এই পৃথিবীর একসময়ের কত উন্নত শহর, কত প্রাচীন সভ্যতা কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। বর্তমান সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ সেসব সভ্যতার স্মারক বহনকারী শহরগুলোর সন্ধান করছেন। তাদের এই নিরন্তর চেষ্টার কারণে অনেক হারিয়ে যাওয়া শহর আবিষ্কৃত হয়েছে এবং হচ্ছে। তারা সন্ধান পেয়েছেন এমন অনেক শহরের, যা প্রাচীন সভ্যতার অনেক অজানা ইতিহাসই সকলের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। গবেষক থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই সেসব নিদর্শন দেখে রীতিমতো রোমাঞ্চিত হয়েছেন। সে সময়ের স্থাপত্যশিল্প, নগর পরিকল্পনার চিত্র দেখে তখনকার মানুষদের চিন্তাভাবনা এবং বিজ্ঞানের কলাকৌশল রপ্ত করার দক্ষতা সকলকে অবাক করে দিয়েছে।
সাম্প্রতিকালে প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটা দল সন্ধান পেয়েছেন এমনই এক শহরের অস্তিত্ব, যা একসময় পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। শহরটির নাম শিচেং। চীনের এই প্রাচীন শহরটি একসময় ‘লায়ন সিটি’ নামেও খ্যাত ছিল।
পর্যটকরা শহরটিকে পূবের আটলান্টিস হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। প্রাচীন এই শহরের অনেক নিদর্শনই আজও অবিকৃত রয়ে গেছে। সেই সময়ের পাকা রাস্তা, ঘরবাড়ি, স্মৃতিসৌধ এবং মন্দির পানির নিচে নিমজ্জিত থাকায় তেমন কোনো ক্ষতির সম্মূখীন হতে হয়নি। এই শহরটি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার পেছনে নানা মত রয়েছে। কারও মতে, নগর পরিকল্পনার ভুলের কারণে, আবার কারও মতে- ইচ্ছে করে শহরটিকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। মতামত ভিন্ন হলেও বিজ্ঞানীরা এক বিষয়ে নিশ্চিত যে, মানুষের অবিবেচক পরিকল্পনার কারণে শহরটি ধ্বংস হয়েছে।
শিচেং শহরটি যেভাবে গড়ে উঠেছিল
চীনের ঝিজিয়াং প্রদেশের উ সি পাহাড়ের (ফাইভ লায়ন মাউন্টেন) পাদদেশে অবস্থিত এক অতি প্রাচীন শহর শিচেং। সাংঘাই থেকে এই শহরের দূরত্ব ৪০০ কিমি। শহরটি প্রায় ১৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো। ২৫ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দে হান রাজবংশের রাজত্বকালে শহরটি গড়ে উঠেছিল। ওই সময়েই নগরীর বিভিন্ন স্থাপনাগুলোও নির্মিত হয়। শহরটি প্রায় ৬২টি ফুটবল মাঠের সমান বলে মনে করেন প্রত্নতত্ত্ববিদগণ। নগরের রাজপথ আর অট্টালিকা, বিশাল স্মৃতিস্তম্ভ এবং মন্দিরগুলো সে যুগের নগর সভ্যতার এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। পরবর্তীকালে শহরটি ঝিজিয়াং প্রদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়।
শহরটি পানির নিচে নিমজ্জিত হলো যেভাবে
ঠিক কীভাবে শহরটি পানির নিচে হারিয়ে যায়, তা নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। তবে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে, এর জন্য চীন সরকারের অদূরদর্শী পরিকল্পনায় দায়ী। ১৯৫৯ সালে তৎকালীন চীন সরকার শিচেং শহরের পাশেই জিনআন বাঁধ এবং তার সাথে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাঁধের কাছাকাছি বসবাসরত তিন লক্ষ লোককে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
সরিয়ে নেয়া লোকজনের অনেকেই বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে পরিবার পরিজন নিয়ে শিচেং শহরেই বসবাস করছিল। এরপর প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বাঁধের পানি আটকানোর জন্য নির্মাণ করা হয় একটি কৃত্রিম হ্রদ, কিয়ান্দো। আর এই কিয়ান্দো হ্রদের কারণে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকে পুরো নগরটি। আর সেই সাথে তলিয়ে যেতে থাকে নগর সভ্যতার প্রাচীন সব নিদর্শন।
হারিয়ে যাওয়া শহরটির নতুনভাবে আবিষ্কৃত হলো যেভাবে
পানির নিচে হারিয়ে যাওয়ার পর চীনের জনগণ এমনকি চীন সরকারও শহরটির কথা প্রায় ভুলতে বসেছিল। ২০০১ সালে চীন সরকার কিয়ান্দোর জলে ডুবে যাওয়া শিচেং শহরটি কী অবস্থায় আছে, তা জানার জন্য সরকারের পুরাতাত্ত্বিক অনুসন্ধানকারী একটি দলকে কিয়ান্দো লেকে নামানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ভুলতে বসা মানুষদের স্মৃতিতে ফিরে আসে সেই হারিয়ে যাওয়া শিচেং শহর। এভাবে ২০০১ সালে পানির নিচে হারিয়ে যাওয়া শহরটি পুনরায় আবিষ্কৃত হয়।
