ধর্ষণ কিংবা যৌন নিপীড়ন আজকাল নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পত্রিকা বা ফেসবুকের নিউজফিড খুললেই দেখা যায় এসব খবরেরই ছড়াছড়ি। শুধু আমাদের দেশেই নয়, গোটা বিশ্বে প্রতিনিয়ত ঘটছে যৌন নিপীড়নের ঘটনা। তিন বছরের শিশু থেকে শুরু করে পরিণত বয়সের নারীরাও হচ্ছেন এই বর্বরতার শিকার। শোবিজে যাদের বিচরণ, তারা সমাজের অন্য নারীদের চেয়ে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থায় থেকেও যখন যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হন, তখন বোঝা যায়, এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাধারণ মহিলা থেকে শুরু করে বিখ্যাত অভিনেত্রীরাও এই তালিকার বাইরে পড়ছেন না। যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া অভিনেত্রীদের দীর্ঘ তালিকায় চোখ বুলালে লজ্জিতই হতে হবে আমাদের।
কিছুদিন আগে হলিউডের নামকরা চলচ্চিত্র প্রযোজক হার্ভে ওয়েইনস্টাইনের নামে বেশ কিছু অভিযোগ উঠলে তার সদস্যপদ বাতিল করা হয়। অনেকটা সেই ঘটনারই রেশ ধরে এবারে ক’জন নামকরা অভিনেতার নামেও উঠেছে যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের অভিযোগ। আসলে ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ক্ষমতা থাকলেই যেন কাউকে শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে হয়রানি করাটা জায়েজ হয়ে যাচ্ছে। কেননা, ক্ষমতাবান পুরুষদের এভাবে যৌন হয়রানির অভিযোগ নতুন খবর নয়। গত কয়েক বছর ধরে আমরা সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বেশ কজন ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে এসেছি। সেই তালিকায় আছেন বিল ও’রাইলি, আর. কেলী, লুইস সিকে, উডি অ্যালেন এবং ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের মতো ব্যক্তিবর্গ। আজকে তাদের মতো আরও কয়েকজন হলিউড পুরুষদের কথা তুলে ধরা হবে আপনাদের সামনে।
বেন অ্যাফ্লেক
বর্তমান সময়ের নাম করা অভিনেতাদের তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন বেন। ‘গুড উইল হান্টিং’ এর পর ‘আর্গো’ সিনেমা জন্যে অস্কার পাওয়ার আগে থেকেই অভিনেতা খেতাবের পাশাপাশি পরিচালক হিসেবে ভালোই সুনাম কামিয়ে নিয়েছেন তিনি।
তার নামেও উঠেছ যৌন হয়রানির অভিযোগ। বর্তমানে ৪৫ বছর বয়সী এই অভিনেতা ২০০৩ সালে টোটাল রিকুয়েস্ট লাইভ অনুষ্ঠানে এমটিভি হোস্ট হিলারি বার্টনকে অযাচিতভাবে স্পর্শ করেন। সম্প্রতি ওয়েইনস্টাইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আলোচনায় আসার পর বেন নিজে নারীদের প্রতি ওয়েইনস্টাইনের অসদাচরণের নিন্দা করেন। এর ঠিক পরপরই তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগটি পুনরায় আলোতে আসে। অবশ্য পরদিনই বেন সামাজিক মাধ্যমে এই নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। নিজের টুইটারে অভিনেতা লিখেছেন,
“আমি অজান্তেই মিস বার্টনের প্রতি অনেক খারাপ ব্যবহার করে ফেলছি। সেজন্য আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি।”
রবার্ট নেপার
আসল নামে কেউ তাকে সহজে না চিনলেও এই মানুষটি ভক্তদের মাঝে টি-ব্যাগ হিসেবেই বহুল পরিচিত। নামকরা টেলিভিশন ধারাবাহিক প্রিজন ব্রেকে তিনি অভিনয় করেছেন একজন ভিলেন হিসেবে এবং তার সেই চরিত্রটি অপহরণ, ধর্ষণ ও খুনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছে। এছাড়াও সিরিজে তাকে মাঝে মধ্যেই তার হাতে অনেককেই যৌন হয়রানির শিকার হতে দেখা যায়।
তবে সেটা ছিল অভিনয়ের একটা অংশ। কিন্তু সম্প্রতি তার নামে বাস্তব জীবনেও যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। ১৯৯২ সালে মুক্তি পাওয়া গ্যাস, ফুড লজিং সিনেমার শুটিং সেটে তিনি পোশাক ডিজাইনার সুজান বারত্রামকে জাপটে ধরে বলেন, “I’m going to f*** your brains out.”
