‘বইয়ের শহর’ শব্দটা আপনার কাছে নতুন মনে হতে পারে, তবে এর অর্থটা আসলে আপনি যা ভাবছেন সেটাই। হ্যাঁ, বইয়ে পরিপূর্ণ যে শহর সেটাই আসলে ‘বইয়ের শহর’। যে শহরের অলিতে গলিতে বইয়ের দোকান। নতুন পুরাতন বইয়ের সমারোহ চারিদিকে। দিন-রাত হরদম সেসব শহরে ভিড় জমায় বইপ্রেমীরা। যে শহরে নেই যানবাহনের কোলাহল, নেই শহুরে ব্যস্ততা। শান্ত নীরবতার মাঝে যেখানে বই প্রেমীরা বই পড়ে কাটিয়ে দিতে পারেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস।
হ্যাঁ, এমন বর্ণনা শুনে হয়তো আপনার স্বর্গের কথাই মনে হতে পারে। কিন্তু না, স্বর্গ নয়। পৃথিবীতেই রয়েছে এমন কিছু বইয়ের শহর। উইকিপিডিয়ার এক হিসাব অনুসারে সমস্ত পৃথিবীতে মোট ৪০টি এমন বইয়ের শহর রয়েছে। চলুন আজকে জেনে নেওয়া যাক তাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় কয়েকটি বইয়ের শহর সম্পর্কে।
উরুয়েনা, স্পেন
মাদ্রিদ থেকে মাত্র দুই ঘন্টার দূরত্বে ক্যাস্টিলা ই লিওন অঞ্চলে অবস্থিত ছোট্ট সুন্দর এক শহর উরুয়েনা।
ছোট্ট এই শহরে মাত্র ২০০ জন অধিবাসীর বাস। এখানে রয়েছে মোট ১২টি বইয়ের দোকান। অর্থাৎ গড়ে ১৬ জনের বিপরীতে একটি করে বইয়ের দোকান। এই শহরটিই বিশ্বের প্রথম স্প্যানিশ ‘ভিলা ডেল লিব্রো’ বা বইয়ের নগরী।
উরুয়েনাকে সর্বপ্রথম একটি বইয়ের শহরে পরিণত করার পরিকল্পনা করেন ভাল্লাডোলিড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জর্জ ম্যানরিক। পরবর্তীতে এই শহর পরিষদ জর্জের পরিকল্পনাটি গ্রহণ করেন ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। বর্তমানে প্রতিদিনই দেশ-বিদেশের পর্যটক ও বইপ্রেমীরা ভিড় জমায় এখানে।
চমৎকার সুন্দর এই উরুয়েনার ১২টি বইয়ের দোকানের মধ্যে কয়েকটি দোকানে পুরানো বই বিক্রি হয়। এসব দোকানে দুর্লভ অনেক বইও পাওয়া যায়। প্রতিনিয়ত এই শহরে নানা বইয়ের প্রকাশনা, লেখক-পাঠকের সমাবেশ সহ নানা অনুষ্ঠান লেগেই থাকে।
বিচরেল, ফ্রান্স
আপনি যদি কখনো ফ্রান্সের ব্রিট্টনিতে যান আর আপনি যদি একজন বইপ্রেমী হয়ে থাকেন, তবে ঘুরে আসতে পারেন বিচরেলের চমৎকার সুন্দর এক বইয়ের শহর থেকে।
এই শহরটিতে প্রায় ৭০০ জনের মতো অধিবাসীর বাস। এখানে রয়েছে ১৫টি বইয়ের দোকান আর সেই সাথে কিছু আর্ট গ্যালারী ও বইয়ের ক্যাফে।
এই শহরের ইতিহাস কিন্তু অনেক পুরনো। দ্বাদশ শতাব্দীতে আলাইন ডি ডিনান যখন এখানে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন, তখন এ শহরের গোড়াপত্তন হয়। পরে ব্রিট্টনির সাংস্কৃতিক পরিষদের পরিচালক বার্নাড লে নেইল এই ছোট্ট শহরটিকে বইয়ের নগরীতে পরিণত করার পরিকল্পনা করেন।
প্রতিনিয়ত বই সম্পর্কিত নানা অনুষ্ঠান হয় এখানে। ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম এখানে বই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় এবং এর পর থেকে প্রতিবছর বসন্তে ও ইস্টারে এটি নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তাই ফ্রান্সের ব্রিট্টনিতে আসলে বইপ্রেমীরা এখানে ঢু মারতে ভুল করেন না।
হে-অন-ওয়ে, ওয়েলস
ওয়েলস-ইংলিশ সীমান্তে অবস্থিত ছবির মতো সুন্দর এক শহর হে-অন-ওয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় বইয়ের শহর এটি। এখানের চমৎকার সুন্দর খোলামেলা দুর্গের মতো বইয়ের দোকান ও নানা বইয়ের অনুষ্ঠানের জন্য বিখ্যাত এ শহরটি।
মাত্র ১,৬০০ অধিবাসীর এ শহরে রয়েছে অনেকগুলো বইয়ের দোকান। তবে দিন দিন এখানের বইয়ের দোকানের সংখ্যা কমছে। এদের মধ্যে কয়েকটি ইতিমধ্যে এন্টিক শপের রূপ নিয়েছে।
হে-অন-ওয়ে হলো পৃথিবীর সর্বপ্রথম ও সেই সাথে সবচেয়ে পুরনো বইয়ের নগরী। ১৯৬১ সালে রিচার্ড বুথ এই শহরকে বিশ্বের সর্বপ্রথম বইয়ের শহরে পরিণত করেন এবং সেই সাথে এর নামকরণ করেন।
প্রতিবছর মে ও জুন মাসে এখানে ‘হে সাহিত্য ও শিল্পকলা উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্য উৎসব এটি। ১৯৮৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এই উৎসবটির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তেই আছে। বর্তমানে ২,৫০,০০০ জনের বেশি দর্শক ও বইপ্রেমী অংশ নেন এই উৎসবে।