এই অনুসন্ধানকারী দল দেখতে পান যে, ৫০ বছরেরও অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও ডুবে থাকা শিচেং শহরটি প্রায় অক্ষত অবস্থায় আছে। নগরীর অট্টালিকা, মন্দির বা অন্যান্য স্থাপনাগুলোর তেমন ক্ষতি হয়নি। পানির নিচে ডুবে থাকার কারণে বায়ু, বৃষ্টি, সূর্য ইত্যাদি নানা ধরনের প্রাকৃতিক ক্ষয়ের বিপর্যয় থেকে নগরটি রক্ষা পেয়েছে। শহরটির সৌন্দর্য এখনও অমলিন।
২০১১ সালে চীনের ন্যাশনাল জিওগ্রাফির এক প্রতিবেদনে ডুবে থাকা শিচেং শহরটির কিছু ছবি প্রকাশিত হয়। ফলে অনুসন্ধিৎসু মানুষদের মনে অর্ধ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত শহরটিকে আবার নতুন করে জানার ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বেশ কিছুদিন আগে একদল ডুবুরি সেই স্থান পরিদর্শন করে দেখেছেন যে, নগরের অধিকাংশ কাঠের কাঠামো এবং নকশা খুব একটা মলিন হয়নি। কাঠামোগুলোও বেশ শক্তপোক্ত অবস্থায় আছে।
কাঠের সিঁড়িসহ ইটের তৈরি সারি সারি বাড়িগুলো এখনও সেই আগের মতোই আছে। তাতে শুধুমাত্র শ্যাওলার আস্তরণ পড়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির প্রকাশিত ছবিগুলোতে দেখা যায়, নগরীর পাঁচটি প্রবেশদ্বার। দুইটি প্রবেশদ্বার নগরীর পশ্চিম দিকে আর অন্যান্য প্রবেশদ্বারগুলো নগরীর উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে অবস্থিত। শহরের রাস্তাগুলো ছিল বেশ প্রশস্ত। প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে নগরীর বিভিন্ন রাস্তাতে ২৬৫টির মতো বিশাল আকৃতির তোরণ ছিল।
পাথরের তৈরি এসব তোরণগুলোর মধ্যে সিংহ, ড্রাগন এবং ফিনিক্স পাখির মতো বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর মূর্তি স্থান পেয়েছে। অনেক তোরণের শিলালিপি এখনও বর্তমান। তাতে দেখা যায়, এসব তোরণের অনেকগুলোই ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দেরও পুরনো। নগরীর দেয়ালগুলোও ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে বলে এসব শিলালিপি থেকে জানা যায়।
হারিয়ে যাওয়া নগরটিকে কেন্দ্র করে বিকশিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প
বর্তমানে কিয়ান্দো লেকে নিমজ্জিত থাকা শিচেং নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। চীনের ডুবুরি প্রতিষ্ঠান যেমন বিগ ব্লু এবং জি এও ডাইভিং ক্লাব পর্যটন স্থান হিসেবে নগরটিকে ব্যবহার করছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেই শহরে যাওয়ার একটি পথও তৈরি করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
এসব ডাইভিং ক্লাবে নিয়োজিত ডুবুরিদের সহায়তায় ডাইভিং করতে ইচ্ছুক, এমন পর্যটকদেরকে তারা প্রাচীন শিচেং শহরটি দেখানোর ব্যবস্থা করেন। সাধারণত এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তারা নিয়মিতভাবে এই কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। তবে নগরটির সীমানা এখনও পুরোপুরি নির্ধারণ করা যায়নি। শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট এলাকায় পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
পর্যটকদের পুরো জায়গাটি ঘুরে দেখানোর মতো সবরকমের ব্যবস্থা করা এখনও সম্ভব হয়নি। তারপরও পর্যটকরা হারিয়ে যাওয়া এক নগর সভ্যতার যেসব নিদর্শন দেখতে পান, তাও তাদের জন্য কম কিছু নয়। তাই দিন বা রাতে কিয়ান্দোর গভীর জলে ডাইভিং করে শিচেং নগরটি দেখার লোভ সামলাতে পারেন না অনেক পর্যটকই।
শিচেং শহরটি দেখতে পর্যটকদের আনাগোনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনো কোনো পর্যটক তার পরিবার নিয়ে শুধুমাত্র কিয়ান্দোর লেকে নৌবিহারের উদ্দেশ্যে বড় বড় প্রমোদতরী ভাড়া নেন। আবার কেউ কেউ আন্ডার ওয়াটার ডাইভিং করে ডুবে থাকা শহরটি এক পলক দেখে আসেন। এভাবে প্রাচীন নগর সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন শিচেং শহরটি মানুষদের মাঝে আবার নতুন রূপে ফিরে এসেছে।