বর্তমান যুগ নারীর ক্ষমতায়নের যুগ। রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, গণমাধ্যম, জনকল্যাণ – কোনো শাখাতেই নারীরা পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে নেই। বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠান, এমনকি অনেক রাষ্ট্রেরও সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পদে আসীন থেকে নারীরা প্রভাব বিস্তার করছেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের উপর। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফোর্বস ম্যাগাজিন প্রতি বছরই ১০০ নারীর তালিকা প্রকাশ করে থাকে, যারা তাদের বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর। বরাবরের মতো এ বছরও তারা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ১০০ নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে। চলুন জেনে নিই ২০১৭ সালে ফোর্বসের দৃষ্টিতে কারা ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ১০ নারী।
১০) জিনি রমেটি
ভার্জিনিয়া ম্যারি রমেটি বা জিনি রমেটি বিখ্যাত কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আইবিএমের সভাপতি এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রথম নারী প্রধান। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি আইবিএমের সাথে জড়িত আছেন। ২০১২ সালে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে তিনি দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৫ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় তিন নম্বরে স্থান দিয়েছিল। ফোর্বস ম্যাগাজিনের ২০১৪ সালের তালিকায়ও তিনি দশম ক্ষমতাধর নারী হিসেবে স্থান পেয়েছিলেন।
৯) অ্যানা প্যাট্রিশিয়া বটিন
অ্যানা প্যাট্রিশিয়া বটিন একজন স্প্যানিশ ব্যাংকার। ২০১৪ সাল থেকে তিনি স্যানট্যান্ডার গ্রুপের নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর আগে ২০১০ সাল থেকে তিনি ব্যাংকিং গ্রুপটির যুক্তরাজ্য শাখা স্যানট্যান্ডার ইউকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ইউরো জোনের প্রথম নারী, যিনি প্রধান কোনো ব্যাংকের শীর্ষ পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। ২০০৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন প্রথম তাকে তাদের তালিকায় ৯৯ নম্বরে স্থান দিয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে তিনি ৪৫তম এবং ২০১৬ সালে ১০ম স্থানে উঠে আসেন। এছাড়াও বিবিসি রেডিওর উইমেন’স আওয়ার অনুষ্ঠান তাকে ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের তৃতীয় ক্ষমতাধর নারী হিসেবে তাদের তালিকায় স্থান দিয়েছিল।
৮) ক্রিস্টিন লাগার্দ
ক্রিস্টিন লাগার্দ বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ২০১১ সালে তার পূর্বসূরী ডোমিনিক স্ট্রস কান যৌন ক্যালেঙ্কারির দায়ে পদত্যাগ করলে তিনি প্রথম নারী হিসেবে এই পদে নিযুক্ত হন। এর আগে বিভিন্ন সময় তিনি ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী এবং বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০১১ সালে প্রথমে ৫ বছরের জন্য নিযুক্ত হলেও পরবর্তীতে ২০১৬ সালে তাকে আরো ৫ বছরের জন্য আইএমএফের এমডি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস ২০০৯ সালে তাকে ইউরো জোনের শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাদের তালিকায় স্থান দিয়েছিল। ২০১৪ সালে তিনি ফোর্বসের ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেছিলেন।
৭) অ্যাবিগেইল জনসন
অ্যাবিগেইল জনসন একজন মার্কিন ব্যবসায়ী। তিনি মার্কিন বিনিয়োগকারী সংস্থা ফিডেলিটি ইনভেস্টমেন্টসের সভাপতি এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী নারী, যার সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ১,৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৪ সাল থেকে তিনি ফোর্বসের সেরা ১০০ ক্ষমতাশালী নারীর তালিকায় স্থান পেয়ে আসছেন। কিন্তু এবারই প্রথম সেরা দশে স্থান পেলেন।
৬) সুজান ওইচিজকি
সুজান ওইচিজকি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউবের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ২০১৪ সাল থেকে তিনি এ পদের দায়িত্বে আছেন। গুগলের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি কোম্পানীটির সাথে জড়িত ছিলেন। যে গ্যারেজটিতে গুগলের জন্ম হয়, সেটি ছিল ওইচিজকিদের গ্যারেজ। তিনি ছিলেন গুগলের প্রথম মার্কেটিং ম্যানেজার। তিনি গুগলের সবচেয়ে সফল কয়েকটি প্রকল্প, যেমন গুগল ইমেজেস, গুগল ভিডিও, গুগল ডুডল, গুগল বুকস প্রভৃতির সাথে জড়িত ছিলেন। তার পরামর্শ অনুযায়ীই গুগল ইউটিউব কিনেছিল। ২০১৫ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘ইন্টারনেটে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারী’ হিসেবে অভিহিত করে। তিনি ২০১৫ এবং ২০১৬ সালেও ফোর্বসের সেরা ১০ ক্ষমতাশালী নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন।
৫) ম্যারি বারা
