![](https://assets.roar.media/Bangla/2017/04/Banknote-Featured.jpg?w=1200)
ব্যাংকনোট, বিল, পেপারবিল বা এক কথায় নোট যা-ই বলা হোক না কেন, জিনিসটা ছাড়া যে আধুনিক সমাজে এক পা-ও নড়া যায় না তা বলাই বাহুল্য। আজ থেকে তেরশ বছর আগে চীনে প্রথম কাগজের নোটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তারপর মার্কো পোলোর হাত ধরে চীন থেকে প্রথমে ইউরোপ, তারপর গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাংকনোটের এই বিশাল ইতিহাসের ফাঁকফোকরে অদ্ভুত কিছু গল্প লুকিয়ে থাকা বিচিত্র নয়। আর অদ্ভুত, বিচিত্র, আজগুবি সেই গল্পগুলোই তুলে ধরা হলো আজকের এই লেখায়।
প্রাচীনতম নোট
সপ্তম শতাব্দীতে প্রথম ব্যাংকনোট তৈরি হলেও সাধারণ সমাজে এর প্রচলন শুরু হয় দশম শতাব্দীতে, সং রাজবংশের হাত ধরে। সিচুয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী চেংডুতে ব্যবহার শুরু হয় ‘জিয়াওজি’ নামের এই ব্যাংকনোটের। নিউমিজম্যাটিস্টরা (মুদ্রা বিশেষজ্ঞ) এই নোটকেই প্রথম ব্যাংকনোট হিসেবে ঘোষণা করেন। নকল হবার ভয়ে এই নোটের উপর প্রচুর ছিলছাপ্পড় দেওয়া হত।
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-1.jpg)
চীনের প্রাচীনতম নোট
সর্ববৃহৎ নোট
একটি নোট আর কতই বা বড় হতে পারে? আট-নয় ইঞ্চিই তো ধরার জন্য বেশ বড়। কিন্তু ফিলিপাইনের ১ লক্ষ পেসোর ব্যাংকনোটটি আসলেই ছিল চমকপ্রদ। লিগ্যাল সাইজের কাগজ দিয়ে বানানো সাড়ে আট বাই চৌদ্দ ইঞ্চির বিশাল এই নোটই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নোট। কিন্তু নোটটি সাধারণ ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়নি। ফিলিপাইনের স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শুধুমাত্র সংগ্রাহকদের জন্যাই বিশেষভাবে বানানো হয়েছিল। আর সংগ্রাহকদেরও এটি হাতে পেতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি, ১ লক্ষ পেসোর নোট পেতে খরচ করতে হয়েছিল ১ লক্ষ ৮০ হাজার পেসো যা প্রায় ৩ লক্ষ টাকার সমান!
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-2.jpg)
ফিলিপানের লিগ্যাল সাইজের নোট
বড় অঙ্কের নোট
আপনি কত বড় অঙ্কের নোট ধরেছেন? বাংলাদেশ ব্যাংকের ১,০০০ টাকার নোটই হয়ত আপনার ধরা সবচেয়ে বড় অঙ্কের নোট। ইউএস ট্রেজারির ৫,০০০ ডলারের নোটের ছবিও দেখে থাকতে পারেন। জিম্বাবুয়ের মুদ্রাস্ফীতির ঘটনায় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের নোটের গল্পও শুনে থাকতে পারেন। গল্পটার মধ্যেও ভুল কিছু নেই। ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ে মুদ্রাস্ফীতির রেকর্ড গড়েছিল। শেষমেশ জিম্বাবুইয়ান রিজার্ভ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয় ১০০ ট্রিলিয়ন জিম্বাবুইয়ান ডলারের ব্যাংক নোট বের করার! আবার বলি, ১০০ ট্রিলিয়ন! তার মানে ১ এর পর ১৪টা শুন্য!
কিন্তু এই বিশাল অঙ্কের নোট পেয়ে আপনি বাংলাদেশের কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখলে তা ভুল হবে, বাংলাদেশে নোটটি পরিবর্তন করলে আপনি চব্বিশ হাজার টাকার সামান্য বেশি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন! অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই, জিম্বাবুয়েতে ৩০০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে বাজারে গেলে আপনি বড়জোর এক টুকরো পাউরুটি কিনতে পারবেন! মাত্র চার মাস সাধারণ মানুষের কাছে থাকা এই নোটটি সংগ্রহ করতে চাইলে আপনাকে কিনতে হবে অনলাইনে, সেটাও বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে।
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-3.jpg)
জিম্বাবুইয়ান ১০০ ট্রিলিয়ন নোট
জিম্বাবুয়ের পাউরুটি খেয়ে আপনি হয়ত ভেবে বসে আছেন ১০০ ট্রিলিয়নই সবচেয়ে বড় ব্যাংকনোট। কিন্তু এরও ২০ বছর আগে পূর্ব ইউরোপের তৎকালীন প্রাণকেন্দ্র যুগোস্লাভিয়ায় আরও ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছিল। ১৯৮৯ থেকে শুরু হয়ে ১৯৯৪ সালে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা হওয়ার আগ পর্যন্ত যুগোস্লাভিয়ায় ৫০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ এর মতো বড় নোটের প্রচলন ছিল! গোণার দরকার নেই, ৫ এর পর ২০টা শুন্য! এটিই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঙ্কের ব্যাংকনোট!