সুজান জানিয়েছেন,
“আমি সেখানেই বসে বসে কাঁদছিলাম। আমার শতচ্ছিন্ন কাপড়… আমি স্রেফ ওখানে বসে ছিলাম, নিজেকে কোনোক্রমে ধাতস্থ করে ওয়ারড্রব ট্রেলারে ফিরে গিয়েছিলাম।”
ডাস্টিন হফম্যান
৮০ বছর বয়সী অস্কার বিজয়ী এই অভিনেতার নামে এখন পর্যন্ত মোট তিনজন নারী যৌন হয়রানি অভিযোগ তুলেছেন। প্রথম অভিযোগটি ওঠে নভেম্বর মাসের এক তারিখ। ‘দ্য হলিউড রিপোর্টার’ প্রকাশিত এক আর্টিকেলে অ্যানা গ্রাহাম হান্টার অভিযোগ করেছেন, ১৯৮৫ সালে নির্মিত ডেথ অব অ্যা সেলসম্যান টিভি মুভির শুটিং সেটে হফম্যান তাকে জড়িয়ে ধরেন এবং তার সামনেই অশ্লীল কথাবার্তা বলেন। ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন অ্যানার বয়স ছিল মাত্র সতের বছর এবং তিনি ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করছিলেন। অভিযোগ ওঠার পর হফম্যান সেই ঘটনার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন,
“নারীদের প্রতি আমাদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা রয়েছে। আমার ভেবে খুবই খারাপ লাগছে যে, আমি এমন কিছু করেছি যার জন্যে তাকে (অ্যানা) অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। আমি সত্যি খুবই দুঃখিত”
ঘটনা এ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে হয়তো ভালোই ছিল। কিন্তু সেদিনই তার বিরুদ্ধে উঠে দ্বিতীয় অভিযোগ। প্রযোজক ওয়েন্ডি রিজ ভেরাইটির এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কুড়ি বছর বয়সের সময় তিনি যখন নাট্যকার হিসেবে কাজ করতেন, তখন হফম্যান তাকে একটি কাছাকাছি হোটেলে যেতে রাজি করানোর চেষ্টা করেছেন।
হফম্যানের বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগটি করেছেন স্বয়ং মেরিল স্ট্রিপ। তিনি বলেছেন, ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সময় তাদের যখন প্রথমবারের মতো পরিচয় হয়, তখন হফম্যান এসে মেরিলের স্তন চেপে ধরে বলেন, “আমি ডাস্টিন *শব্দ করে ঢেকুর তুলেন* হফম্যান”
স্টিভেন সিগাল
বর্তমান সময়ে হয়তো সিগালের তেমন একটা পরিচিতি নেই, তাছাড়া তার সিনেমা গুলো আগের মতো সাড়া জাগাতে পারছেনা। তাই হয়তো নব্বইয়ের দশকে দর্শক মাতিয়ে বেড়ানো এই অ্যাকশন হিরো এতদিন ঠিক সেভাবে আলোচনায় আসেননি। সম্প্রতি নভেম্বর মাসের ৮ তারিখের পর তিনি আবার আলোচনায় এসেছেন, তবে কোন সিনেমার জন্যে নয়; যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে।
অস্ট্রেলিয়ান অভিনেত্রী পরশিয়া ডি রসি অভিযোগ করেছেন, সিগালের সাথে ব্যক্তিগত অফিস অডিশনের সময় সিগাল তাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে তার সামনে প্যান্টের চেইন খুলে দাড়িয়ে থাকেন। তার ভাষ্যে,