ম্যারি বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মোটরস কোম্পানীর চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। ২০১৪ সালে কোম্পানীটির সিইওর দায়িত্ব পাওয়া ম্যারি বারা ছিলেন মোটরগাড়ি শিল্পের প্রধান কোম্পানীগুলোর মধ্যে প্রথম নারী সিইও। সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে তিনি কোম্পানীটির ক্রয় এবং সরবরাহ বিভাগের নির্বাহী সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। তিনি এ পর্যন্ত মোট ছয়বার ফোর্বসের ক্ষমতাশালী নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন। এছাড়াও তিনি ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে ফরচুন ম্যাগাজিনের বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
৪) শেরিল স্যান্ডবার্গ
শেরিল স্যান্ডবার্গ বর্তমান বিশ্বের ব্যবসায়িক জগতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। পূর্বে তিনি গুগলের ‘অনলাইন সেলস অ্যান্ড অপারেশন্স’ বিভাগের সহ-সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে তিনি ফেসবুকের ‘চীফ অপারেটিং অফিসার’। ২০০৮ সাল থেকেই তিনি এ পদে কর্মরত আছেন। সফলভাবে বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফেসবুককে একটি অত্যন্ত লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ব্যাপারে তার বিশাল অবদান আছে। ২০১২ সালে তিনি প্রথম নারী হিসেবে ফেসবুকের পরিচালনা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি একইসাথে একজন নারী অধিকার কর্মীও।
৩) মেলিন্ডা গেটস
মেলিন্ডা গেটসের পরিচয় তিনি বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিল গেটসের স্ত্রী এবং তার প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের একজন সাবেক কর্মকর্তা। তবে বর্তমানে তার সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় দাতব্য সংস্থা বিল অ্যন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সহ-সভাপতি। বিশ্বব্যাপী তার জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য এর আগেও একাধিকবার ফোর্বসের প্রভাবশালী নারীর তালিকায় সেরা দশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি এই তালিকায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি এবং বিল ক্লিন্টন টাইম ম্যাগাজিনর পার্সনস অফ দ্য ইয়ার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ বছর ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ তাকে এবং বিল ক্লিন্টনকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার ‘লেজিয়ন অফ অনার’-এ ভূষিত করেছিলেন।
২) থেরেসা মে
গত বছর বিশ্বের ক্ষমতার নারীদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারী ক্লিন্টন। সবাই একপ্রকার ধরেই নিয়েছিল, তিনিই হতে যাচ্ছেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হওয়ার পর হিলারী ক্লিন্টন দ্বিতীয় অবস্থান থেকে ছিটকে পড়ে আশ্রয় নিয়েছেন ৬৫ তম স্থানে। আর তার পরিবর্তে দ্বিতীয় স্থানটি অর্জন করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। ব্রেক্সিট বিতর্কে অত্যন্ত কঠিন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং অগ্রীম নির্বাচনের আয়োজন করে তিনি বারবার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। কিন্তু সব চ্যালেঞ্জকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করে এখনও বহাল তবিয়তে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি।
১) অ্যাঙ্গেলা মার্কেল
অ্যাঙ্গেলা মার্কেলকে বলা হয় মুক্ত বিশ্বের চ্যান্সেলর। গত এক যুগ ধরে তিনি জার্মানীর চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিউন ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় থাকা রাষ্ট্রপ্রধান। তার দৃঢ় নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং সাম্প্রতিক অভিবাসী সমস্যা সমাধানে তার ভূমিকার জন্য তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিফ্যাক্টো লিডার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বস্তুগত রসায়নে ডক্টরেট ডিগ্রীধারী সাবেক এই গবেষক-বিজ্ঞানী রাজনীতিতে যোগ দেন ১৯৮৯ সালে। ১৯৯১ সালে তিনি নারী ও যুব মন্ত্রণালয় এবং ১৯৯৪ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। ২০০০ সালে তিনি তার দল সিডিইউয়ের প্রধানের পদ লাভ করেন। ২০০৫ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করার পর জার্মানীর চ্যান্সেলর হিসেবে সরকার গঠন করেন। এরপর ২০০৯ এবং ২০১৩ সালের নির্বাচনেও তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং তিনি জার্মানীর চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকেন।
অ্যাঙ্গেলা মার্কেল শুধু এবার নয়, এ পর্যন্ত মোট রেকর্ড সংখ্যক দশ বার ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারীর তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করেছেন। এছাড়াও তিনি ফোর্বসের বিবেচনায় দুই বার বিশ্বের দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে তিনি টাইম ম্যাগাজি কর্তৃক ‘পার্সন অফ দ্য ইয়ার’ হিসেবে নির্বাচিত হন। টাইস ম্যাগাজিন তাকে ‘চ্যান্সেলর অফ দ্য ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ উপাধিতে ভূষিত করে।
ফিচার ইমেজ- Getty Images