জাদুঘর মানেই হারিয়ে যাওয়া ব্যতিক্রমী সব জিনিসের সংগ্রহশালা। আর এই সংগ্রহশালা যদি হয় উদ্ভট ও আজব সবকিছুর সম্ভার, তাহলে সেসব নিয়ে জানার কৌতূহলটা বেড়ে যায় বহুগুণে। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক পৃথিবীর উদ্ভট কিছু জাদুঘরের গল্প।
১। মেগুরো প্যারাসাইটোলজিক্যাল মিউজিয়াম, টোকিও
জাপানের টোকিওতে এই জাদুঘরটি সাজানো হয়েছে নানান পরজীবী প্রাণী, জীবাণু ও কীটাণু দিয়ে। ১৯৫৩ সালে ডক্টর সাতোরু কামেগাই নামে একজন কীটতত্ত্ববিদ অনেকটা শখের বশেই এটি চালু করেন। এখানে ৬০,০০০ এরও বেশি পরজীবী প্রাণী এবং এ বিষয়ক ৫০,০০০ বই রয়েছে। বিভিন্ন রকমের পোকা-মাকড়, কেঁচো, নানাজাতের সূক্ষ্ম কৃমি, ছারপোকা, মশা, উঁকুন ছাড়াও এখানে রয়েছে নাম না জানা অনেক কীট।
২। অ্যাভানোস হেয়ার মিউজিয়াম, তুরস্ক
তুরস্কের মফস্বল শহরের এই জাদুঘরটি হলো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সর্বমোট ১৬,০০০ নারীদের চুলের সংগ্রহশালা। অ্যাভানোসের দক্ষ কুমার চে গালিপ তার স্টুডিওর নিচে এই জাদুঘর তৈরি করেছেন। বছরে দু’বার জুন ও ডিসেম্বর মাসে যিনি প্রথম গালিপের জাদুঘরে আসেন তাকে ১০ জন বিজয়ী ঘোষণা করার জন্য নিমন্ত্রণ জানানো হয়। বিজয়ীদের পুরস্কার হিসেবে ক্যাপাডোশাতে এক সপ্তাহের সকল খরচ বহন সহ ফ্রীতে গালিপের ওয়ার্কশপ করার সুযোগ দেওয়া হয়।
৩। দ্য মিউজিয়াম অব ব্যাড আর্ট, ব্রুকলিন অ্যান্ড সামারভিল, ম্যাসাচুসেটস
১৯৯৩ সালে বোস্টনে বাজে, কুরুচিপূর্ণ ও দৃষ্টিকটু সব ছবি নিয়ে শুরু হয় এই জাদুঘরের পথচলা। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই বাস্তব! অর্থাৎ যার ছবি যত বাজে হবে তার, ছবিই ঠাঁই পাবে এই জাদুঘরটিতে। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়াই হয়েছে সবার মাঝে আত্মবিশ্বাস আনার জন্য। এছাড়াও তাদের সামর্থ্য সম্পর্কে তাদের অবহিত করে হীনমন্যতা কমিয়ে তাদের উৎসাহিত করাও এই জাদুঘরের কর্তৃপক্ষদের উদ্দেশ্য।
৪। মিউজিয়াম অব মেডিয়েভাল টর্চার ইনস্ট্রুমেন্টস, অ্যামস্টারডেম
নেদারল্যান্ডস এর এই আজব জাদুঘরে দেখতে পাবেন কীভাবে মধ্যযুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়টাতে অত্যাচার চালাতো। এখানে সাজানো আছে একশোরও বেশি নির্যাতন পদ্ধতি এবং যন্ত্র। এসব দিয়ে সে যুগে শোষকরা শাসন করতো নিরীহ মানুষদের। অত্যাচারের সেকেলে ও হাতুড়ে এসব প্রক্রিয়া নিজ চোখে দেখতে চাইলে ঘুরে আসুন বিচিত্র এই জাদুঘরটিতে।
৫। মোমোফুকু আন্দো ইনস্ট্যান্ট রামেন মিউজিয়াম, জাপান
জাপানের ওসাকায় দেখে আসতে পারেন রামেন নুডলস্ এর এই জাদুঘর। এটি এক ধরনের কাপ নুডলস্। আর এই কাপ নুডলস্ আবিষ্কার করেন মোমোফুকু আন্দো। আবিষ্কারক রামেন ও তার কাপ নুডুলস্ এর সৃষ্টিকে সম্মান জানানোর জন্যই মূলত এই জাদুঘরটি তৈরি করা হয়েছে। এখানে ঘুরতে আসা সবাই রামেন বানানোর কৌশল শিখতে পারে।
