বাংলা নববর্ষ- দুই বাংলার সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব হলেও, বাংলাদেশে উদযাপিত অনুষ্ঠানটি বিশ্ব দরবারে বিশেষ মর্যাদা লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ জাঁকজমকের সাথেই নববর্ষ উদযাপিত হয়ে থাকে, দেশটির পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের নববর্ষ উদযাপনের ধারাটি বেশ ভিন্ন। আর তাই দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে এটি এক বিশেষ আকর্ষণ, যা দেশের পর্যটন শিল্পেও বেশ খানিকটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
সামাজিক গণমাধ্যমের মাধ্যমে পরিচালিত অসংখ্য ট্যুর অপারেটরদের কল্যাণে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে এই সময়ে বেশ কয়েকটি ট্রিপের আয়োজন হয়ে থাকে যেখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্রমণপ্রেমীরা আদিবাসীদের এই উৎসবে যোগ দেয়। অনেকেই ব্যক্তিগতভাবেও এসকল উৎসবে যোগ দেয়। তবে বিনা অনুমতিতে এই উৎসবের প্রতিটি অংশে যোগ দেওয়া সহজ নয়।
আদিবাসীদের এই জনপ্রিয় ও অত্যন্ত আকর্ষণীয় উৎসবের নাম বৈসাবি। এই বৈসাবি নামটি মূলত তিনটি ভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর তিনটি ভিন্ন পন্থায় উদযাপিত বাংলা নববর্ষের নাম থেকে তৈরি। পার্বত্য অঞ্চল তথা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের আদিবাসী গোষ্ঠী ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা এই বৈসাবি উৎসব উদযাপন করে থাকে। ত্রিপুরা গোষ্ঠীর ‘বৈসু’, মারমা গোষ্ঠীর ‘সাংগ্রাই’ ও চাকমা গোষ্ঠীর ‘বিজু’- এই তিনটি নাম থেকেই তৈরি হয়েছে ‘বৈসাবি’। তিন দিনব্যাপী এই উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। যদিও উৎসবটির উদযাপনে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিভিন্নতা রয়েছে, মূল উৎসবটি হলো জলকেলি বা পানি খেলা। মারমা গোষ্ঠীই মূলত এই উৎসবটি পালন করে যা ‘সাংগ্রাই’ নামে পরিচিত।
এই উৎসবটি সাধারণত এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখে তথা বৈশাখের প্রথম দিন উদযাপিত হয়ে থাকে। আদিবাসীরা একে অন্যের গায়ে পানি ছিটিয়ে এই উৎসবটি পালন করে। নারী ও পুরুষ উভয়ই এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে। দিনভর বিভিন্ন এলাকায় উৎসবকারীরা হঠাৎ করেই যে কারো গায়ে পানি ছিটিয়ে একজন অপরিচিত মানুষকেও উৎসবের অংশ করে নেয়। তবে কাছ থেকে উৎসবটি পর্যবেক্ষণ করতে চাইলে বা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে চাইলে আগে থেকে আয়োজক দলের কাছে অনুমতি নিয়ে যাওয়াই ভালো। এই জলকেলি উৎসব ছাড়াও মারমা গোষ্ঠী নববর্ষ উপলক্ষে নৌকাবাইচ ও মল্লযুদ্ধ বা কুস্তিসহ আরও বেশ কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
চাকমাদের অনুষ্ঠানটি আকর্ষণ ও জাঁকজমকের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বললে একেবারে বাড়িয়ে বলা হবে না। এটি পালিত হয়ে থাকে এপ্রিল মাসের ১২ তারিখে। ‘বিজু’ নামে পরিচিত এই উৎসবটি উদযাপনের মূল উপাদান হল বিভিন্ন ধরনের রঙ-বেরঙের ফুল। ফুলের বহুল ব্যবহারের কারণে এই উৎসবটি ‘ফুলবিজু’ নামেও পিরিচিত। দ্বিতীয় দিনের উৎসবটি ‘মূলবিজু’ এবং তৃতীয় দিনের উৎসবটি ‘গজ্জাপজ্জা দিন’ নামে পরিচিত।
এই ফুলবিজু উৎসবের দিন চাকমা আদিবাসীরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আকর্ষণীয় আদিবাসী পোশাক ও ফুলের গয়না পরে এবং বিভিন্নভাবে ফুল ব্যবহার করে নিজেদেরকে যথাসম্ভব সুসজ্জিত করে তোলে। তারা এইদিন নিজেদের ঘরবাড়িও ফুল দিয়ে আকর্ষণীয় করে সাজিয়ে তোলে। এরপরে ভোর থেকে কাপ্তাই লেকসহ বিভিন্ন পার্বত্য জলাশয়ে ফুল বিসর্জন, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও পূজা অর্চনা করে থাকে।
এই উৎসবটি সাংস্কৃতিক উৎসবের পাশাপাশি এক ধরনের ধর্মীয় উৎসবও বটে। এই উৎসবের মাধ্যমে চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষেরা ঈশ্বরের কাছে শান্তি ও মঙ্গল কামনা করে। এই দিনে তারা সপরিবারে এবং বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন সহ ফুল বিসর্জন উৎসবে যোগ দিয়ে থাকে। ভোর ছয়টা থেকে শুরু হওয়া পানিতে ফুল ভাসানোর এই রীতিটি সকাল দশটার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।
ফুলবিজু উৎসবটিতে অংশগ্রহণ করতে হলে বা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে হলে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট স্থানটি হল রাঙ্গামাটির রাজবাড়ি এলাকায় অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ উপাসনা কেন্দ্র, রাজবন বিহার। এই দিনের আরো একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো ‘পাজং’। এই পাজং উপলক্ষে আদিবাসীরা বেশ কয়েক পদ মুখরোচক খাবার তৈরি করে। এই পাজং গ্রহণকেও এক ধরনের প্রার্থনা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
