১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর, ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়া এক দেশের নাম ইউনাইটেড আরব আমিরাত, তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির বয়স বাংলাদেশের চেয়ে মাত্র কয়েকদিন বেশি। কিন্তু দক্ষ নেতৃত্ব আর তেলের উচ্চমূল্যের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরব আমিরাত তাদের অর্থনীতিকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে শক্তিশালী পর্যটন শিল্প। মাটির নিচের তেল ফুরিয়ে আসলেও কিংবা তেলের মূল্য হ্রাস পেলেও যাতে তার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে না পড়ে, তার সুদৃঢ় ব্যবস্থা করে ফেলেছে দেশটির প্রসাশন। সম্প্রতি দেশটির প্রশাসন ‘Fourth Industrial Revolution’ এর ব্যাপারে তাদের জাতীয় কৌশলপত্রও ঘোষণা করেছে। ক্রমান্বয়ে শুধু আরব বিশ্ব নয়, সারা পৃথিবীকে ছাড়িয়ে যাবার দৌড়ে নেমেছে যেন আরব আমিরাত।
পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক মন্ত্রী
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঘোষিত কৌশলপত্রে আরব আমিরাতকে সমৃদ্ধ করে তুলতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর ব্যাপক জোর দেওয়া হয়েছে। শুধু নীতি প্রণয়ন করেই ক্ষান্ত হয়নি আমিরাত সরকার, ২৭ বছর বয়সী তরুণ উমার বিন সুলতান আল উলামাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দেশের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম।
মূলত আরব আমিরাতকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চর্চা আর গবেষণার কেন্দ্রে পরিণত করতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
পৃথিবীর প্রথম ফ্লাইং ট্যাক্সি সার্ভিস
আরব আমিরাত শুরু থেকেই তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করেছে। প্রশস্ত রাস্তা, সুপার হাইওয়ের জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাতি আছে আমিরাতের। কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে হয়তো বাকি ছিলো এই একটি পদক্ষেপ। দীর্ঘপথ খুব অল্প সময়েই পাড়ি দেয়া যাবে ফ্লাইং ট্যাক্সিতে চড়ে। কল্পবিজ্ঞানের বই থেকে উড়ন্ত এই ট্যাক্সিগুলোকে যেন একদম বাস্তবে নিয়ে এসেছে দুবাইয়ের প্রশাসন।
Passenger drones are being launched in Dubai
No more small talk. Read more: http://wef.ch/2gpccZi
Posted by World Economic Forum on 3 सप्टेंबर 2017
Autonomous Air Taxi (AAT) নামে পরিচিত এই ট্যাক্সি সার্ভিস পৃথিবীর সর্বপ্রথম স্বনিয়ন্ত্রিত ট্যাক্সি সার্ভিস। বিদ্যুতচালিত এই উড়ন্ত ট্যাক্সি চলেও দুরন্ত গতিতে। এই ট্যাক্সি গড়ে পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আধঘণ্টায়।
অত্যাধুনিক এই ট্যাক্সির সাহায্যে আবুধাবি থেকে দুবাই পৌঁছানো যাবে মাত্র ১২ মিনিটেই। এর ফলে জনসাধারণের কর্মঘন্টা বেঁচে যাওয়ার পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসবে দ্রুতগতি। পরীক্ষামূলকভাবে চালু এই প্রকল্প দ্রুত সময়ের মধ্যেই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন দুবাইয়ের ক্রাউন প্রিন্স শেখ হামাদান বিন মোহাম্মদ।
শিক্ষায় বাড়ছে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ
অবকাঠামো বিনির্মাণ কিংবা পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি আরব আমিরাতের লক্ষ্য এখন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা। ২০১৭ সালের অক্টোবরে আরব আমিরাত ‘One Million Arab Coders‘ নামক এক প্রকল্প শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে।
‘ওয়ান মিলিয়ন আরব কোডার’ এই প্রকল্পের আওতায় পুরো আরব আমিরাতজুড়ে এক মিলিয়ন তরুণকে প্রোগ্রামিংয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে। তারা আগামী দিনে আরব আমিরাতের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতকে যোজন যোজন দূরে এগিয়ে নেবেন বলে এই প্রকল্প পরিচালকদের আশা। পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নের দিকেও মনোযোগ দিচ্ছে আমিরাত প্রশাসন। রাষ্ট্রীয় বাজেটের প্রায় চল্লিশ শতাংশই ব্যয় হবে সামাজিক উন্নয়নে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকবে মোট বাজেটের ১৭ শতাংশ, যা অন্য যেকোনো আরব দেশের চাইতে বেশি।
পুলিশের দায়িত্ব পালন করবে রোবট
সিনেমা কিংবা কল্পকাহিনীর রোবোকপকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে আরব আমিরাত। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় রোবট অন্তর্ভুক্তি আমূল পরিবর্তন এনেছে দেশটিতে। নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি দ্রুত সেবা নিশ্চিত করতে দুবাই পুলিশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এই যান্ত্রিক পুলিশকে।
ভুল জায়গায় পার্ক করা গাড়ি থেকে শুরু করে জরিমানা করা- সবই করতে পটু এই রোবট পুলিশ। পাশাপাশি ফেসিয়াল রিকগনিশনের মাধ্যমে মানুষকেও শনাক্ত করতে পারবে রোবট পুলিশের এই দল। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার করে সিদ্ধান্তও নিতে পারবে এই পুলিশ। দুবাই পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার খালিদ নাসের আল রাজুকি রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“These kind of robots can work 24/7. They won’t ask you for leave, sick leave or maternity leave. It can work around the clock.”
