হুয়াওয়ের তথ্য পাচার বিতর্ক: কতটুকু সত্য, কতটুকু মিথ্যা

চীনের সাথে আফ্রিকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক গত দুই দশক ধরে মধুর থেকে মধুরতরই হয়েছে। অর্থমূল্যে তাদের পারস্পারিক বাণিজ্যে প্রতিবছর ২০ শতাংশ বৃদ্ধি এককথায় বিস্ময়কর। ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় অবস্থিত আফ্রিকান ইউনিয়নের (এইউ) চকচকে আকাশচুম্বী সদর দপ্তর ভবন যেন তাদের চকচকে বাণিজ্যিক সম্পর্কেরই প্রতীকী রূপ। এই ভবনটিও নির্মিত হয়েছে চীনেরই ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তায়। অথচ ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের পর থেকে হঠাৎ করেই মধুর সম্পর্কে তিক্ততার আঁচ পাওয়া গেল। চীন আর এইউ’র সম্পর্ক যদি একটি শহর হয়, ‘লে মন্ড’ নামক একটি ফরাসি পত্রিকা যেন সেই শহরে পারমাণবিক বোমা ফেলেছে!

আফ্রিকান ইউনিয়নের হেডকোয়ার্টয়ার; Image Source: bbc.co.uk

এইউ’র সদর দপ্তরে স্থাপন করা হয়েছিল ‘স্টেট অব দ্য আর্ট’ কম্পিউটার সিস্টেম। এর অর্থ হলো, সেখানকার কম্পিউটার ব্যবস্থা সর্বাধুনিক এবং সময়ের সাথে প্রতি মূহুর্তে আসা নতুন প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়া সেটি ব্যবহার করতে সক্ষম। এর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও করা হয়েছিল অত্যাধুনিকভাবে। অথচ সেটি সদর দপ্তর চালু হবার দিন থেকেই প্রতারিত হয়ে আসছিল! টানা আঠারশ দিন এইউ’র সদর দপ্তর থেকে মধ্যরাতে, যখন অফিশিয়াল কার্যক্রম বন্ধ থাকে, সদর দপ্তরের যাবতীয় তথ্য পাচার হয়ে চলে গেছে চীনের সাংহাই শহরে! এমনকি ভবনের দেয়াল ও আসবাবপত্র থেকে মাইক্রোফোন, মাইক্রোচিপস ও বিভিন্ন তথ্য পাচারের যন্ত্রাংশ পাবার অভিযোগও আছে! এর প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই ভয়াবহ হবার কথা। হয়েছেও তা-ই। তথাপি এইউ এবং চীন, উভয়েই এই খবরকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু, তাদের এই লুকোচুরি খেলার মাঝে ঘটনাক্রমে কিংবা দুর্ভাগ্যক্রমে ফেঁসে গেছে একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। তার নাম হুয়াওয়ে।

Image Source: straitstimes.com

এইউ’র সদর দপ্তর ভবনে কারিগরি ও প্রাযুক্তিক ব্যবস্থা সরবরাহ করেছে চীনের এই বহুল জনপ্রিয় কোম্পানি হুয়াওয়ে। আর তাতেই এখন সন্দেহে তীর ক্রমাগত ধেয়ে যাচ্ছে তাদের দিকেও। এমনকি অনেক পত্রিকায় সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছে যে, ইউরোপে সরবরাহ করা হুয়াওয়ের প্রযুক্তিগুলো চীনের নজরদারিতে ব্যবহৃত হচ্ছে! তবে এগুলো নিছকই অভিযোগ। অনেকের মতে, এসব অভিযোগ আমলে নিতে চাননি অস্ট্রেলিয়ার স্ট্রাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের প্রধান ডেনিয়েল কেইভও। তার মতে, হুয়াওয়ে এইউ’র দপ্তরে আইসিটি সার্ভিস সরবরাহ করেছিল বলেই তারা এই তথ্য পাচারের সাথে যুক্ত ছিল, এমন ধারণা ঠিক নয়। তবে দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবৎ তথ্যপাচারের ঘটনা হুয়াওয়ের টের না পাওয়াটা কিছুটা হলেও বিস্ময় জাগানিয়া বলে মনে করেন তিনি।

মজার ব্যাপার হলো, এইউ’র দপ্তর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে বিশাল পরিমাণ তথ্য পাচারের ব্যাপারটি এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। এমনকি কেউ এখনো পর্যন্ত অভিযুক্ত হননি কিংবা স্বীকারোক্তিও দেননি। কেবল পত্রপত্রিকায় সংবাদ এসেছে এবং তা উভয়পক্ষই অস্বীকার করেছে। তাহলে এতে হুয়াওয়ে ফেঁসে গেল কেন? কারণ হুয়াওয়েকে দীর্ঘদিন ধরেই একপ্রকার সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছিল একশ্রেণীর মানুষ। তাদের যুক্তি এরকম, চীনের একদলীয় সরকারের প্রভাব থেকে হুয়াওয়ের পক্ষে মুক্ত থাকা সম্ভব নয়। সরকার ইচ্ছা করলেই হুয়াওয়ে ব্যবহার করে নজরদারি করতে পারে। কিন্তু হুয়াওয়ে বলছে, এরকম অভিযোগ হাস্যকর। কারণ, এইউ দপ্তরে তারা কেবল ডাটা সেন্টারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সরবরাহ করেছিল। সেসব প্রযুক্তিতে কোনো তথ্য সংরক্ষণ এবং পাচার করার সক্ষমতা ছিল না!