জিনবোচো, জাপান
জিনবোচো অন্যান্য শহরের মতো আলাদা একটি শহর নয়। এটি টোকিওর চিওডা অঞ্চলের একটি প্রতিবেশী এলাকা। জাপানের পুরানো ও দুর্লভ বইয়ের দোকানের সবচেয়ে বড় এলাকা এটি। তবে এখানে ইংরেজি বইয়েরও কিছু দোকান রয়েছে।
বর্তমানে প্রায় ১৭০টির বেশি নতুন পুরাতন বইয়ের দোকান ও প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান রয়েছে জিনবোচোতে। এদের বেশিরভাগই ইয়াশুকুনি ও হাকুশান সরণীর পাশে অবস্থিত।
১৯১৩ সালে অধ্যাপক শিগেও আইওয়ানামি সর্বপ্রথম এখানে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। এরপর ধীরে ধীরে এখানে নানা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও বইয়ের দোকান গড়ে উঠে। ১৯২০ সালের মধ্যেই এটি ছাত্রছাত্রী ও বইপ্রেমীদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বর্তমানে দিনের সব সময়ই বহু বইপ্রেমীর ভিড় লেগে থাকে এখানে।
সেইন্ট-পিয়ের-ডে-ক্লাজেস, সুইজারল্যান্ড
সুইস পর্বতমালার কেন্দ্রে সুইজারল্যান্ডের ফ্রেঞ্চ ভাষাভাষী অংশটি এক ছোট্ট সুন্দর শহরের অবস্থান। নাম তার সেইন্ট-পিয়ের-ডে-ক্লাজেস।
দৃষ্টিনন্দন এই শহরটি ১৯৯০ সালে প্রথম বইয়ের নগরী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে অনুষ্ঠিত বইয়ের উৎসবের জন্য বিখ্যাত এই শহরটি। প্রতিবছর আগস্টের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হওয়া এই উৎসবটি চলে আসছে ১৯৯৩ সাল থেকে। এই উৎসবে প্রায় ১০০টির মতো প্রদর্শনী স্টল ও ১৫,০০০ জনের মতো দর্শকের সমাগম ঘটে। নানা নতুন-পুরাতন বই সহ প্রকাশক, লেখকদের দেখা মেলে এখানে।
এই উৎসবটিই সেইন্ট-পিয়ের-ডে-ক্লাজেসের সবচেয়ে বড় উৎসব। তবে আপনি চাইলে বছরের যেকোনো সময়েই এখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন। প্রতি সপ্তাহের শনিবারে এখানে বসে সাহিত্য আসর। সুন্দর এই শহরের প্রধান চত্বরেই রয়েছে ১০টি বইয়ের দোকান। এখানে আপনি পাবেন নতুন প্রকাশিত নানা বইয়ের পাশাপাশি বহু পুরাতন দুর্লভ বই।
মান্ডাল, নরওয়ে
নরওয়ের জস্টেডালসব্রিন হিমবাহের কাছে মধ্য ফিয়ারল্যান্ডে অবস্থিত ছোট্ট বইয়ের শহর মান্ডাল। ১৯৯৫ সালে এটিকে ‘নরওয়ের বইয়ের শহর’ হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
সুন্দর এই শহরটিতে মাত্র ৩০০ অধিবাসীর বাস। এখানেই নরওয়ের সবচেয়ে সুন্দর বইয়ের দোকানগুলো অবস্থিত। এখানের নানা পরিত্যক্ত ভবনগুলোতে গড়ে উঠেছে চমৎকার সব বইয়ের দোকান। পরিত্যক্ত ফেরি ওয়েটিংরুম, মুদির দোকান, ব্যাংক, পোস্ট অফিস ইত্যাদি ভবনকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে বইয়ের দোকান।
প্রচুর বই রয়েছে এই শহরে। বলা হয়, মান্ডালের সমস্ত বইয়ের তাককে যদি এক করা হয় তবে সব মিলিয়ে তা ২.৫ মাইল লম্বা হবে। এখানের চমৎকার এই বইয়ের দোকানগুলো খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।
ওবিডোস, পর্তুগাল
এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত সবচেয়ে কমবয়সী বইয়ের শহর হলো ওবিডোস। তবে এই শহরের ইতিহাসের শুরু হয়েছে রোমান সময়কালে। এই শহরকে একটি বইয়ের নগরীতে রূপ দেওয়ার কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের দিকে। ওবিডোস সিটি হল ও লার ডেভাগার বুকস্টোর সর্বপ্রথম এ কাজ শুরু করে।
প্রতিবছর অক্টোবর মাসে এখানে অনুষ্ঠিত হয় ফোলিও আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব। সারা বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানা বইপ্রেমী এ উৎসবে যোগ দেন। এটাই পর্তুগালের সবচেয়ে বড় সাহিত্য উৎসব।
নতুন প্রতিষ্ঠিত ছোট্ট এই বইয়ের নগরীতে রয়েছে নানা বইয়ে ঠাসা প্রচুর বইয়ের দোকান। দৃষ্টিনন্দন এসব বইয়ের দোকানে প্রবেশ করলে আপনার আর বাইরের বেরোতে ইচ্ছা করবে না। এ কারণেই দিন দিন জনপ্রিয়তা বাড়ছে এ বইয়ের শহরের।
ফিচার ইমেজ – হে অন ওয়ের এক বই উৎসবে বই পড়ছেন এক বই প্রেমী; roughguides.com