৬। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিপ্টোজুওলজি মিউজিয়াম, পোর্টল্যান্ড
যুক্তরাষ্ট্রের মেইন, পোর্টল্যান্ডে অবস্থিত এই অদ্ভুতুড়ে জাদুঘরটি। ‘ক্রিপ্টোজুওলজি’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো গুপ্ত প্রাণী নিয়ে গবেষণা করা। রূপকথা, কল্পকাহিনী বা সাহিত্যে আমরা যেসব প্রাণী দেখতে পাই বা জানতে পারি সেগুলোর কোনটিই বাস্তবে নেই। আর এই জাদুঘরটি কাজ করে যাচ্ছে এমনই সব প্রাণীদের নিয়ে। ক্রিপ্টোজুওলজি মিউজিয়ামটি মানুষের কল্পনা ও বাস্তবের এক অনন্য মেলবন্ধনের প্রতিফলন।
৭। সুলভ ইন্টারন্যাশনাল মিউজিয়াম অব টয়লেট, ইন্ডিয়া
টয়লেট দেখতে হাজারো মানুষের ভিড়। শুনতে নিশ্চয় আজব মনে হচ্ছে? আসলেই এমনটি হয় দিল্লির এই মিউজিয়ামে। আজগুবি এই জাদুঘরে গেলে দেখতে পাবেন টয়লেট নিয়ে সাড়ে চার হাজার বছরের সব ইতিহাস। এখানে রয়েছে সাধারণ থেকে শুরু করে কারুকার্যমণ্ডিত সব টয়লেট। এমনকি ভিক্টোরিয়ান টয়লেটও আছে! এখানে সবচাইতে আজব একটি টয়লেট আছে যেটা আসলে একটা বুক কেস। টয়লেটটি লুকিয়ে আছে বইয়ের তাকে এবং ব্যাপারটি সত্যিই বিস্ময়কর!
৮। দ্য মিউজিয়াম অব ব্রোকেন রিলেশনশিপ, ক্রোয়েশিয়া
দুই ক্রোয়েশিয়ান ওলিনকা ভিটিকা ও ড্রাফেন গ্রুবিটিক আনুমানিক ২০০৬ সালের দিকে এই জাদুঘর তৈরির পরিকল্পনা করেন। একটি সম্পর্কে থাকে ভালো লাগার মতো ছোট-বড় অনেক কিছু। আর সম্পর্কগুলো ভেঙে গেলেই সেগুলো হয়ে যায় শুধুই স্মৃতি। ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের এসব স্মৃতি সংগ্রহের আগ্রহ প্রকাশ করেই তারা এ বিষয়ে আলোচনা করতে থাকেন আশেপাশের বন্ধুদের সাথে। আস্তে আস্তে সংগ্রহের পরিমাণ বাড়তে থাকায় ২০১০ সালের দিকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গড়ে তোলা হয় এই জাদুঘরটি। নানান রকম আর ধরনের বিভাগ ভেদে এখানে প্রায় কয়েক শ’ জিনিস স্থান পেয়েছে। সম্পর্কগুলোর ধরন ও মেয়াদের উপর ভিত্তি করেই এগুলো ভাগ করা হয়েছে।
৯। আপসাইড ডাউন মিউজিয়াম, মালয়েশিয়া
২০১৫ সালের ৮ই আগস্ট তৈরি হওয়া মালয়েশিয়ার পেনাং-এর এই জাদুঘরটিতে রয়েছে একেবারে ভিন্ন ধরনের চমক। একটি ফ্ল্যাটের কয়েকটি রুম নিয়ে সাজানো এই জাদুঘরটিতে সবকিছুই উল্টা। অর্থাৎ আপনি যখন একটি রুমের ভেতর হাঁটবেন মনে হবে যে আপনি সেই রুমটির ছাদে হাঁটছেন। রান্নাঘর, বাথরুম, শোবার ঘর, কাপড় ধোয়ার ঘর ও খাবার ঘর মিলে এই পুরো জাদুঘরটি। দেখতে ঘরের মতো হলেও এখানে রয়েছে ক্যাফে যেখানে আপনি চাইলে বসে রেস্ট নিতে পারবেন। এছাড়াও দোকান রয়েছে যেখানে কিছু জিনিসপত্র বিক্রি করা হয় এবং মজার ব্যাপার হলো এই জিনিসগুলোও উল্টো! এখানে যাওয়ার পর আপনার সাথে সাথে একজন স্টাফ থাকবে যে কিনা আপনাকে ছবি তুলে দিবে। আর এখানে এসে তো ছবি না তোলার তো প্রশ্নই আসে না, তাই না!
