কুর্দিস্তান হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রবিহীন জাতির আবাসভূমি। মধ্যপ্রাচ্যে আরব, তুর্কি এবং ফারসিদের পরেই কুর্দিরা চতুর্থ বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী। তুরস্ক, ইরাক, ইরান, সিরিয়া এবং আর্মেনিয়ার ২ থেকে ৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল এলাকা জুড়ে আছে কুর্দিস্তান। এর অধিবাসীদেরকে বলা হয় কুর্দি। এসব এলাকায় প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি কুর্দি বসবাস করে। এছাড়া কুর্দিস্থানের বাইরেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরো কয়েক লক্ষ কুর্দি বসবাস করে।
পাশাপাশি পাঁচটি দেশ জুড়ে বিস্তৃত হলেও ধর্মীয়, ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত দিক থেকে কুর্দিরা মূলত একই জাতি। কুর্দিরা অধিকাংশই সুন্নী মুসলমান, তবে তারা আরব না। তাদের ভাষা কুর্দি ভাষা, যদিও বিভিন্ন এলাকায় এর আঞ্চলিক রূপভেদ আছে। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে কুর্দিরা অন্যতম বঞ্চিত এবং নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠী। দীর্ঘদিন ধরেই তারা তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে আসছে।
তবে একই জাতি হলেও, দীর্ঘদিন ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের অধীনে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রতিটি অঞ্চলের কুর্দিদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিকশিত হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে ভিন্নতাও সৃষ্টি হয়েছে। জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়েচেভেলের মতে, অধিকাংশ কুর্দি জাতীয়তাবাদিই বৃহত্তর স্বাধীন কুর্দিস্তানের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু তাদের রাজনীতিবিদরা তাদের এসব ভিন্নতা সম্পর্কে অবগত থাকায় স্বাধীনতার পরিবর্তে অধিকতর অধিকার এবং স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষপাতী।
ঐতিহাসিক পটভূমি
কুর্দিরা শত শত বছর ধরেই সিরিয়া এবং মেসোপটেমিয়ার সমতল এবং পাহাড়ি ভূমিতে বসবাস করে আসছে। আধুনিক তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বে, সিরিয়ার উত্তর-পূর্বে, ইরাকের উত্তরে, ইরানের উত্তর-পশ্চিমে এবং আর্মেনিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে এদের বসবাস। এরা মূলত বেদুইন জাতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯২০ সালে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তুরস্কের সাথে সেভরা চুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করে, যেখানে কুর্দিদেরকে গণভোটের মাধ্যমে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। কিন্তু নব প্রতিষ্ঠিত তুরস্ক প্রজাতন্ত্র সে সময় ঐ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানায়।
দীর্ঘ আলোচনার পর ১৯২৩ সালে তুরস্ক এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে লুসান চুক্তি নামে নতুন একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে তুরস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, কিন্তু এতে কুর্দিদের গণভোটের প্রতিশ্রুতিটি বাতিল করা হয়। ফলে চাপা পড়ে যায় কুর্দিদের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্ত্বশাসনের স্বপ্ন এবং শুরু হয় এক দীর্ঘস্থায়ী সংকট। ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা বৃহৎ কুর্দিস্তান এলাকাকে ইতোপূর্বে স্বাক্ষরিত সাইকস-পিকো চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগাভাগি করে, তাদের মধ্যে কৃত্রিম সীমারেখা টেনে দেয়।
তুরস্কের কুর্দিদের ইতিহাস
কুর্দিদের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকেরই বসবাস তুরস্কে। তুরস্কের অধিবাসীদের মধ্যে ২০ শতাংশ কুর্দি। তা সত্ত্বেও তুরস্কে কুর্দিরা অত্যন্ত নির্যাতিত এবং সুবিধাবঞ্চিত। আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কুর্দি সহ অন্য সকল জাতি গোষ্ঠীর ভিন্ন পরিচয়ের দাবিকে কঠোরভাবে দমন করা হয়। তুরস্কের সংবিধানে তুর্কি ছাড়া অন্য সকল সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়। তাদেরকে ‘পাহাড়ি তুর্কি‘ নামে অভিহিত করা হয়। কুর্দিদের নিজস্ব নাম এবং পোশাক নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি, কুর্দিদের মাতৃভাষাও তুরস্কে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল!
