উৎসব শব্দটা শুনলে অজান্তেই আমাদের মনের ভেতর একটা উদ্দীপনা কাজ করে। আমাদের মনটাই যেন উৎসবের জন্য সাজানো! পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা ধরনের জাতি, নিজেদের ঐতিহ্য আর ধর্মকে ফুটিয়ে তুলার জন্য পালন করে থাকে বর্ণিল সব উৎসব। এগুলো শুধুমাত্র তাদের ঐতিহ্যকেই তুলে ধরে না, তদের আভিজাত্য, চাকচিক্য আর সামাজিকতার পরিচয়ও তুলে ধরে। একটি জাতি সাংস্কৃতিক দিক থেকে কতটা উন্নত মানসিকতার অধিকারী, সেটা বুঝতে হলে তাদের উৎসবগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হয়। তাই চলুন, পরিচিত হয়ে আসি পৃথিবীর কতগুলো বৃহৎ উৎসবের সাথে, যেগুলো তাদের সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
বরফ দিয়ে বানানো প্রতিকৃতি উৎসব, চীন
বরফ ও তুষারপাত থেকে বানানো হয় বিভিন্ন আকৃতি, নকশা কিংবা দালান। চীনের হারবিনে প্রতি বছর ৫ জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এমন এক দারুণ উৎসবের আয়োজন করা হয়। বরফকে ঘিরে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উৎসব, যেখানে নকশা বানানো ছাড়াও বরফে স্কেটিং, এবং বরফাবৃত সাংহুয়া নদীতে সাঁতারের আয়োজন করা হয়। বরফ দিয়ে বানানো বিল্ডিংগুলোতে লাগানো হয় নানা রঙের বাতি, যার কারণে রাতেরবেলা জায়গাটি দেখতে স্বর্গীয় মনে হয়। ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতি বছর উৎসবটি বৃহৎভাবে আয়োজন করে আসছে চীন। শহরটির নিম্ন তাপমাত্রার প্রভাবে বছরের ওই সময়টাতে তুষারপাত হয় প্রচুর, যার কারণে প্রতি বছরের জানুয়ারি মাসে নানা প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা বেড়াতে আসেন এখানে।
লন্ঠন উৎসব, তাইওয়ান
তাইওয়ানবাসীর জন্য লন্ঠন উৎসবটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বছরের প্রথম পূর্ণিমা রাতে তারা আকাশে হাজার হাজার আলো ঝলমলে লন্ঠন উড়িয়ে দেয়! তাইওয়ানের পিংঝি শহরে ‘চাইনিজ জোডিয়াক’ এর আদলে পুরো আয়োজনটি সম্পন্ন হয়। আকারে বড় লন্ঠনগুলোতে ড্রাগন, ডাইনোসরসহ বিভিন্ন প্রাণীর ছবি অঙ্কিত থাকে। আর ছোট লন্ঠনগুলোর গায়ে তুলে ধরা হয় তাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে। এই আয়োজনকে ঘিরে তাই তৈরি হয় অসংখ্য মানুষের সমাবেশ, যারা পুরোটা সময় ধরে উপভোগ করতে থাকেন আলোর বর্ণিল খেলা! এছাড়া দর্শনার্থীরা চাইলে লন্ঠন বানানো এবং কিছু মজার প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
ভেনিস কার্নিভ্যাল, ইতালি
ইতালির সবচেয়ে বড় উৎসব হলো ভেনিস কার্নিভ্যাল। স্থানীয়রা একে ‘কার্নিভ্যাল ডি ভেনেজিয়া’ নামেও বলে থাকে। এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো মুখোশ পরিহিত মানুষ! উৎসবে যারা আসে প্রত্যেকেই বিভিন্ন ডিজাইন আর পছন্দের চরিত্রের মুখোশ পরে থাকে। ১১৬২ সালে সর্বপ্রথম এই উৎসবটি ইতালিতে শুরু হয়। পরবর্তীতে সপ্তদশ শতাব্দীতে অস্ট্রিয়ার শাসনামলে এই উৎসবটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এবং উনিশ শতকে এসে ভেনিস কার্নিভ্যাল আবার তার পুরনো রূপ ফিরে পায়।
উৎসবটি প্রায় সপ্তাহব্যাপী চলতে থাকে। মুখোশ পরিহিত অংশগ্রহণকারীরা একে অপরের দিকে ডিম ছুঁড়ে মারে! তাছাড়া কনসার্ট, মোমবাতি জ্বালিয়ে বোট প্যারেড এবং রাস্তায় বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন পারফর্মেন্স প্রদর্শনের কারণে উৎসবটি আরও উপভোগ্য হয়ে ওঠে সবার কাছে!