১০। সালিনা টার্ডা মিউজিয়াম, রোমানিয়া
মূলত এই জাদুঘরটি ছিলো একটি লবণের খনি। আর এই লবণের খনিই এখন হয়ে উঠেছে দর্শনার্থীদের পর্যটনকেন্দ্র। ১১-১৩ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই খনিটির খনন কাজ আরম্ভ হয়েছিলো। চাইলে এখানে আপনি উপভোগ করতে পারবেন আলো-আঁধারির এক রোমাঞ্চকর পরিবেশে নৌকাভ্রমণও। এছাড়াও এখানে গলফ্ খেলার সুবিধাও রয়েছে, তবে তা একদমই স্বল্প পরিসরে। পুরো জাদুঘরে কাঠের কাঠামোর সৌন্দর্য ও অপূর্ব আলোকসজ্জা আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে! এই জাদুঘরের আশ্চর্য একটি বিষয় হলো এই যে, বিজ্ঞানীদের মতে এখানকার পরিবেশ স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী।
১১। কানকুন মেরিন পার্ক, মেক্সিকো
নামে পার্ক হলেও আসলে এটি একটি জাদুঘর। সমুদ্রপৃষ্ঠের ১০ মিটার নিচে ৪০০টি ভাস্কর্যে নানা মানুষের প্রতিমূর্তি নিয়ে সাজানো এই ভিন্ন জাদুঘরটি। মেক্সিকোর ক্যারিবিয়ান সমুদ্র সৈকতের কাছে এই ভাস্কর্যগুলো তৈরি করেছেন জেসন দ্য ক্লেয়ার্স টেইলর। তিনি যুক্তরাজ্যের একজন বিখ্যাত ভাস্কর। মূলত এই জাদুঘরটি ‘লাইফকাস্টস’ প্রকল্পের প্রতিচ্ছবি। আর এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো মাত্রাতিরিক্ত ভ্রমণকারীর সংখ্যা কমানো এবং নতুন করে বিলুপ্ত প্রায় প্রবাল-প্রাচীর গড়ে তোলা।
১২। মিউজিয়াম অব এন্ডিউরিং বিউটি, মালয়েশিয়া
প্রাচীনকালের বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কীভাবে মানুষেরা নিজেদের সাজাতো তা দেখতে পারবেন এই জাদুঘরে। মালোয়েশিয়ার মাল্লাকায় অবস্থিত এই জাদুঘরের প্রদর্শনীগুলো দেখে চমকে ওঠার মতো অবস্থাই হবে আপনার! কারণ খুবই অদ্ভুত ছিলো সেকেলে মানুষদের এই সাজগুলো। যেমন- বিভিন্ন নকশায় ট্যাটু করা, ঘাড় ও ঠোঁট মোটা করার জন্য গোল ডিস্ক ঢুকিয়ে রাখা, পা যেন বাড়তে না পাড়ে সেজন্য শক্ত করে বেঁধে রাখা!
১৩। মিনি বটল্ গ্যালারি, নরওয়ে
কখনো ভেবেছেন কি যে, বোতলও হতে পারে জাদুঘরে সাজিয়ে রাখার মতো জিনিস? নিশ্চয়ই ভাবেননি। তবে আপনার কাছে অবাস্তব মনে হলেও নরওয়ের ওসলো-তে অবস্থিত এই জাদুঘরের কর্তৃপক্ষ বাস্তবেই এমনটি করে বসেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হওয়া বোতলগুলো দেখতে পাবেন এখানে। এখানে আছে শ্যাম্পু, মদ, জ্যুস, দুধ, পানি, সস, নানান ধরনের সফট্ ড্রিংকস। আর আপনি চাইলেই এদের অজানা ইতিহাস জানতে পারবেন জাদুঘরটি ঘুরে।
সারা বিশ্বে এমন তাজ্জব করে দেওয়ার মতন জাদুঘরের সংখ্যা কিন্তু কম নয়! এখানে সেগুলোর মধ্য থেকে গুটিকয়েকই তুলে ধরা হলো মাত্র। জাদুঘর সম্পর্কে যদি আপনার ধারণা থাকে যে, এটি একেবারেই একঘেয়ে ও তেমন আকর্ষণীয় জায়গা নয়, তবে আশা করছি এই জাদুঘরগুলো সম্পর্কে জেনে আপনার ধারণাটা পাল্টে যাবে!