“অফিসে ঢুকেই তিনি আমাকে বললেন, ‘পর্দার বাইরেও আমাদের মধ্যে ভাল একটা কেমিস্ট্রির প্রয়োজন আছে।’ বলেই তিনি আমাকে বসিয়ে দিয়ে নিজের লেদার প্যান্টের চেন খুলে দিলেন।”
এই অভিযোগ আসার পরদিনই তার নামে আরও একটি অভিযোগ তুলেছেন আকর্ষণীয় চেহারার মার্কিন অভিনেত্রী জেনি ম্যাকার্থি। সাবেক প্লেবয় মডেল বলেছেন, আন্ডার সিগ ২ সিনেমার অডিশনের সময় সিগাল তাকে নগ্ন হতে বলেন।
“সে আমাকে ইমপ্রেস করার জন্যে নিজের ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছিল। বিভিন্নভাবে নিজের প্রশংসা করার এক পর্যায়ে বলে উঠে ‘জানো তো, এই সিনেমায় কিছু নগ্ন দৃশ্যে তোমাকে শট দেয়া লাগবে আর তোমার পরনে থাকা কাপড়ের কারণে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তোমার শরীর সে দৃশ্যগুলোর জন্যে নিখুঁত কিনা।’”
এই কথার পর জেনি, সিগালকে বলেন যে, তার এজেন্ট বলেছেন এই সিনেমাতে কোন প্রকার নগ্ন দৃশ্য নেই। তখন সিগাল বলে উঠেন, “এটা হল ক্যামেরার বাইরের নগ্নতা।” তারপর তিনি জেনিকে বুকের কাপড় নামাতে বলেন যাতে তিনি তার নগ্ন বক্ষ দেখতে পারেন।
কেভিন স্পেসি
“একজন অভিনেতা হিসেবে অ্যান্থনি র্যাপের জন্যে আমার যথেষ্ট সম্মান রয়েছে। সম্প্রতি তার অভিযোগটি শোনার পর আমি নিজেও বেশ খানিকটা আতংকিত হয়ে পড়েছি। তবে বিশ্বাস করুন, ত্রিশ বছরে আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুই আমার মনে নেই। তবে তার বর্ণনা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমার সেই মাতাল আচরণের জন্যে আমি তার কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। আমার আসলেই অনেক খারাপ লাগছে ভেবে যে, সে এতদিন এই অনুভূতি নীরবে বয়ে বেড়িয়েছে।”
গত মাসের (অক্টোবর) ৩০ তারিখ তার নামে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পর নিজের টুইটার একাউন্টে এই বিবৃতি প্রকাশ করেন অভিনেতা কেভিন স্পেসি। এছাড়াও আরও ১৫টির মতো অভিযোগের পর কেভিন প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে প্রকাশ করেন যে তিনি একজন সমকামী।
অভিনেতা অ্যান্থনি র্যাপ অভিযোগ করেছেন- ত্রিশ বছর আগে ১৯৮৬ সালে, (তার বয়স তখন ১৪ ও কেভিন স্পেসির বয়স ২৬) স্পেসি অ্যান্থনিকে ধর্ষণ করার অপচেষ্টা চালান। তার এই বক্তব্যের পর কেভিন স্পেসি তার কাছে ক্ষমা চান এবং নিজের সমকামিতার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন। তবে অনেকেই তার এই বক্তব্যকে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র সাথে তুলনা করেছেন।
এছাড়া কেভিন স্পেসির বিপক্ষে এই অভিযোগ ওঠার পর নেটফ্লিক্স তার অভিনীত ‘হাউজ অফ কার্ডস’ ধারাবাহিকটি বন্ধ করে দিয়েছে।