পৃথিবীজুড়ে ম্যানগ্রোভের কান্না যেন থামছেই না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মানবসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার বেড়াজালে পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর এই হটস্পটগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে চোখের নিমিষে। ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের সমুদ্রের নোনা পানি আর অভ্যন্তরীণ মিঠা পানির সংস্পর্শে গড়ে উঠা অজস্র মোহনাগুলো পৃথিবীর প্রাণের সবচেয়ে আশ্চর্য আধার। অন্য যেকোনো বনাঞ্চলের তুলনায় পাঁচগুণ বেশী কার্বন শোষণ করে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দমিয়ে রাখা এই ম্যানগ্রোভ বেষ্টনীগুলো মানুষকে অকৃত্রিম মমতায় নানা দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে আসছে। কিন্তু বিনিময়ে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এই বনাঞ্চলের কান্না শোনার জন্য কেউ কি কান পেতেছে?
পৃথিবীজুড়ে ম্যানগ্রোভের ‘সলিল সমাধি’
পৃথিবীতে কত পরিমাণ ম্যানগ্রোভ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার সঠিক তথ্য পেতে ২০০০ সালে আমেরিকান ভুতাত্ত্বিক জরিপ ও গবেষণা কেন্দ্রকে সাথে নিয়ে নাসা স্যাটেলাইট জরিপ শুরু করে। পৃথিবীর ১৮৮টি দেশ জুড়ে ১,৩৭,৭৬০ বর্গ কিলোমিটারের ম্যানগ্রোভ খুঁজে পাওয়া যায়। দেখা গেছে, পরিসংখ্যান বইগুলোতে থাকা পরিমাণের চেয়ে ১৩ শতাংশ কম ম্যানগ্রোভ আছে পৃথিবীতে। যার ৪২ শতাংশের অবস্থান এশিয়ায়, ২০ শতাংশ আফ্রিকায়, ১৫ শতাংশ করে আছে উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে আছে ১২ শতাংশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলটি হলো বাংলাদেশের সুন্দরবন। ম্যানগ্রোভ নিয়ে এই জরিপ এবং গবেষণা প্রকল্পের সাথে যুক্ত বিজ্ঞানী ড. চন্দ্র গিরির জরিপে উঠে এসেছে পরিসংখ্যান বইগুলোতে থাকা তথ্যের চেয়েও ১৩ শতাংশ কম ম্যানগ্রোভ আছে বাস্তবে। ১৯৮০’র দশক থেকে এই পর্যন্ত পৃথিবীর মোট ম্যানগ্রোভের ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ বিলীন হয়ে গেছে। বছরে প্রায় ২ থেকে ৮ শতাংশ হারে চলতে থাকা এই ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে না পারলে ২০৫০ সাল নাগাদ হয়তো ম্যানগ্রোভ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই থাকবে না। যে উপকূলীয় এলাকার মানুষগুলোকে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, তাদের অনিয়ন্ত্রিত সম্পদ আহরণই কি সলিল সমাধি রচনা করছে অমূল্য এই সম্পদের?
ম্যানগ্রোভের কান্না শুনতে পেয়েছে শ্রীলঙ্কা
দেরীতে হলেও ম্যানগ্রোভের এই দুঃখকে কান পেতে শুনেছে শ্রীলঙ্কা সরকার। পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো কোনো ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মানুষের হাত ধরে আবারো জেগে উঠছে। ম্যানগ্রোভকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে বিকল্প কর্মসংস্থান করে দিয়ে, প্রশিক্ষণ আর সহায়তা দিয়ে সীমিত সম্পদ আহরণ করতে উৎসাহ দিয়ে ম্যানগ্রোভের ইতিহাসকে নতুন করে লেখা শুরু করেছে শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা সরকারের উদ্যোগে উপকূলীয় এলাকায় দেওয়া হচ্ছে স্বল্প সুদে ক্ষুদ্রঋণ। নারীদের দেওয়া হচ্ছে সেলাই মেশিন, সরকারী খরচে স্থাপিত হচ্ছে স্কুল। কর্মক্ষম পুরুষদের দেওয়া হচ্ছে বিকল্প ব্যবসা উপকরণ আর পরিমিতভাবে ম্যানগ্রোভ থেকে সম্পদ আহরণের প্রশিক্ষণ। গল্পের মতো শোনালেও গোটা শ্রীলঙ্কার ম্যানগ্রোভ এলাকাজুড়ে এটিই বাস্তবতা। তিলে তিলে শেষ হয়ে যাওয়া ম্যানগ্রোভকে বাঁচিয়ে তোলার এই প্রকল্পে সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা করার আহবান জানিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা বলেছেন–
“It is the responsibility and the necessity of all government institutions, private institutions, non-government organizations, researchers, intelligentsia and civil community to be united to protect the mangrove ecosystem.”