আন্তর্জাতিক বেলুন ফেস্টিভ্যাল, আমেরিকা
আমেরিকানদেন জন্য সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর ভেতর অন্যতম এই বেলুন ফেস্টিভ্যাল। আমেরিকার নিউ মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হওয়া এই উৎসবটি ১৯৭২ সাল থেকে চলছে। প্রতি বছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে অন্তত ৬০০ বেলুন ওড়ানো হয় নিউ মেক্সিকো’র আকাশে! ৯ দিনব্যাপী চলতে থাকা এই ফেস্টিভ্যালে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিযোগী এবং দর্শনার্থীরা আসেন এখানে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হট এয়ার বেলুন ওড়ানোর এই উৎসবটি
২০১১ সালে স্থান করে নেয় গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে। মজার ব্যাপার হলো, এখানে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীরা চাইলে বেলুন ওড়ানোর সময় নিজের দেশের পতাকা লাগাতে পারেন!
টমাটিনো উৎসব, স্পেন
প্রতি বছর অক্টোবরের শেষ বুধবার স্পেনের ‘বুনোল’ শহরের রাস্তা লাল টমেটোতে ভরে যায়! স্পেনের সবচেয়ে বড় উৎসব বলা যায় একে। উৎসবে আগত প্রতিযোগীরা একে অপরের দিকে টমেটো ছুঁড়ে মারেন। তবে অংশগ্রহণের জন্য কিছু নিয়ম পালন করতে হয় তাদের নিরাপত্তার জন্য। চোখে গগলস্ পরে পিষে ফেলা টমোটো ছুঁড়ে মারে সবাই। কয়েকশ টন টমেটো ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয় এবং প্রতিযোগীরা ইচ্ছেমতো নিজেদেরকে টমেটোতে মাখামাখি করে নিতে পারেন! এর সাথে সাথে ট্রাক থেকে পানি ছোঁড়া হয় কিছুক্ষণ পর পর। টমেটো উৎসবে টমেটো দিয়ে খেলা ছাড়াও রয়েছে নাচ, গান আর আগুন দিয়ে নানা কসরত!
হোলি, ইন্ডিয়া
পুরো ইন্ডিয়াজুড়ে বেশ জনপ্রিয় একটি উৎসব হলো ‘হোলি‘। একে রঙের উৎসবও বলা হয়, যেটি বসন্তের শুরুতে পালিত হয়। উৎসবটি যখন শুরু হয় তখন চারপাশে শুধু বিভিন্ন রঙের ধূলোর মেঘ উড়তে থাকে। একজন আরেকজনের পুরো শরীরে রঙ মেখে দেয়! এভাবেই পুরো পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে তারা। একটি পর্যায়ে এসে সবার শরীরে এত পরিমাণ রঙ মাখানো হয় যে, কাউকে আর চেনা যায় না। ইউরোপের অন্যান্য উদ্দাম আর খোলামেলা উৎসবের তুলনায় হোলি অনেকটাই সামাজিক। কারণ উৎসবটিতে ধর্মীয় একটি সংস্কার জড়িত। হোলি উৎসবটি খুব অল্প সময়ব্যাপী হয়ে থাকে, কিন্তু এটুকু সময়ই যথেষ্ট নাগরিক ব্যস্ততা আর ভেদাভেদ ভুলে একসাথে মিলিত হবার জন্য।
চীনা নববর্ষ, চীন
জানুয়ারির শেষ অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে শুরু হওয়া এই উৎসবে যেন বিভিন্ন রঙ আর নকশার ছড়াছড়ি! পুরো প্যারেডজুড়ে কেউই একই রঙ আর নকশা করা পোশাক দ্বিতীয়বার পরে না। পোশাক-পরিচ্ছদে লাল রঙের আধিক্য থাকলেও মোটামুটি সব রঙই ব্যবহার করে সবাই। চীনা পরিচ্ছদ শিল্পের নতুনত্ব সম্পর্কে জানতে হলে আপনিও এই উৎসবে যোগ দিতে পারেন! প্যারেডে অংশগ্রহণ করা মানুষের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। একদিক থেকে মানুষের সারি শুরু হলে সেটার শেষ খু্ঁজে পাওয়া অনেক মেহনতের ব্যাপার! আর ধীর পায়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো ধৈর্য্য আপনার থাকতে হবে!
