গত সেপ্টেম্বরে লন্ডনের সরকারি পরিবহণ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান থেকে জায়ান্ট ট্যাক্সি সেবা দানকারী উবারের লাইসেন্স বাতিল করা হয়। লন্ডন শহরে উবার আর সেবা দিতে পারবে না- এমন একটি বক্তব্য এবং সিদ্ধান্ত লন্ডন কর্তৃপক্ষ থেকে দেয়া হয়। তাদের এমন সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে দেখানো হয় যে, শহরের সাধারণ মানুষের চলাফেরার নিরাপত্তার স্বার্থে এবং উবার চালকদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রবণতার অভিযোগ পাওয়ার কারণে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। উবারের জন্য সংবাদটি হজম করা কঠিন। কারণ তারা ইউরোপের যে ৬০০টি শহরে তদের ট্যাক্সি সেবা দিচ্ছে, তাদের মধ্যে লাভের বাজারে লন্ডনে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল। উবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ লভ্যাংশ আসতো লন্ডন থেকে। কিন্তু সরকারি পর্যায় থেকে এমন সিদ্ধান্তের ফলে যে তাদের ব্যবসায় একটি বড় ধাক্কা আসবে, সেটা নিশ্চিত ধরাই যায়।
তবে গত জুন মাসে লন্ডনের একটি আদালত ১৫ মাসের জন্য উবারের লাইসেন্স নবায়ন করেছে। উবার এর আগে তাদের লাইসেন্স রদ করার পরে নিজেদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করে এবং সেগুলো থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়, তা নিয়ে একটি রিপোর্ট আদালতের কাছে দেয়। এরপর আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, উবারের সেবাদানের ভিতর কিছু ভুল-ভ্রান্তি ছিল, যেগুলো তারা ধরতে পেরেছে এবং সেই সমস্যাগুলো সমাধান করে তারা এখন কাজ করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। আদালত তাদেরকে ১৫ মাসের জন্য সাময়িক অনুমতি দিচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে তারা নজরদারিতে থাকবে। তাদের যাত্রীসেবা দেয়ার প্রক্রিয়ার উপর এবং তাদের নিয়োগকৃত চালকদের উপর নজর রাখা হবে। যদি তাদের সেবা প্রক্রিয়ায় উন্নতি লক্ষ করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের অনুমতিপত্র নবায়ন করা হতে পারে। উবার কর্তৃপক্ষ থেকেও আশ্বাস পাওয়া গিয়েছে যে তারা তাদের আগের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করবে; এমনকি যাত্রী ও চালকদের মধ্যে সরাসরি হটলাইন সেবার ব্যবস্থাও করবে তারা।
উবার অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের বিশ্বস্ততা হারিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ- যেমন: বাংলাদেশে তাদের বিশ্বস্ততা নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোন প্রশ্ন ওঠেনি, কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে তাদের বিশ্বস্ততা নিয়ে সরকারি পর্যায় থেকে সন্দেহ করা হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের সাথে তাদের সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে এবং আইনত বিভিন্ন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। লন্ডনেই তাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ উঠেছে যে তারা এমন একটি সফটওয়ার তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে তাদের কার্যকলাপের উপর সরকার, আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এবং নিযুক্ত মন্ত্রণালয় নজর রাখতে পারবে না, উবার যতটুকু তথ্য প্রকাশ করতে ইচ্ছুক হবে, ঠিক ততটুকুই প্রকাশিত হবে। আরেকটি বড় অভিযোগ যে কারণে তাদের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি, তা হচ্ছে যাত্রীরা যখন চালক কর্তৃক আক্রান্ত হয় তখন উবার এই অভিযোগ সময়মতো গ্রহণ করে না। যাত্রীসেবা থেকে তারা নিজেদের অর্থালাভের প্রতি বেশী নিবেদিত। যে কারণে পরিসংখ্যান অনুযায়ী আস্তে আস্তে উবারের প্রতি মানুষের আস্থা একটু হলেও কমেছে। পুনরায় আস্থা অর্জন করার জন্য উবারকে যথেষ্ট কাঠখড় পোহাতে হতে পারে।
দারা খসরুশাহী, উবারের নতুন প্রধান নির্বাহী এখন উবারের প্রতি মানুষের আগের আস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য কাজ করছেন। উবারের বাজার কৌশল দেখলে মনে হচ্ছে যে এই দিকে তারা বেশ কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। তারা তাদের ট্যাক্সি সেবাকে অনেক বেশি পরিমাণে বিজ্ঞাপনের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশন থেকে শুরু করে যেকোনো বার্তামাধ্যম ব্যবহার করে তারা উবারকে বাজারজাত করছে। এমনকি দারা খসরুশাহী নিজেও যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশনে এসে উবারের নতুনত্ব নিয়ে প্রচার করছে। “নতুন নেতৃত্ব ও নতুন সংস্কৃতি”– এই আদর্শ বেছে নিয়ে তারা সাধারণের মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাচ্ছে। এতসব করার একটাই উদ্দেশ্য- মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা, যাতে তারা আরও বেশি করে নির্দ্বিধায় উবার ব্যবহার করতে পারে।