শ্রীলঙ্কা সরকারের সাথে ম্যানগ্রোভ বাঁচিয়ে তোলার এই অসাধারণ কাজে সহায়তা করছে এনজিও প্রতিষ্ঠান ‘Seacology’ এবং ‘Sudeesa’।
প্রশিক্ষণ এবং আত্মকর্মসংস্থান
শ্রীলঙ্কার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বেষ্টিত পুত্তালাম জেলায় স্থানীয় নারীদেরকে বিকল্প কর্মসংস্থানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে ঋণ। এই ঋণ ব্যবহার করে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার নারীর। শুধু পুত্তালাম জেলায় ৭,৫০০ জন নারী এসেছেন এই প্রকল্পের আওতায়। ঋণ আদায় কিংবা পরস্পরের অভিজ্ঞতা বিনিময়ে চলে উঠান বৈঠকের মতো ঘরোয়া সভাও।
পুত্তালাম জেলার এক সাধারণ নারী পি কনসি এবং তার পরিবার ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের সম্পদের উপর শতভাগ নির্ভরশীল ছিলেন। সরকারি সহায়তায় ট্রেনিং নিয়ে স্থাপন করেছেন দর্জির দোকান। তিনি এবং তার স্বামী মিলে চালাচ্ছেন সেই দোকান। পাশাপাশি নতুন অনেকের জন্য ট্রেনিং আর কর্মসংস্থানের রাস্তা করে দিয়েছেন এই দম্পতি। চলমান ব্যবসার পরিসর আরো বড় করবার জন্য ইতোমধ্যে সরকারের কাছে ১০ হাজার রুপী লোনের আবেদনও করেছেন তারা। এভাবেই বদলে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কার উপকূলীয় এলাকার মানুষের গল্প।
প্রসার হচ্ছে ইকোট্যুরিজমের
ম্যানগ্রোভ এলাকার নিরাপত্তা জোরদার হওয়ার সাথে সাথে পাল্লা উন্নতি হচ্ছে এই এলাকার ইকোট্যুরিজমের। দলে দলে দেশি বিদেশী পর্যটকরা দেখতে আসছেন বদলে যাওয়া এই ম্যানগ্রোভকে। গাইড হিসেবে কাজ করছে স্থানীয় তরুণরাই। ঘুরতে আসা পর্যটকরাও খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন না। কিনে নিয়ে যাচ্ছেন এই এলাকার শুটকিমাছ কিংবা অন্যান্য পণ্য। পাশাপাশি স্থানীয় চাহিদা তো আছেই। তৈরি হচ্ছে সমুদ্র থেকে ধরে আনা মাছের প্রক্রিয়াজাত করার এবং শুটকিমাছ তৈরির বিশাল বাজার। সরকারী সহায়তা নিয়ে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভাগ্য ফেরাচ্ছেন কেউ কেউ।
পরিমিত মাছ শিকার আর নিয়ন্ত্রিত জলযান
ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের ভিতর বয়ে চলা নদীগুলোতে পরিমিত সম্পদ আহরণ করা কিংবা বিরল অথবা বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণী ধরার ব্যাপারে জেলেদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। পাশাপাশি গহীণ অরণ্যে ইঞ্জিনচালিত জলযানের শব্দে যাতে প্রাণীর স্বাভাবিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সাধারণ জেলে নৌকা।
পৃথিবীর প্রথম ম্যানগ্রোভ নার্সারি
২.২ মিলিয়ন ইউরোর এই মেগাপ্রজেক্টের আওতায় শুধু ম্যানগ্রোভ বন সুরক্ষাই নয়, বরং বিভিন্ন সময়ে মানবসৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্থ ৯,৬০০ একর এলাকাজুড়ে পুনরায় ম্যানগ্রোভ তৈরি করা হচ্ছে, লাগানো হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ।