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-4.jpg)
যুগোস্লাভিয়ান ৫০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ নোট
বড় অঙ্কের কথা যখন আসলো, তখন আরও একটা গল্প শোনা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই হাঙ্গেরিতে মুদ্রাস্ফীতির কারণে বেশ চাপে পড়তে হয়। যুগোস্লাভিয়ার মতো হাঙ্গেরিয়ান পেঙ্গো নোটেও ২০টা শুন্য, তবে তার আগে ৫ এর বদলে ১। কিন্তু যুগোস্লাভিয়ার তুলনায় এর মুদ্রামান বেশ কম ছিল, বাংলাদেশী টাকায় বড়জোর ১৬ টাকা ফেরত পেতে পারেন!
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-5.jpg)
হাঙ্গেরিয়ান ১ মিলিয়ার্ড পেঙ্গো!
ইমারজেন্সি মানি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই জার্মানিতে নিকেল, তামাসহ অন্যান্য ধাতু যুদ্ধে ব্যবহৃত গুলি বানানোর কাজে বাজার থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। ফলে হঠাৎ করেই ব্যবসা-বাণিজ্য করা বা পয়সার আদান-প্রদান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন বেসরকারী কোম্পানি ইমারজেন্সি মানি/নটজেল্ড প্রিন্ট দেওয়া শুরু করে।
প্রাথমিকভাবে একেবারে সাদা কাগজ, কাঠ, সিরামিক এমনকি চামড়ার উপরেও ২৫, ৫০, ১০০ ফেনিখ (Pfennig – জার্মান পয়সা) লিখে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হত। পরবর্তীতে বিভিন্ন লোকগাথা, রাজনৈতিক বাক্য, এমনকি তাসের ছবিও রঙিন অক্ষরে ছাপানো শুরু হয়। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সংগ্রাহকদের কাছে নটজেল্ডগুলো খুবই আকর্ষণীয় হওয়ার কারণে ব্যাংক শুধুমাত্র সংগ্রহের জন্যই নোটগুলো ইস্যু করা শুরু করে। কিন্তু কিছুদিন পরেই ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির কারণেই সংগ্রাহকরা তা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। অবশেষে ১৯২৩ সালে রাইখসব্যাংক নতুন মুদ্রা ‘রেনটেনমার্ক’-এর প্রচলন শুরু করলে নটজেল্ড আমলের অবসান ঘটে।
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-6.jpg)
জার্মান লোকসংস্কৃতির ছবি ফুটিয়ে তোলা ৫০ ফেনিখ ইমারজেন্সি মানি
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নোট
থেরেসিয়েনস্টাডট – চেকোস্লোভাকিয়ার থেরেসিয়েনস্টাডট কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প মূলত ছিল নাৎসিদের শো-পিস ক্যাম্প। নাৎসিরা রেড ক্রসকে ধোকা দেওয়ার জন্য এই ক্যাম্পে বাচ্চাদের জন্য স্কুল খোলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করাসহ বিভিন্ন কিছুর উদ্যোগ নয়। মূলত এই ক্যাম্পে কমপক্ষে ৩০ হাজার লোক মারা যায় এবং প্রচুর লোককে আরও পূর্বের এক্সটারমিনেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মেরে ফেলার জন্য। ঠিক এই কারণেই অর্থাৎ রেড ক্রস এজেন্টদের বোকা বানানোর জন্য এই নোটগুলো বানানো হয় যা কখনোই ব্যবহারই করা হয়নি।
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-8.jpg)
থেরেসিয়েনস্টাডট কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অব্যবহৃত নোট
ওরানিয়েনবার্গ – বার্লিনের ঠিক বাইরেই অবস্থিত ওরানিয়েনবার্গ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদীদের ধরে নিয়ে আসার পর তাদের কেনাবেচার জন্য কোনোরকমভাবে দোমড়ানো-মোচড়ানো ছেড়া-ফাটা নোট বানানো শুরু হয়। যদিও এসব নোট কোনো কাজেই লাগত না, জেলখানার মতো পরাধীন থাকা অবস্থায় নোটের আর কী-ইবা দরকার? পরবর্তীতে এক ধনী ব্যাংকার তার একটি কাঠের কারখানা সরকারী কাজে দান করে দেন। সেই কাঠের কারখানায় নোট বানানোর কাজে দায়িত্ব দেওয়া হয় নাৎসিবিরোধী হর্স্ট লিপার্ট নামের এক ছবি আঁকিয়েকে।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ভিতরে চলা অমানবিক কাজকর্মের খবর বাইরের মানুষের কাছে পাঠানোর জন্য লিপার্ট সাহায্য নেন তার নোটের ছবিকে। তারকাটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নাৎসি সৈন্যর ছবি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন সৈন্যদের অত্যাচারের কথা। আর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের জার্মান শব্দ Konzentrationslager –এর শেষ g কে y এ পরিবর্তন করে দেন Konzentrationslayer, যার অর্থ কনসেন্ট্রেশন খুনী। নাৎসি সৈন্যরা লিপার্টের এই গোপন বার্তা ধরতে পারেনি এবং তার ডিজাইন করা এই নোটগুলো নাৎসিদের বেশিরভাগ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আদান-প্রদান শুরু হয়। যুদ্ধ শেষে লিপার্ট নাৎসিদের হাত থেকে মুক্ত হন এবং তার গল্পগুলো বলার সুযোগ পান।
