বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার ভাষ্যমতে,
“ভ্রমণ প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দেবে, তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে।”
আসলেই তা-ই। যেখানেই আপনি যান না কেন, সেই জায়গার অপরূপ সৌন্দর্য আপনাকে বাকরুদ্ধ করে দেবে, এবং ভ্রমণ শেষ হলেই সেই সৌন্দর্যের লীলা আপনি অপরকে শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। আমি আবার এক ধাপ এগিয়ে আছি। গল্প বলে নয়, বরঞ্চ গল্প লিখে বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই আমার ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। গত দুটি বছর করোনার জন্য ঘরের ভেতর একদম বন্দী জীবন কাটিয়েছি। ২২শে ডিসেম্বর পর্যন্ত টার্ম পরীক্ষা, ল্যাব, অ্যাসাইনমেন্ট ইত্যাদির জন্য পুরো পিষ্ট হয়ে গিয়েছিল জীবন। সেই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে একটু স্বস্তি পেতেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বেরিয়ে পড়ি বরগুনার উদ্দেশ্যে।
২৩শে ডিসেম্বর, ২০২১; আমাদের যাত্রা শুরু। বরগুনা যাওয়ার পথ হিসেবে বেছে নিই ঢাকা-টু-বরগুনা লঞ্চ। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা সদরঘাট টার্মিনাল থেকে সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের লঞ্চ ছাড়ার কথা। সদরঘাট এলাকা সম্পর্কে আপনাদের সবারই কম-বেশি পরিচিতি আছে। সকাল আর বিকাল কী পরিমাণ ব্যস্ত থাকে সেই এলাকা তা বলাই বাহুল্য। তাই সেখানে পৌঁছাতে হাতে ৩ ঘন্টা সময় রেখে আমি, আমার মা, ভাই ও কাজিনরা রওনা হলাম। পৌঁছার পর লঞ্চঘাট খুঁজে পেতে সময় লেগেছিল আরও ১০ মিনিট। লঞ্চের চোখধাঁধানো আলোয় রাতের অন্ধকার বোঝাই যাচ্ছিল না। দুটো কেবিন ভাড়া করেছিলাম আমরা, মোটামুটি আড়াইশো থেকে তিন হাজারের মধ্যে পেয়ে যাবেন। ভেতরে ছিমছাম আর পরিপাটি; একটি হোটেলে যা যা থাকে তার সবই পাবেন এখানে। লঞ্চ ছাড়ার পর কেবিন থেকে বেরোলাম আশেপাশের পরিবেশ দেখতে। শীতের হিম হাওয়া আমাদের মাথার চুল থেকে পা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল।
বরগুনার বেতাগিতে লঞ্চ থেকে নেমে সোজা মামার বাসা চলে যাই। পৌঁছাতে বেজে যায় রাত ৪টা। সকাল ১০টার দিকে চা-নাস্তা সেরে পুরো শহর দেখতে বেরিয়ে পড়ি। আমার বড় মামী পুরো শহরটা ঘুরিয়ে দেখান। দেখার মতো যা আছে তা হলো ডিসি হাউজ, সার্কিট হাউজ, ও বরগুনা নৌকা জাদুঘর- এটা ছিল আমাদের সর্বশেষ গন্তব্যস্থল।
এ জাদুঘরের তেমন নাকডাক না শুনলেও ঘুরতে আসা সার্থক হয়েছে। নৌকার আদলে বানানো বিল্ডিংয়ের ভেতরে মাত্র একটি রুম, আর সেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হরেক রকম নৌকার মডেল। বৌ-চোরা, বালাম, পাতিলা, পটল, ময়ূরপঙ্খী, রাফ্ট, কবিতী, মুরঙ্গা, এবং আরও কত সুন্দর সুন্দর নামধারী নৌকা যে দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিটা নৌকার নিচে এর উৎপত্তিস্থল, বৈশিষ্ট্য, প্রচলন খুব পরিপাটি করে উল্লেখ করা। এমন একটি জাদুঘর পর্যবেক্ষণ করে নৌকা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করলে সকলেরই ভালো লাগবে। তাছাড়া বাঙালি হিসেবে আমাদের কর্তব্যও।