রক ইন রিও, ব্রাজিল
পুরো দক্ষিণ আমেরিকায় বৃহত্তম এবং বিশ্বের সবচেয়ে বর্ণিল গানের উৎসবগুলোর ভেতর ‘রক ইন রিও‘ উৎসবটি সবচেয়ে বিখ্যাত! উৎসবটি চলাকালে ব্রাজিলের নানা প্রান্ত থেকে গানপাগল মানুষজন জড়ো হতে থাকে। নাচে-গানে মেতে উঠতে বিশ্বের অনেক দেশ থেকেও লোকসমাগম হয় এখানে। ২০১৫ সালে কেটি পেরি, রিহানা, মেটালিকা, এলটন জনদের মতো সঙ্গীত তারকারা গান শোনাতে আসেন এখানে। বছরঘুরে গানের উৎসবটি লিসবন, মাদ্রিদের মতো জায়গাগুলোতে চলতে থাকে! প্রতি দু’বছর পর রিওতে উৎসবটি পালিত হয়। ২০১৭ সালে ব্রাজিলের এই গানের উৎসবে প্রায় ৭ লাখ লোক জড়ো হয়েছিল। ২০১৯ সালে আবার উৎসবটি প্রাণ ফিরে পেতে যাচ্ছে!
মেভলানা উৎসব, তুরস্ক
গান এবং নাচের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভ করা যায়।
আজ থেকে প্রায় ৭৫০ বছর পূর্বে তৎকালীন পারস্যের সবচেয়ে বড় কবি, দার্শনিক এবং তাত্ত্বিক ছিলেন মেভলানা, যাকে পশ্চিমা বিশ্ব ‘সুফী রুমী’ হিসেবেই চেনে। আমেরিকার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া সৃষ্টিকর্মগুলোর ভেতর রুমীর নাম এখনো উপরের দিকেই থাকবে। তার প্রয়াণ দিবসে তুরস্কজুড়ে মেভলানা উৎসব পালিত হয়, যেখানে পবিত্র গানের তালে-তালে সবাই একধরনের বিশেষ পোশাক পরে নাচে যোগ দেয়। পুরো ব্যাপারটির মাঝেই একধরনের পবিত্রতা আর মনের প্রশান্তি ফুটে ওঠে। সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভে রুমীর শেখানো দর্শন আজও তারা ধারণ করে আছে।
বিশ্বব্যাপী কার্নিভ্যাল
পৃথিবীতে যত উৎসব পালিত হয় তাদের ভেতর ‘কার্নিভ্যাল’কে আলাদা একটা শ্রেণীতে ফেলতে হয়। আর ‘রিও কার্নিভ্যাল‘কে বলা হয় কার্নিভ্যাল উৎসবের স্বর্গ! লাখখানেক মানুষের মিলনমেলার এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো ‘সাম্বা নাচ’। তুলনামূলক খোলামেলা এই উৎসব বিশ্বব্যাপী এতটাই জনপ্রিয় যে, পৃথিবীর অনেক দেশেই কার্নিভ্যাল একটি জনপ্রিয় উৎসব। দেশভেদে তাদের নাম আর পালনের পদ্ধতিতেও ভিন্নতা তৈরি হয়। তাই অনেকগুলো উৎসবের ভিড়ে কার্নিভ্যাল সবার কাছে অবশ্যই বিশেষ কিছু।