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-7.jpg)
ওরানিয়েনবার্গ ক্যাম্পের লিপার্টের নকশা করা নোট
মোবুটু নোট
বেলজিয়ামের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করার কিছুদিনের মধ্যেই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে খণিজ সম্পদ সমৃদ্ধ জায়ার। জনগণের ভোটে বিজয়ী লুমুম্বাকে অপসারণ এবং খুন করার পিছনে থাকা প্রধান ব্যক্তি জোসেফ মোবুটুকেই সিআইএ জায়ারের শাসনভার দেয়। মোবুটু ৩১ বছর জায়ারে স্বৈরশাসন চালানোর পর ১৯৯৭ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মরোক্কোতে পালিয়ে যাওয়ার পর জায়ারের মুদ্রায় পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকনোটের পরিমাণ অপ্রতুল থাকায় ২০,০০০ মুদ্রামানের নোটে মোবুটুর ছবি কেটে ফেলে তা দিয়েই বহুদিন কাজ চালানো হয়!
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-9.jpg)
মোবুটুর মুখের ছবি কেটে দেওয়া জায়ারের “২০,০০০” মুদ্রামানের নোট
আইনস্টাইন নোট
১৯৫২ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন আইনস্টাইনকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেন। আইনস্টাইন প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও তাকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে ১৯৬৮ সালে ইসরায়েলি মুদ্রার নতুন সংস্করণের ৫ লিরোতের নোটে তার ছবি যুক্ত করা হয়।
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-10.jpg)
ইসরাইলের ৫ লিরোত নোট
জর্জ বেস্ট নোট
একটা দেশের সবচেয়ে বড় তারকা যদি একজন ফুটবলার হয় তবেই এই জিনিসটা সম্ভব। ফুটবল কিংবদন্তী জর্জ বেস্টের মৃত্যুর এক বছর পর সে দেশের ব্যাংক ৫ পাউন্ডের নোটে স্মারক হিসেবে জর্জ বেস্টের ছবি যোগ করে। এক মিলিয়ন কপির সবকয়টি নোটই বের হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সংগ্রাহকদের হাতে চলে যায়।
ইন্টারগ্যালাকটিক কুইড
পৃথিবীর বাইরে যদি কখনো মানুষ যাত্রা শুরু করে, বসবাস শুরু করে, তাহলে টাকা-পয়সা কি ব্যবহার হবে? হলেও ঠিক কি দিয়ে হবে? এসব চিন্তাভাবনা থেকেই ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল স্পেস সেন্টার ছোট ছোট নার্ফ বল প্লাস্টিকের মধ্যে মুড়িয়ে তাকেই মহাকাশের মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা করে যার নাম দেওয়া হয় Quasi Universal Intergalactic Denomination (QUID)। নার্ফ বলগুলো সূর্য আর আটটি গ্রহকে প্রতিনিধিত্ব করে।
কেন এরকম বানানো হলো? কারণ মুদ্রাগুলোর ধারালো প্রান্ত মহাকাশযাত্রীদের জন্য বিপদজনক হতে পারে। আর ক্রেডিট/ডেবিট কার্ডের ম্যাগনেটিক স্ট্রিপগুলো মহাজাগতিক রশ্মির কারণে সহজেই নষ্ট হয়ে যাবে। টেফ্লন দিয়ে বানানো এই মহাকাশের মুদ্রাগুলোর প্রতিটির দাম সাড়ে বার ডলারের সমান।
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-12.jpg)
Quasi Universal Intergalactic Denomination (QUID)
সুন্দরতম নোট
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-13.jpg)
বারমুডার ২ ডলারের নোট; সামনের অংশে ব্লুবার্ডের ছবি এবং পিছনের অংশে নেপচুনের মূর্তি ও রয়্যাল নেভি ডকইয়ার্ডের ক্লক টাওয়ারের ছবি
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-14.jpg)
সামোয়ার ২০ তালা নোট; পিছনে জাতীয় পাখি মানুমিয়া ও জাতীয় ফুল টিউলিয়া এবং পিছনে ঝর্নার ছবি
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-15.jpg)
কাজাখস্তানের ১০০০০ তেঙ্গে নোট যার পিছনে রয়েছে স্নো লেপার্ডের ছবি
![](https://roar.media/bangla/wp-content/uploads/2017/04/Banknote-16.jpg)
দক্ষিণ আফ্রিকান র্যান্ড এবং সাফারির গল্প