পরদিন গাড়ি ভাড়া করে রওনা দেই পটুয়াখালীর ঐতিহ্য সাগরকন্যা কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে। বরগুনা-টু-কুয়াকাটা আনুমানিক ২ ঘন্টার পথ। আমতলী থেকে ২০ মিনিট ফেরি পার হয়ে সোজা ধূলাবিহীন রাস্তায় চলতে চলতে টুকটাক কথা হয় গাড়ির চালকের সাথে। সেই সূত্রে জানতে পারি- পথেই পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ক্যাম্পাস দেখার সিদ্ধান্ত নেই। শনিবার হওয়ায় ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীর আনাগোনা ছিল কম। পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম ও বড় ক্যাম্পাসটিতে পুকুর ও অনেক রকম ভাস্কর্য রয়েছে। এছাড়াও আছে দেয়ালচিত্র ও বিভিন্ন প্রশাসনিক ভবন। প্রায় ২০ মিনিট চক্কর দিয়ে আবার গাড়িতে উঠি কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে। এবার মধ্যে নেই কোনো যাত্রাবিরতি। দুপুর ৩টা বাজতে না বাজতেই হাজির হই কুয়াকাটায়। রাস্তায় একটু পর পর পোস্টার টাঙানো, যেগুলোয় সাগরকন্যা আমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল।
সমুদ্রের পানিতে নামলে কাপড়চোপড় ভিজবেই। তাই একটি হোটেল বুক করে সেখানে লাগেজ রেখে দুপুরের খাবার গ্রহণের জন্য হোটেল বাছাই করতে নেমে পড়ি। কুয়াকাটা বীচের দিকে যে রাস্তাটি গিয়েছে, তার দু’পাশে সারি ধরে রয়েছে ছাতার মতো অসংখ্য দোকান। প্রত্যেকটিতেই জমজমাট অবস্থা। আমরাও ঢুকে পড়লাম একটায়। মেনুতে পোলাও-মাংস যেমন ছিল, তেমনি ছিল বাঙালির চিরপরিচিত ভাত-ডাল-ভর্তা-মাছের সমাহার। এত বড় জার্নি করে সবার পেটেই চলছিল বিশালাকৃতির ট্রাক। তাই পেটপুরে খেয়ে খুব ভালো লাগছিল, মনে হচ্ছিল শরীরে শক্তি ফিরে পেয়েছি। হোটেল থেকে সী-বিচ দেখা যায়। আমরা প্রত্যেকে সাথে করে ১ জোড়া স্যান্ডেল নিয়ে এসেছিলাম যাতে বালুতে হাঁটতে অসুবিধা না হয়। কেডস পরলে অবশ্য বাড়তি জুতার দরকার নেই, হিল যারা পরেন তাদের জন্য এটি প্রযোজ্য।
আমি কক্সবাজার ও কুয়াকাটা দুটি সমুদ্রসৈকতেই গিয়েছি। তাই কুয়াকাটার সাথে প্রথমোল্লিখিতর তুলনা মনের অজান্তেই চলে আসে। সব সী-বিচেই পর্যটকদের জন্য পোড়া সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণীর ব্যবস্থা থাকে। তবে কুয়াকাটায় শুধু কাঁকড়া ও রূপচাঁদা পাওয়া যাবে। কক্সবাজারের মতো চিংড়ি ও কোরাল নেই। এছাড়া কাছেই রয়েছে বার্মিজ মার্কেট। ঝিনুক ও শামুক দিয়ে তৈরি মালা, চুড়ি, ব্রেসলেট এবং তেঁতুল ও বরইয়ের আচার মিলবে এখানে। দামাদামি করলে সুলভ মূল্যে কিছু সুন্দর জিনিস পাবেন। তবে কক্সবাজারের মতো এর পরিসর ততটা বৃহৎ নয়।