উবারের নতুনত্বের মধ্যে তারা সবচেয়ে বেশি প্রচার করছে যাত্রীদের সেবাদানের বিষয়টি। তাদের মূল অগ্রাধিকার যে যাত্রীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা, সেটাই তারা বারবার বোঝাতে চাচ্ছে। এছাড়া চালকদের প্রতি এখন তারা একটু বেশিই নজর রাখছে। তাদের ব্যবহার, মানসিক অবস্থা, উবারের সাথে কাজ করে তাদের আর্থিক এবং মানসিক সন্তুষ্টি- এই বিষয়গুলো এখন তারা খতিয়ে দেখছে। এছাড়া লিফট (Lyft) এর মতো অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী ট্যাক্সি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কীভাবে নিজেদেরকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে, সেদিকেও খেয়াল রাখছে উবার। চালকদেরকে মূল ভাড়ার বাইরে টিপ বা অতিরিক্ত টাকা দেয়ার ব্যবস্থাও করেছে উবার। তবে এটা ঠিক যে উবার ব্যবহারকারী এত বেশি যে একমাত্র ব্যবসায়িক দিকে বৈচিত্র্য আনতে পারলেই তারা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।
উবার তাদের ট্যাক্সি সেবাদানের পরিসরকে আরও বড় করে তুলছে, তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডগুলোকে পৃথিবীর কোনায় কোনায় পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে, আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করছে। নিজেদের ব্যবসায়িক নকশা আরও আকর্ষণীয় করতে ‘ভবিষ্যতের প্রযুক্তি’র দিকে তাদের বেশি নজর। সেজন্যই চালকবিহীন গাড়ি, উড়ন্ত ট্যাক্সি ইত্যাদি প্রযুক্তি তৈরির পেছনে তাদের অর্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্যয় হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের বড় বড় ব্যাংক, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ফার্ম- বিনিয়োগকারী হিসেবে উবারে নিজেদের অর্থ বিনিয়োগ করছে। জাপানের সফটব্যাংক (SoftBank) বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যা উবারের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী হিসেবে নজরে এসেছে।
২০১৮ সালের অর্ধেক যেতে না যেতেই উবার সারা পৃথিবীতে প্রায় ১১.৩ বিলিয়ন ডলার বুকিং পেয়েছে। ধীরে ধীরে এই প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক ক্ষতি কাটিয়ে পুনরায় উজ্জীবিত হচ্ছে। আর এতে উবারের নিজেদের লাভ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাও দিন দিন বাড়ছে। এমনকি উবার থেকে মূল্য ছাড়ের প্রত্যাশা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশেও দেখা যায় যে দিনের কোনো কোনো সময়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি গন্তব্যে উবার মূল্য ছাড় বা অফার দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে এরকম অফার খুব লোভনীয় হয়ে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রেই উবার মানুষের এই অনুভূতিকে কাজে লাগাচ্ছে। এছাড়া যে দেশে উবার নিজেদের ব্যবসা শুরু করতে চায়, সেই দেশের সরকার এবং সরকারি নিয়ন্ত্রক বিভাগগুলো ট্যাক্স ধরে একটি বিরাট পরিমাণ অর্থ উবার থেকে নিয়ে নিচ্ছে।
লন্ডনের যে ব্যাপারটি ঘটেছে, বিশেষ করে চালকদের ব্যবহার নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, তার একটি কারণ হিসেবে উবার উল্লেখ করেছে চালকদের ক্লান্তি এবং অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য অতিরিক্ত ঘণ্টা ট্যাক্সি চালিয়ে সময় ব্যয় করাকে। এরকমটি যাতে না হয়, সে কারণে উবার ব্রিটেনে আবেদন করেছে যে ‘উবার চালক’- এই পদবিটি স্থায়ী চাকরি পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, চালকরা চুক্তি হিসেবে কাজ পাবে না, বরং একটি পূর্ণকালীন চাকরি হিসেবে তারা এই কাজ করবে। চালকদের জন্য বেতনের স্কেল থাকবে, দিন প্রতি সর্বোচ্চ কত ঘণ্টা কাজ করতে পারবে, তার উল্লেখ থাকবে, সাপ্তাহিক ছুটির ব্যবস্থা থাকবে। এই প্রত্যেকটি বিষয় মঞ্জুর করিয়ে নিতে হলে বেশ কিছু সময় দরকার।
দারা খসরুশাহী লন্ডন আদালতের বেঁধে দেয়া মাত্র পনেরো মাস সময়ে এতসব কিছু আদৌ করতে পারবেন কিনা, কিংবা পারলেও কতটুকু সফল হবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এটা ঠিক যে ট্যাক্সি সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে উবার মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য সেবায় পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে। নিজেদের বিশ্বস্ততা ধরে রাখতে হলে জনসাধারণের নিরাপত্তা এবং তাদের সন্তুষ্টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তাদেরকে ব্যবসায়িক দিকনির্দেশনা ঠিক করতে হবে। না হলে একটু একটু করে বিশ্বস্ততা হারাতে থাকলে একসময় উবার নিজের জনপ্রিয়তা হারাতে পারে। কারণ, বাজারে উবারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আরও প্রতিষ্ঠান আছে, যারা এই সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইবে। উবারের জন্য সাবধানতা অবলম্বন করার এটাই মোক্ষম সময়।
তথ্যসূত্র-
The Economists (June) – A Victory for Uber- Crossing the London Bridge, Page 56-57.
ফিচার ইমেজ সোর্স- cnbc.com