ফুলবিজু উৎসব উদযাপনের পাশাপাশি রাজবন বিহার ঘুরে দেখাটা রীতিমতো একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন আদিবাসী রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। মহর্ষী অরহন্ত আর্যসাভাকা সাধনানন্দ মহাথেরা- প্রতিষ্ঠার সময়কাল থেকেই এই বিহারের সকল কার্যাবলী পরিচালনা করেছেন। এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশে তার অবদানের কারণে তাকে ‘বনভান্তে’ নামে অভিহিত করা হয়।
বনভান্তে শব্দের অর্থ ‘বনের সন্যাসী’। এই বিহারের প্রাঙ্গণে বার্মিজ স্থাপত্য শিল্পের আদলে তৈরি বেশ কিছু ভবন রয়েছে যেগুলো বৌদ্ধ মন্দির, সন্ন্যাসীদের বাসস্থান, খাবার ঘর ও উপাসনা করার হলঘর সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়াও মূল বিহার প্রাঙ্গণের বাইরেই রয়েছে সাত তলা বিশিষ্ট ‘সাত-স্বর্গ ভবন’। এই ভবনের প্রতিটি তলা একেকটি স্বর্গ নামে অভিহিত।
প্রতি বছর প্রায় ৫০-৭০ জন দেশি- বিদেশি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এই বিহার পরিদর্শনে ও এখানে উপাসনা করতে আসেন। সপরিবারে ভ্রমণের জন্যও এটি একেবারে আদর্শ স্থান। তবে বিনা অনুমতিতে কোনো বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ছবি তুলবেন না। উপাসনার কাজে ব্যাঘাত ঘটে এমন কোনো আচরণ থেকে বিরত থাকুন। পুরো রাজবন বিহার জুড়েই স্বাধীনভাবে বিচরণ করছে অসংখ্য বানর। এদের থেকে নিজেদের মালপত্র নিরাপদে রাখার পাশাপাশি এদেরকে কোনোরকমভাবে আহত করা থেকেও বিরত থাকুন।
ত্রিপুরা আদিবাসী গোষ্ঠী তাদের ‘বৈসু’ উৎসব উপলক্ষে মোটামুটি চাকমাদের বিজু উৎসবের মতোই আয়োজন করে থাকে। তারাও নতুন পোশাক পরে ফুল দিয়ে নিজেদের ঘরবাড়ি সাজিয়ে উৎসবটি উদযাপন করে। তবে এই গোষ্ঠীর উদযাপন প্রথার বিশেষত্ব এখানে যে, এই উৎসব উপলক্ষে ত্রিপুরা আদিবাসীরা গরু, ছাগল, মহিষ সহ তাদের সকল গবাদি পশুকে ঐদিন মুক্ত করে দেয় বা ছেড়ে দেয়। আর এই দিনে বাড়িতে আগত অতিথিদের তারা ঘরে তৈরি পিঠা ও পানীয় দ্বারা আপ্যায়ন করে থাকে।
তিনদিনব্যাপী বৈসাবি অনুষ্ঠানের কিছুদিন আগে থেকেই সারা দেশের বাঙ্গালিদের মতো পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী বাঙ্গালিরাও পোশাক ও অন্যান্য জিনিস কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সময় পার্বত্য এলাকা জুড়ে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। বিভিন্ন ক্লাব ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এই উৎসব উদযাপনের সমস্ত আয়োজন করে থাকে। আর পুলিশ সহ সকল নিরাপত্তা প্রদানকারী সংস্থাও একটু বেশি সতর্ক হয়ে ওঠে। বিভিন্ন গণমাধ্যম এই তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানকে জনসম্মুখে তুলে ধরার জন্য এই সময়ে পাবর্ত্য এলাকায় ভীড় জমায়।
বৈসাবি উৎসব উদযাপনের পাশাপাশি একই সময়ে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির মতো পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ স্থানগুলো ঘুরে আসা যায়। বিশেষ করে রাঙ্গামাটি শহর থেকে সরাসরি কাপ্তাই যাওয়ার জন্য তৈরি নতুন লিংক রোডে এই সময়ে একবার হলেও ঘুরে আসা উচিত। রাস্তার একপাশে চোখে পরবে কাপ্তাই লেকের বুকে শুষ্ক মৌসুমে জেগে ওঠা দ্বীপপুঞ্জ আর অন্যপাশে রয়েছে পাহাড়ের সারি যেগুলোর মাঝে মাঝে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট লেক।
বর্ষা মৌসুমের দৃশ্য অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। সিএনজিতে করে সহজেই এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব। এছাড়াও রয়েছে রাঙ্গামাটি শহরের আইকন ঝুলন্ত সেতু। আর অ্যাডভেঞ্চার সন্ধানকারীদের জন্য সুখবর এই যে, সন্ধ্যার পর এই রাস্তার একটি নির্দিষ্ট অংশ জুড়ে স্বাধীনভাবে বিচরণ করে বিভিন্ন বন্য প্রাণী যার মধ্যে বন্য হাতির পাল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
রাঙ্গামাটি শহর অত্যন্ত নিরাপদ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সদা সচেষ্ট রয়েছে। ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি ও অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলে সরাসরি যাতায়াতের জন্য বাস রয়েছে। চাইলে ট্রেনে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গিয়ে তারপরে বাসে করেও বিভিন্ন পার্বত্য অঞ্চলে বেশ সহজেই পৌঁছানো যায়।