আমাদের পরবর্তী যাত্রা বরিশাল। বরগুনা-টু-বরিশাল মোটে ২.৩০ থেকে ৩ ঘন্টার পথ। তবে যেতে মোটেও ক্লান্তি লাগেনি। দুপুরে এক আত্মীয়ের বাসায় আহার সেরে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখতে বের হই। দেখার মতো অনেক কিছু আছে এখানে। কমপক্ষে ২ দিন হাতে সময় না রাখলে সব দেখে শেষ করা যাবে না। কাছে যেতে চাইলে আছে দূর্গাসাগর ও গুঠিয়া মসজিদ। আরেকটু দূরে গেলে দেখতে পাবেন চাখারে শেরে বাংলার বাড়ি, বঙ্গবন্ধু উদ্যান, বিখ্যাত পেয়ারা বাজার ও আরও কত কী! পানিতে ভাসমান নৌকায় কীভাবে পেয়ারা বিক্রি হয় তা দেখার বড়ই ইচ্ছে ছিল, তবে আমাদের হাতে এত সময় ছিল না। তাই আমরা কাছের স্থানগুলো দেখার মাধ্যমে শরীর ও মন দুটোই সন্তুষ্ট করার সিদ্ধান্ত নেই। আপনারা যদি বরিশাল ভালোভাবে ভ্রমণ করতে চান, তবে অবশ্যই একটু সময় হাতে রাখবেন।
দূর্গাসাগর দক্ষিণ বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ হ্রদ। স্থানের নামানুযায়ী মাধবপাশা দীঘি নামেও পরিচিত। রানী দূর্গাবতী ১৭৮০ সালে এই দীঘি খনন করেন। সেসময় দিঘির চতুর্দিকে চারটি ঘাট থাকলেও বর্তমানে রয়েছে একটি। বাকিসব ঘাট অযত্নে-অবহেলায় জঙ্গল দিয়ে ঘেরাও। সাগরের পানিতে রাজহাঁস কেলি করে বেড়ায়। ছোট এলাকা নিয়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করে চিড়িয়াখানার মতো করা হয়েছে, যাতে আছে ইমু, ময়ূর, বানর, হরিণ এসব প্রাণী। দূর্গাসাগর পরিদর্শনে কোনো টিকেট লাগবে না, তবে গাড়ি নিয়ে গেলে পার্কিং চার্জটুকু দিতে হবে।
এরপর ১৫ মিনিটের রাস্তা পার করে চলে যাই বিখ্যাত গুঠিয়া মসজিদ (বর্তমানে পরিচিত বাইতুল আমান জামে মসজিদ নামে)। মসজিদটি রাতের আলোকসজ্জার জন্য সুপরিচিত। তবে এসেই শুনলাম যে বিগত ২ বছর যাবৎ নাকি মসজিদ কর্তৃপক্ষ এ আলোকসজ্জা বন্ধ করে দিয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল সবারই। তবে আলো ছাড়াও মসজিদটি দেখতে বেশ সুন্দর। আশেপাশে রয়েছে বৃহৎ নার্সারি, যাতে আছে অসংখ্য জানা-অজানা ফুল ও ফলের গাছ। চাইলে আপনি সেখান থেকে কিনে বাড়ি নিয়ে আসতে পারবেন। মসজিদ এলাকায় সুবিশাল হেলিপ্যাডও দেখার মতো।
এগুলো দেখতে দেখতে সাড়ে ৭টা বেজে গেল। বরগুনা ফিরতে দেরি হয়ে যাবে দেখে আমরা চাখারে শেরে বাংলার বাড়ি না দেখেই চলে আসি।
বরিশাল যাওয়া-আসার পথে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। ইচ্ছা হলে সেখানেও ঘুরে আসতে পারেন।
বরিশাল খুবই চমৎকার একটি শহর। এখানে দেখার মতো স্থানের সংখ্যাও অপ্রতুল নয়। তাই জীবনে একবার হলেও এখানে আসা ‘টু ডু’ লিস্টে থাকা উচিত। ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তি জ্ঞানে-গরিমায় কখনো দরিদ্র হয় না। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা আর অজানাকে জানার ব্যাকুল আগ্রহ মানুষকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। তাই সময়-সুযোগ পেলেই ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়া উচিত। ঢাকায় ফিরে নিজের ভ্রমণের গল্প অন্যকে শোনানোর আনন্দে মত্ত আমি আবারও বেরিয়ে পড়তে চাই কোনো এক অজানা শহর দেখতে, হারিয়ে যেতে চাই রহস্যের বেড়াজালে।