১৯২৩ সালে তুরস্কের জন্মের পর থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কুর্দি জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় নেতাদের নেতৃত্বে অন্তত ১৬টি কুর্দি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। তুরস্কের কঠোর দমননীতির ফলে ধীরে ধীরে বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে আসে। কিন্তু কুর্দিদের উপর তুরস্কের শোষণ অব্যাহত থাকে। তুরস্কের সরকার কুর্দিদেরকে তাদের এলাকার সম্পদ থেকে পরিকল্পিতভাবে বঞ্চিত করতে থাকে।
১৯৭৮ সালে আব্দুল্লাহ ওকালান তুরস্কের কুর্দিদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (PKK) প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে নতুন করে কুর্দি বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৯৮৪ সালে মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। তারা সরকারি স্থাপনা, সরকারি কর্মকর্তা, কুর্দি এলাকায় বসবাসকারী তুর্কি নাগরিক এবং তুরস্কের সরকারকে সাহায্যকারী কুর্দিদের উপর আক্রমণ শুরু করে। পিকেকের এ সকল আক্রমণে অন্তত ৪০,০০০ মানুষ নিহত হয় এবং হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়। তুরস্ক ছাড়াও তুরস্কের এক সময়ের বন্ধুরাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পিকেকে-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। তবে জাতিসংঘ, চীন কিংবা রাশিয়া একে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে না।
২০১২ সালে তুরস্ক পিকেকের সাথে শান্তি আলোচনায় বসে এবং যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। কিন্তু ২০১৫ সালে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আক্রমণে ৩৩ জন কুর্দি রাজনৈতিক কর্মী নিহত হলে পিকেকে এর জন্য তুরস্কের সরকারকে দায়ী করে এবং তুর্কি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তুরস্ক পিকেকে এবং আইএসের বিরুদ্ধে যৌথ যুদ্ধ ঘোষণা করে। পিকেকে-ও আইএস এবং তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। এরপর থেকে তুরস্ক বনাম আইএস বনাম পিকেকে ত্রিমুখী যুদ্ধে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
সিরিয়ার কুর্দিদের ইতিহাস
সিরিয়াতে কুর্দিদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। ১৯৬০ সাল থেকে অন্তত ৩ লাখ কুর্দি জনগোষ্ঠী নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে এসেছে। কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোকে আরবিকরণের লক্ষ্য নিয়ে তাদের ঘরবাড়ি জোর পূর্বক দখল করে আরবদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। কুর্দিদের সংগঠিত হওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টাকে কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে।
২০১১ সালের আরব বসন্তে বাশার আল-আসাদ বিরোধী বিদ্রোহ শুরু হলে কুর্দিরা প্রথম দিকে কোনো পক্ষে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি বাহিনী অন্যান্য এলাকার বিদ্রোহ দমনের জন্য কুর্দি এলাকা থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিলে কুর্দিরা সেসব এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে আল-কায়েদার সিরীয় শাখা আল-নুসরা ফ্রন্ট এবং আরও পরে আইএস কুর্দি এলাকাগুলোতে আক্রমণ করলে কুর্দিরা ব্যাপকভাবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। নিজেদের এলাকা নিরাপদ রাখার জন্য তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকায় সিরিয়ান সরকার এবং বিদ্রোহী – উভয় পক্ষকেই সহায়তা করে।
সিরিয়ার কুর্দিদের প্রধান সংগঠন হচ্ছে ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি (PYD), যা ২০০৩ সালে তুরস্কের পিকেকের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এদের সামরিক শাখার নাম পিপল’স প্রটেকশন ইউনিট (YPG)। তবে তারা পিকেকের মতো সিরিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতায় জড়ায়নি এবং তুরস্ক ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্র তাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবেও গণ্য করে না। উইমেন’স প্রটেকশন ইউনিট (YPJ) নামে এদের একটি নারী যোদ্ধাদের দলও আছে, যারা YPG এর পাশাপাশি আইএস বিরোধী যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে।
২০১৪ সালে PYD এর নেতৃত্বে অন্যান্য কুর্দি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত কুর্দিস্তান ন্যাশনাল কাউন্সিল (KNC) তিনটি কুর্দি প্রধান এলাকা আলেপ্পো, রাক্কা এবং হাশাকার অংশবিশেষ নিয়ে স্বায়ত্ত্বশাসিত গণতান্ত্রিক সরকারের ঘোষণা দেয়। ২০১৪-১৫ সালে আইএস একের পর এক বিভিন্ন এলাকা দখল করতে থাকলে, কুর্দিরা তাদের বিরুদ্ধে অন্যতম শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে আবির্ভূত হয়। ২০১৫ সালে তারা মার্কিন বিমান হামলার সহায়তায় সিরিয়ার কোবানি শহরকে আইএসের হাত থেকে মুক্ত করে।
২০১৫ সালের শেষের দিকে YPG-এর নেতৃত্বে আরব এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স (SDF), যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় আইএসের হাত থেকে সিরিয়ার বিশাল এলাকা মুক্ত করে। সম্প্রতি আইএসের তথাকথিত রাজধানী রাক্কা মুক্তকরণ অভিযানেও নেতৃত্ব দিচ্ছে এই কুর্দি নেতৃত্বাধীন SDF।
ইরাকি কুর্দিস্তানের ইতিহাস
ইরাকি জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগই কুর্দি। সিরিয়া এবং তুরস্কের তুলনায় তারা তুলনামূলকভাবে বেশি অধিকার ভোগ করেছে, কিন্তু এর জন্য তাদেরকে মূল্যও দিতে হয়েছে অনেক। ১৯২৩ সালে লুসান চুক্তির পরপরই সাবেক কুর্দি গভর্নর শেখ মাহমুদ বারিজিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। তিনি ইরাকের সুলায়মানিয়াতে কুর্দি রাজতন্ত্র ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা তাকে পরাজিত করে সুলায়মানিয়া দখল করে নেয়।
১৯৪৬ সালে মুস্তফা বারজানি (বর্তমান ইরাকের কুর্দিস্তান রেজিওনাল গভর্নমেন্টের প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানির বাবা) কুর্দিদের স্বায়ত্ত্বশাসন আদায়ের উদ্দেশ্যে কুর্দিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (KDP) প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের আন্দোলনের মুখে ইরাকের নতুন সংবিধানে কুর্দিদেরকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, কিন্তু তাদের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি নাকচ করে দেওয়া হয়। ফলে ১৯৬১ সালে কেডিপি ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকার উত্তর ইরাকের কুর্দি এলাকাগুলোকে আরবিকরণের উদ্দেশ্যে লক্ষ লক্ষ কুর্দিকে বাস্তুচ্যুত করে এবং সেসব এলাকায় মধ্য ও দক্ষিণ ইরাক থেকে আনা আরবদেরকে স্থানান্তরিত করে। বিশেষ করে ইরাকের তেল সমৃদ্ধ অঞ্চল কিরকুক থেকে কুর্দিদেরকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা হয়।
কুর্দিদের উপর ইরাকি সরকারের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়, যখন কুর্দিরা ইরানকে সমর্থন দেয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সরকার কুর্দিদের অন্তত ৪,০০০ গ্রাম ধ্বংস করে দেয় এবং সেসব এলাকার অধিবাসীদেরকে অন্যান্য শহরে স্থানান্তরিত করে। ১৯৮৮ সালে সাদ্দাম সরকার ইরাকের হালাবিয়া শহরে কুর্দিদের উপর গ্যাস আক্রমণ করে, যাতে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ নিহত হয়।
ইরাকি কুর্দিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন
১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের পরাজয়ের পর মাসুদ বারজানির নেতৃত্বে কুর্দিরা পুনরায় বিদ্রোহ করে এবং কিরকুক সহ ইরাকি কুর্দিস্থানের বিশাল এলাকা দখল করে নেয়। সাদ্দাম সরকার পাল্টা আক্রমণ শুরু করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ইরাকের উত্তরাঞ্চলে কুর্দিপ্রধান এলাকাগুলোতে নো-ফ্লাই জোন কার্যকর করে। ফলে কুর্দিরা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্বায়ত্ত্বশাসনের সুযোগ পায়।
KDP ইরাকি কুর্দিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন হলেও, জালাল তালাবানি সহ অন্যান্য নেতারা মতপার্থক্যের কারণে ১৯৭৫ সালে KDP থেকে বেরিয়ে প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন অফ কুর্দিস্তান (PUK) নামে পৃথক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে। ১৯৯২ সালে উভয় দল মিলে স্থানীয়ভাবে সংসদীয় এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করে এবং স্বায়ত্ত্বশাসিত সরকার, কুর্দি রেজিওনাল গভর্নমেন্ট (KRG) গঠন করে। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে KDP এবং PUK এর মধ্যকার সমঝোতা ভেঙ্গে পড়ে এবং তারা দীর্ঘদিনব্যাপী গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
ইরাকি কুর্দিস্তানকে সামরিক বাহিনীর নাম পেশমার্গা। ধারণা করা হয়, এর সদস্য সংখ্যা প্রায় পৌনে তিন লাখ। ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনী ইরাক আক্রমণ করলে পেশমার্গারা সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। সাদ্দামকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পেশমার্গা বাহিনী ২০০৪ সালে আল-কায়েদা নেতা হাসান আল-গুলকে গ্রেপ্তার করে, যার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পরবর্তীতে ওসামা বিন লাদেনের সন্ধান পাওয়া যায়।
সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর দেশব্যাপী গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে ইরাকিরা তাদের সংবিধানে কুর্দিস্তান রেজিওনাল গভর্নমেন্ট (KRG) এবং কুর্দি সংসদকে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৫ সালে ইরাকি সংসদ PUK নেতা জালাল তালাবানিকে ইরাকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে।
কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার গণভোট
২০১৪ সালে জঙ্গি সংগঠন আইএস যখন ইরাকি সরকারি বাহিনীকে পরাজিত করে একের পর এক বিস্তৃত এলাকা দখল করে নিচ্ছিল, তখন কুর্দি পেশমার্গা বাহিনী তাদের অধিকৃত এলাকাগুলো রক্ষা করার জন্য আইএসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আইএসের হাতে সিনজারের পতন হলে সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইয়াজিদিরা যখন গণহত্যার শিকার হয়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী আইএসের উপর বিমান হামলা শুরু করে এবং পেশমার্গাদের নেতৃত্বে কুর্দিরা আইএসের হাত থেকে দখলকৃত এলাকাগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য অভিযান শুরু করে।
KRG নেতারা আইএসের উত্থানকে ইরাকি কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখে এবং ইরাক থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ গণভোটের আয়োজন করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু আইএস বিরোধী যুদ্ধ আরো ছড়িয়ে পড়লে গণভোট প্রসঙ্গ বারবার পেছাতে থাকে। অবশেষে এ বছর আইএসের হাত থেকে মসুল সহ ইরাকের অধিকাংশ এলাকা মুক্ত হওয়ার পর নতুন করে গণভোটের ব্যাপারটি আলোচনায় আসে। অবশেষে গত ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ তারিখে ইরাকি সরকার এবং প্রতিবেশী ইরান ও তুরস্কের প্রবল প্রতিবাদের মুখে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটে ইরাকি কুর্দিস্তানের ৯৩ শতাংশ ভোটার স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়।
কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে একমাত্র ইসরায়েল ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রকেই প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে দেখা যায়নি। ইসরায়েল নিজে ফিলিস্তিনি ভূমি অবৈধভাবে দখল করে রাখলেও, সমসাময়িক কুর্দি এবং কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার ব্যাপারে তারা উচ্চকন্ঠে সমর্থন দিচ্ছে। তবে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অধিকাংশ রাষ্ট্রই এই মুহূর্তে কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার দাবির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইরাকি কুর্দিস্তানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানি অবশ্য এখনও স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে, গণভোটের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করে অধিকতর অধিকার এবং স্বয়ত্ত্বশাসন অর্জনই তাদের মূল লক্ষ্য।
ইরাকি কুর্দিস্তান চারিদিক থেকে ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক ও ইরান দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাদের কেউই কুর্দিস্তানের স্বাধীনতা চায় না। কাজেই জোর করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেও কুর্দিস্তানের জন্য সেটা বাস্তবসম্মত হবে না। অপরদিকে যেহেতু গণভোটের ফলাফল থেকে দৃশ্যমান যে, অধিকাংশ কুর্দিই স্বাধীনতার পক্ষে, তাই তাদের সাথে আলোচনা না করে ইরাকি সরকার এবং প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো যদি জোরপূর্বক তাদের অধিকার দমন করতে চায়, সেটাও ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না। বিশেষত যেখানে ইসরায়েল সহ কিছু সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠি যেকোনো বিভেদকে কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি করার ব্যাপারে উদগ্রীব।
একমাত্র আলোচনাই পারবে এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান এনে দিতে, যেখানে সকল পক্ষই লাভবান হবে এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করেও কুর্দিরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় পারবে। কিন্তু আলোচনায় না বসে যদি কুর্দিরা তাদের স্বাধীনতার দাবিতে অনড় থাকে, অথবা ইরাক সরকার এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও যদি তাদের অধিকারের ব্যাপারে তাদের সাথে আলোচনায় বসতে রাজি না হয়, তাহলে হয়তো এই কুর্দিস্তানকে কেন্দ্র করে উত্তাল মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধ, যেটাতে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হবে মুসলমানরাই।