাধন ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলো। চন্দনের গুঁড়া, জাফরান, মৃগনাভি ব্যবহার করতো তারা। ঠোঁটের রং হিসেবে মাখতো লাক্ষা গাছের রস। তখন প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। মাছরাঙ্গা পাখির রঙ-বেরঙের পালক দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। ফেরার পথে চীন দেশের রাজার জন্য কিছু পালক সাথে করে নিয়েও গিয়েছিলেন তিনি। সে সময়ে গাছের বাকল থেকে তৈরি হতো হরিণের চামড়ার চেয়েও মসৃণ কাগজ। সোনারগাঁয়ের টাকশালে তৈরি হতো টাকা।

চিত্রকরের তুলিতে মসলিন বুনছেন তাঁতি; ছবিসূত্রঃ কিশোরগঞ্জ ডট কম
বঙ্গের সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদের শাসনামলে চীনা পর্যটক ফেই-সিন বাংলা ভ্রমণে আসেন। এ দেশকে তিনি ‘পাংকোলা’ নামে অভিহিত করেছেন। গ্রামে-গঞ্জে তিনি একধরণের গানের আসর দেখেছেন যা শুরু হয় ঢিমেতালে, কিন্তু শেষ হয় উচ্চস্বরে। তার মতে তখন নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে কাপড় তৈরি ও চাষাবাদ করতো। মা-হুয়ান এবং ফেই-সিন ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

ইতালির পর্যটক নিকোলা মানুচ্চি
ছবিসূত্রঃ Alchetron
আনুমানিক ১৬৫৫ সালে ইতালীর নিকোলা মানুচ্চি বাংলায় এসেছিলেন। তিনি মুঘল রাজদরবারে দারাশিকোর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তখন ঢাকার সুবেদার ছিলেন মীর জুমলা। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ঢাকা আসতে তার সময় লেগেছিলো ৪০ দিন। ‘Storia do mogor’ তার লেখা ভ্রমণের বই।

মুঘল পোশাকে ফ্রান্সের টার্ভানিয়ার; ছবিসূত্রঃ InternetStones.com
এছাড়াও প্রাচীন বাংলায় আগত পর্যটকদের মাঝে ভূগোলবিদ টলেমী ও ডাইওনিসাস, পর্তুগালের দুয়ার্তে বারবোসা, ফ্রান্সের জহুরী টার্ভানিয়ার, ইংল্যান্ডের রালফ ফিচ, ইতালির সিজার ফ্রেডারিখের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। তারা এসেছেন এই সমৃদ্ধ বাংলায়। লিপিবদ্ধ করে গেছেন বাংলার সেই স্বর্ণযুগ, আভিজাত্য, উদার প্রকৃতি আর অতিথিপরায়ণ মানুষদের কথা। ঢাকাই মসলিন, কলাপাতায় মৌরলা মাছ, কবিগান, প্রাসাদ দ্বারে বাঁধা হাতি, বারো মাসের তের পার্বণের সেই সব গাঁথা আজকাল শুধু জাদুঘর, দীর্ঘশ্বাস আর বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ।