হোটেল শব্দটি আমরা মুখে যতই আওড়াই না কেন, হোটেল এর আভিধানিক বাংলা অর্থের প্রতি সব সময় এক ধরনের মমতা কাজ করে। পান্থশালা, উত্তরণশালা, পান্থাবাস, বড় সরাই এই সব শব্দের আবেদন আর হোটেল শব্দে কোথায়? পাশ্চাত্যের টানে আমরা গা ভাসিয়ে চলি ঠিকই, কিন্তু মাঝে মাঝে বাংলার স্বাদ যেন অন্য এক উন্মাদনা এনে দেয়।
সে যাই হোক, হোটেল শব্দটির সাথে ভোজনবিলাসের পারস্পরিক সম্পর্ক যেন চিরন্তন। আর একজন প্রকৃত ভোজন রসিক খুঁজে বেড়ায় নতুন নতুন স্বাদ-গন্ধের। ভোজন পিপাসু লোককে একই খাবার প্রতিদিন সাধা যেন শাস্তির সমান। খাবার স্বাদ যে শুধু নিত্য নতুন পদে নিহিত থাকে তাও নয়। চাই খাবার সাথে মানানসই পরিবেশ। তাই হোটেল মালিকগণও তাদের পসরা সাজায় বিভিন্ন বেশ ভূষণে। কোনোটা জঙ্গলের পরিবেশ, কোনোটা নদীর তলদেশ বা মহাশূন্য, সবই যেন স্থাপত্যশৈলীর নির্মাণ কৌশল, সাথে আছে ভোজনকারিদের রুচির সামঞ্জস্যতা। ‘চাইনিজ হোটেল এ গিয়ে তো আর ভর্তা ভাজি চাওয়া যায় না’।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে হরেক রকমের মজার মজার সব রেস্টুরেন্ট। এই সব হোটেল তৈরির পেছনে রয়েছে অনেক ধরনের চিন্তা ভাবনা আর মৌলিকতার ছোঁয়া। এসব হোটেলে খাওয়ার চাইতে যেন দেখানোর প্রাধান্য বেশি। আজকে আপনাদের সেই সব হোটেল গুলোর সাথে পরিচয় করে দিতে যাচ্ছি যার স্থাপত্যশৈলী আর পাঁচটা হোটেল এর চাইতে পৃথক।
রোবট রেস্টুরেন্ট, টোকিও, জাপান
রোবট শব্দটির সাথে জাপান যেন জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই জাপানের বিভিন্ন রোবট তৈরির গল্প কারও কাছে মনে হয় না অজানা। সেই বিচারে পুরো জাপানে রোবট নিয়ে কোন হোটেল থাকবে না এ যেন মানায় যায় না। আমাদের যেমন চিন্তা ঠিক তেমনি ভাবনা নিশ্চয়ই জাপানি উদ্যোক্তাদেরও ছিল। তাই না এমনতর হোটেল ঠাঁই পেল জাপানের টোকিও শহরে।
খাবার পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে এবার যে কোনও মানব-ওয়েটার বা হোটেলবয়ের মতো কথা বলবে ও অন্যান্য ফাইফরমাশও খাটবে রোবট। শুধু জাপানি ভাষায় নয়, বিশ্বের একাধিক ভাষায় কথা বলবে এই যন্ত্রমানব। জাপানের ‘হেম-না’ হোটেলে এমনই নয়া পরিষেবা চালু হয়েছে। এই হোটেল কাম রেস্টুরেন্টে ১০টি মানবাকৃতির রোবট থাকবে। যেগুলি হোটেলে আগত সকলের সঙ্গে কথা বলবে। হোটেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, আপাতত এই যন্ত্রমানবগুলো জাপানি, চাইনিজ, কোরিয়ান এই ভাষাযগুলোতে কথা বলবে। যন্ত্রমানব হোটেলে আগত অতিথির ব্যাগ বহন করা থেকে শুরু করে ঘর ঝাড়মোছ, খাবারদাবার পরিবেশন, সবই করবে৷ হোটেল কর্তৃপক্ষের দাবি, হোটেলের ৯০ শতাংশ কাজ করবে এই রোবটগুলি।
বরফের হোটেল, সুইডেন
বরফের হোটেল-নামটা শুনতেই কেমন যেন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব চলে আসে। তেমন একটা হোটেল এ আবার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, সত্যি ভাবা যায় না। ছয় হাজার বর্গ মিটারের বরফ হোটেলটি শান্তি আর শীতলতার আবেশ নিয়ে যেন অপেক্ষা করছে পর্যটকদের জন্য। এখানে বরফের বিছানায় এক রকম থারমাল স্লিপিং ব্যাগে ঘুমাতে হয়। জুকাসজার্ভির কিরুনা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। তবে ১২ বছরের ছোট শিশুদের থাকার জন্য হোটেলটি উপযুক্ত নয়। এখানে সপ্তাহ শেষে আপনার খরচ হবে এক হাজার ডলার। প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার মানুষ হোটেলটি ভাড়া নেন।
হোটেলের ভেতরে থাকে শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা, আর বাইরে শূণ্যের বহু নিচে, মাইনাস ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। বরফের তৈরি হোটেলটি নতুন নতুন নকশা অনুযায়ী প্রতি বছরই নতুন করে নির্মাণ করা হয়। মার্চ মাসে হোটেলের কাছেই তোরনে নদী থেকে ৫ হাজার টন বরফ সংগ্রহ করা হয় এবং গ্রীষ্মকালজুড়ে তা গুদামজাত করে রাখা হয়, যা দিয়ে পরে হোটেলটি গড়ে তোলা হয়। আর বসন্তকাল যখন সুইডেনে রাজত্ব করে, সে সময় হোটেলটি গলে মিশে যায়। এ বছর সর্বশেষ ডিজাইন অনুযায়ী হোটেলটির ১৯টি ঘরের নির্মাণ সম্পন্ন করা হয়। নতুন ডিজাইনের মধ্যে বরফে তৈরি প্রমাণ আকারের আফ্রিকান হাতি ছাড়াও আছে রুশ রাজকীয় থিয়েটারের অনুরূপ ব্যবস্থা।
ট্রি হোটেল, সুইডেন
গাছের উপর বাড়ি বানিয়ে যারা থাকতে চান তাদের জন্য এই হোটেল একেবারে মোক্ষম। হোটেলের কাঠামো তৈরি হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তিতে হালকা অথচ মজবুত অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে। এর একটি কক্ষের নাম ‘ মিরর কিউব’। কারণ কক্ষটির বাইরের দেয়াল পুরোপুরি আয়নার আর ভেতরে সাজানো হয়েছে প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রতিবিম্ব দিয়ে। উড়ন্ত পাখিরা যেন হোটেলের আয়নায় বিভ্রান্ত হয়ে আহত না হয় তাই বিশেষ ধরনের আল্ট্রাভায়োলেট ফয়েল ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে প্রতি রাত ৫৫০ ডলার করে খরচ হয়। ভূমি হতে চার থেকে ছয় মিটার উঁচু বিশাল বনানীর ভেতর গাছের মধ্যে তৈরি হোটেলটি। এভাবে তৈরি বলেই নাম ট্রি হোটেল।
সুইডেনের উত্তরের শহর লুলিও থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে হরাডস গ্রাম। খুবই ছোট এ গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ছয়শ। অভিনব ট্রি হোটেল এই হরাডস গ্রামের বনানীতে অবস্থিত। হোটেল কক্ষ থেকে দু চোখ ভরে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত বনানী, পাহাড়ি উপত্যকায় লুলিও নদী, নদীর উত্তাল ঢেউয়ে উড়ন্ত মাছের সারি, দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া পাহাড়। প্রকৃতি ও নির্জনতা ট্রি হোটেলের বৈশিষ্ট্য।
ম্যাজিক মাউন্টেন হোটেল, চিলি
বনের ভেতরে এক রহস্যময় পাহাড়ে ঘেরা মনোরম পরিবেশে ম্যাজিক মাউন্টেন হোটেলটি পাতাগোনিয়ার ৩০ লাখ একর দীর্ঘ হুইলো হুইলো রিজার্ভে অবস্থিত। সৌন্দর্যে রূপকথার গল্পের মতো এ হোটেলের অবস্থান পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর ও অরক্ষিত একটি অঞ্চলে। হোটেলটি তৈরি করা হয়েছে পাহাড়ের মতো করে আর প্রবেশ করতে হয় রহস্যময় এক ব্রিজের ওপর দিয়ে। পাহাড়ের মতো দেখতে এ স্থাপত্য পাথর দিয়ে তৈরি, যাকে ঘিরে রেখেছে নানারকম লতা জাতীয় উদ্ভিদ। ওপর থেকে বেয়ে নামছে পানির ধারা। মনে হবে, এ যেন গহিন অরণ্যের ভেতরে আপনা আপনি মাথা তুলেছে।
পাঁচতলা হোটেলটিতে রয়েছে ১৩টি কক্ষ। এর মধ্যে আছে একটি বার ও একটি রেস্টুরেন্ট। বাইরে আছে হট টাব, যা গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি। এখানকার সমস্ত আসবাবপত্র এবং হোটেলের সাজসজ্জা এ এলাকা থেকে সংগৃহীত কাঁচামাল দিয়েই তৈরি। হোটেলটিকে ঘিরে আছে ঘন বন। পাহাড়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ঝর্ণা। চিলির এ হোটেলটি খুবই মানসম্পন্ন, আধুনিক। এর পরিবেশ আপনাকে প্রকৃতির গহীনে নিয়ে যাবে। প্রকৃতি আর প্রযুক্তির এ এক চমৎকার জাদুকরি মেলবন্ধন। এতে এক রাত থাকার খরচ পড়বে ১৫০ থেকে ২৬০ পাউন্ডের মতো।
লবণ হোটেল ‘প্যালেসিও দি সল’, বলিভিয়া
বলিভিয়ার রাজধানী লাপাজ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সালার দি উয়ুনি। এটি বিশ্বের বৃহত্তম সল্ট ফ্ল্যাট বা লবণের ভূমি। এখানেই রয়েছে ‘প্যালেসিও দি সল’ নামে লবণের হোটেল। প্যালেসিও দি সল অর্থ লবণের প্রাসাদ। প্রাসাদ না হলেও হোটেলটি লবণ দিয়েই তৈরি। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে সালার দি উয়ুনিতে নির্মিত হয় প্রথম লবণের হোটেল। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে ২০০২ সালে হোটেলটি ভেঙে ফেলতে হয়। এরপর ২০০৭ সালে পুনরায় আরেকটি লবণের হোটেল নির্মাণ করা হয়, যার নাম ‘প্যালেসিও দি সল’। ৩৫ সেন্টিমিটারের প্রায় এক মিলিয়ন লবণের ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয় হোটেলটি। হোটেলের মেঝে, দেয়াল, ছাদ, এমনকি আসবাবপত্রও লবণ দিয়ে তৈরি। এই লবণ হোটেল তৈরির ইতিহাসটাও হোটেলটির মতই বৈচিত্র্যপূর্ণ।
সালার দি উয়ুনি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় একটি স্থান। এখানে প্রচুর পর্যটক আসলেও বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেজন্য পর্যটকদের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটি হোটেল নির্মাণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সালার দি উয়ুনিতে হোটেল নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ছিল না। তখন বুদ্ধি করে এখানে লবণের প্রাচুর্য দিয়েই তৈরি করে ফেলা হলো একটি আস্ত হোটেল। এ হোটেলে এক রাত অবস্থানের জন্য গুনতে হবে ১৫০ ডলার। এখানে থাকার দুর্দান্ত অভিজ্ঞতার তুলনায় এর মুল্য অনেকটাই নগণ্য মনে হতে পারে।
ক্লিনিক রেস্টুরেন্ট, বাংলাদেশ
ব্যতিক্রমের ছোঁয়া এসেছে বাংলাদেশেও। বাইরের দেখেদেখি বাংলাদেশেও তৈরি হয়েছে থিম ভিত্তিক রেস্টুরেন্ট ‘ক্লিনিক রেস্টুরেন্ট’। এর একটি শাখা ধানমণ্ডি এবং অন্যটি রয়েছে যমুনা ফিউচার পার্কে। থিম ভিত্তিক হলেও এই হোটেলটি সম্বন্ধে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। হোটেলটির নামকরণের পাশাপাশি এর খাওয়ার পরিবেশনেও রয়েছে কিছুটা অমানবিক চিন্তাধারার ছাপ। দরজা দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়বে অ্যাপ্রন পরা জুনিয়র চিকিৎসক, যিনি আপনাকে হাসিমুখে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবেন। দেখবেন, দুই-তিনজন নার্স অপারেশন ট্রে হাতে নিয়ে ঘুরছেন। কেউ প্রেশার মেপে নিচ্ছেন, কেউ আবার রোগীর ওজন ঠিক আছে কি না দেখছেন। তবে আর দশটা ক্লিনিকে যেমন খাওয়া-দাওয়ায় বারণ থাকে, এখানে তেমন কোনো ঝামেলা নেই। নিজের ইচ্ছামতো পেটপূজা করে নিতে পারবেন।
কী, শুনে অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, ক্লিনিকে পেটপূজা! এখানে মেজারিং টিউব, টেস্ট টিউব, মেজারিং সিলিন্ডার, ক্লোনাক্যাল ফ্লাক্সে পানীয় দেওয়া হয়। কিডনি প্লেটে খাবার পরিবেশন করা হয়, ইনজেকশনে সস আর পানি দেওয়া হয় ভিগারে। বসার জন্য হাসপাতালের সিট ও হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো রেস্তোরাঁর লাইটিংয়ের জন্য অপারেশন থিয়েটারের লাইট ব্যবহার করা হয়েছে। মোটকথা, একটা ক্লিনিকে যা যা থাকে, সবই রয়েছে এই রেস্তোরাঁয়।
হোটেল শব্দটি শুনলেই আমাদের যতই না রঙ বেরঙের, বিভিন্ন স্বাদ গন্ধের কথায় মনে পড়ুক না কেন, পরিবেশ আর উপস্থাপনের ব্যতিক্রমের কারণেই এক একটি হোটেল এক এক ধরনের রূপ পায়। এসব হোটেলের চাহিদা এক এক জনের কাছে আলাদা। মাঝে মাঝে এই হোটেল গুলোও হয়ে ওঠে কোনো অঞ্চলের দর্শনীয় স্থান। তাই অনেক হোটেলে আবার এক বছর আগেই বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। তাহলেই ভেবে দেখুন পর্যটক বা বিভিন্ন শৌখিন মানুষের কাছে এইসব হোটেলের চাহিদা কেমন। মাঝে মাঝে মনে হয় পেট পুজাই যেন আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়, সাথে থাকতে হবে চোখেরও প্রশান্তি। সেই প্রাচীন কাল থেকেই এর ধারাবাহিকতা চলে আসছে। আগেরকার রাজা বাদশাহরাও বিভিন্ন ধরনের সরাইখানা স্থাপন করতেন যার ছিল বিভিন্ন ধরনের শৈল্পিক গুণ যা পরবর্তীতে দর্শনীয় স্থানে রূপ নেয়।