সেই কাজের জন্য বিশেষভাবে গড়ে তোলা হয়েছে নার্সারি। ম্যানগ্রোভ এলাকায় বিশেষ কিছু প্রজাতির উদ্ভিদ সাধারণের চেয়ে পাঁচগুণ বেশী কার্বন শোষণ করে। সেই উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে পরিচর্যা করা হচ্ছে বিশেষভাবে গড়ে তোলা সেই নার্সারিগুলোতে।
নার্সারি গুলোতে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের কাজের সুযোগ হচ্ছে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ম্যানগ্রোভের গুরুত্ব বোঝাতে তাদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে সামাজিক বনায়নে।
সামাজিক ম্যানগ্রোভ বনায়ন
শ্রীলঙ্কান নৌবাহিনীর সহায়তায় স্থানীয় মানুষও সামাজিকভাবে ম্যানগ্রোভ বনায়নে অংশ নিচ্ছে। পুরো শ্রীলঙ্কার ১৪টি অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ এলাকাজুড়ে সাধারণ মানুষের সমন্বয়ে ১,৫০০ কমিউনিটি বোর্ড অর্গানাইজেশন গঠন করা হয়েছে। তাদের সবাইকে নৌবাহিনীর সহায়তায় তিন দিনের প্রশিক্ষণ কর্মসুচির আওতায় এনে সামাজিক বনায়ন এবং পরিমিত সম্পদ আহরণের ব্যাপারটি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ শেষে প্রতিটি কমিটির হাতে ২১ হেক্টর ম্যানগ্রোভ এলাকা রক্ষণাবেক্ষণ এবং বনায়নের ভার তুলে দেওয় হয়েছে।
পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের আওতায় সরকার এবং এনজিওগুলোর মূল লক্ষ্য হলো ম্যানগ্রোভের জীববৈচিত্রকে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে, স্থানীয় মানুষকে বিকল্প পেশায় স্বাবলম্বী করার মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল থেকে পরিমিত সম্পদ আহরণ নিশ্চিত করা। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের সুফল ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা মানুষগুলো। পাশাপাশি নোনা পানির সেই বনভূমিগুলো আবারও হয়ে উঠছে প্রাণীকূলের অভয়ারণ্য।
বাংলাদেশ কি কিছু শিখতে পারে?
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভের অধিকারী হয়ে আমরা কী করছি? সিডর থেকে আমাদের রক্ষা করে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাবার কান্না কি আমরা কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছি? সুন্দরবনকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর কাঁধে অপরিমিত সম্পদ আহরণের দায় চাপিয়ে আর কতদিন পালিয়ে বেড়াবো আমরা? শ্রীলঙ্কার মতো ম্যানগ্রোভের ভেতর দিয়ে উচ্চশব্দের ট্রলার কিংবা ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল বন্ধ করা সময়ের দাবী। পাশাপাশি নোনাপানির ধার ঘেঁষে বসবাস করা সেই প্রান্তিক মানুষগুলোর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান করে তাদের পুনর্বাসন করার মাধ্যমে সুন্দরবনকে আবারো প্রাণ প্রাচুর্য্যের অভয়ারণ্য করে তোলার সময় এখনই।