অনলাইন শপিংয়ের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে আমিরাত
দুবাইতে যারা বেড়াতে যান, তারা মোটেই খালি হাতে ফিরে আসেন না, কিনে নিয়ে আসেন একগাদা জিনিস। আমিরাতের অর্থনীতিও এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় শপিংমলগুলোও তাই ঠাঁই গেড়ে নিয়েছে দুবাইয়ে। তবে বড় বড় শপিংমলের পাশাপাশি অনলাইন শপিংকেও দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে আমিরাত। দুবাইয়ে ঘুরতে এসে শপিং মলে সময় নষ্ট করতে চান না এমন পর্যটকরাও যাতে হাতের নাগালেই সব শপিং করতে পারেন, তাই আরব আমিরাত গুরুত্ব দিচ্ছে ই-কমার্সের প্রতি।
ত্রিমাত্রিকভাবে প্রিন্ট করা অফিস ভবন
২,৭০০ বর্গ ফুটের একটি অফিস ভবন তৈরি করতে সময় লেগেছে মাত্র সতের দিন আর মানুষ লেগেছে মাত্র আঠার জন! থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের সহায়তা নিয়ে খুব কম সময় আর লোকবল ব্যবহার করেই দুবাইতে নির্মিত হয়েছে এমন ভবন।
ভবনটি উদ্বোধনের সময় দুবাইয়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রাশিদ আল মাকতুম বলেন,
“দুবাইকে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার একটি অংশ হিসেবেই বাস্তবে রূপ দেওয়া হয়েছে এই থ্রি-ডি প্রিন্টেড বিল্ডিংকে।”
বর্তমানে এই ভবনটি দুবাই ফিউচার ফাউন্ডেশনের অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। অচিরেই এটিকে এক্সিবিশন, ওয়ার্কশপ এবং অন্যান্য কাজের জন্য ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছে আমিরাত প্রশাসন।
আকাশচুম্বী ভবনের রাজ্যে স্বাগতম
শুধু দুবাই শহরজুড়েই আছে ১,৩৪৪টি আকাশচুম্বী ভবন। ৮২৮ মিটার উঁচুতে দাঁড়িয়ে থাকা ভবন বুর্জ খলিফা তো এই শহরের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ২০০৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পৃথিবীর উচ্চতম ক্রেনগুলোর এক-চতুর্থাংশই কাজ করছে দুবাইয়ের আকাশচুম্বী ভবন তৈরিতে। এই উচ্চতম ভবনগুলোতেই গড়ে উঠছে অফিস, বাসা কিংবা বিলাসবহুল হোটেল।
পৃথিবীর বৃহত্তম কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ
আকাশের বুকে ঘর বানিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি আমিরাতবাসী, পারস্য উপসাগরের কূলে ৫২০ কিলোমিটার জুড়ে তারা বানিয়েছে কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ। দেখতে অনেকটা পাম গাছের মতো এই দ্বীপপুঞ্জের নাম ‘পাম জুমেইরাহ’।
পাম জুমেইরাহ পৃথিবীর বৃহত্তম কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ। এটি নির্মাণের ফলে একদিকে যেমন দুবাইয়ের আবাসন সংকটের সমাধান হবে, তেমনি অন্যদিকে পৃথিবীজুড়ে লাখো পর্যটকের গন্তব্য হয়ে উঠবে। প্রস্তুত করা হয়েছে চার হাজারের অধিক বিলাসবহুল কটেজ। মূলভূমির সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের কারণেই এটি ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে দুবাইয়ের মূল আকর্ষণ।
কৃত্রিমভাবে নির্মিত দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত আর বিলাসবহুল নৌকায় সুসজ্জিত এই দ্বীপ ছুটি কাটানোর জন্য অনেক ধনকুবেরের স্বপ্নের গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
আর এভাবেই তেলভিত্তিক অর্থনীতিকে কাজে লাগিয়ে প্রথমে অবকাঠামো উন্নয়ন, পর্যটনশিল্পের বিকাশ করে উন্নয়নের পথে সমসাময়িক সময়েই স্বাধীন হওয়া কিংবা তেলের উপর নির্ভরশীল বাকি আরব দেশগুলোর চেয়ে যোজন যোজন দূর এগিয়ে গেছে ইউনাইটেড আরব আমিরাত।