হুয়াওয়ের চেয়ারম্যান রেন ঝেংফেই; Image Source: gnsnews.co.in

পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল ফোন নির্মাতা কোম্পানি হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের উত্তর দিতে গিয়ে এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান রেন ঝেংফেই কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। নিজের অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত জীবনের ইতিহাসকে তিনি যেখানে পৃথিবীর অন্যতম সফল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত করতে পেরেছেন, সেখানে প্রতারণার ছিটেফোঁটাও ছিল না বলেই তার বিশ্বাস। ৯০’র দশকে চীনে যখন সবে বাজার অর্থনীতি প্রচলিত হতে শুরু করেছে, তখন দরিদ্রতম মানুষটির হাতেও প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছিলেন রেন। শুরুর পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি বছরে ২০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক আয় করতে শুরু করে। ২১ শতকের শুরু থেকেই এটি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে একটি বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান।

এদিকে, কেবল তথ্য পাচারের অভিযোগই হুয়াওয়ের মূল সমস্যা নয়। সমস্যার সূত্রপাতে অবদান আছে আরো একটি ঘটনারও। গতবছর ডিসেম্বরেও জি-২০ সম্মেলনে ট্রাম্প আর শি জিনপিংয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। ট্রাম্প তো সেবার টুইট করেছিলেন যে, দুই দেশের সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় স্থাপিত হয়েছে। অথচ ডিসেম্বরেই দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়, যার সাথে দুর্ভাগ্যক্রমে সম্পর্কিত আছে হুয়াওয়েও। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান রেনের জ্যেষ্ঠ কন্যা মেং ওয়ানঝু গ্রেফতার হন কানাডায়। আর এই গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে, ইরান বিষয়ক অবরোধনীতি উপেক্ষা করায়। এখান থেকেই শুরু হুয়াওয়ের জটিল সমস্যা।

মেং ওয়ানঝুকে গ্রেফতার করা হচ্ছে; Image Source: .irishtimes.com

২ মাসের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ মেং এবং হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে ২টি অভিযোগ দাখিল করে। প্রথম অভিযোগটি হলো, ইরানে তাদের ব্যবসা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে ভুল তথ্য দেয়া। আর দ্বিতীয় অভিযোগটি বাণিজ্যিক গোপন তথ্য হাতিয়ে নেবার প্রচেষ্টা। মেং তার অভিযোগ অস্বীকার করলেও হুয়াওয়ে পড়েছে জটিল সমস্যায়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটি হলো, তারা ‘ট্যাপি’ নামক একটি রোবোটিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে তথ্য চুরি করতে চেয়েছিল। এই যন্ত্রাংশটি নির্মাণ করেছিল ‘টি-মোবাইল’ কোম্পানি, যারা ভবিষ্যৎ বিপদের আশংকায় চুক্তি থেকে সরে আসে। ফলত, হুয়াওয়ের এমন প্রচেষ্টা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু, এই যন্ত্রাংশ তৈরির প্রক্রিয়া জানবার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত হুয়াওয়ের এক কর্মকর্তা ট্যাপি চুরি করেছিলেন। ধরা পড়ার পর তিনি জানান যে, যন্ত্রাংশটি ভুলক্রমে তার ব্যাগের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল!

টি-মোবাইলের ট্যাপি রোবট; Image Source: seattletimes.com

পরবর্তীতে হুয়াওয়ে দাবি করে, ঐ কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ব্যতীতই এ কাজ করেছিল। এই মামলা আদালতে নিষ্পত্তিও হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে যে অভিযোগটি আসছে, তা এখনো পর্যন্ত কোনো সমাধানের দিকে এগোয়নি। তাছাড়া, একাধিকবার অভিযোগের আঙ্গুল ওঠা হুয়াওয়ের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব আগে থেকেই ভালো না। ৫ম প্রজন্মের ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে সামনে রেখে তারা ইতোমধ্যে তাদের সহযোগী দেশগুলোকে সতর্ক করেছে হুয়াওয়ে সম্বন্ধে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তো কড়া ভাষায় বলে দিয়েছেন, “যেসব দেশ তাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংক্রান্ত ব্যবস্থায় হুয়াওয়ের প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, তাদের সাথে আমরা কোনো তথ্য আদানপ্রদান করবো না!” তার এই উক্তিকে অনেকেই হুয়াওয়ের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ অবরোধ হিসেবেই দেখছেন।

এদিকে পম্পেওর বক্তব্যের পর নড়েচড়ে বসেছে যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং জার্মানি। হুয়াওয়ের সাথে নিজেদের সম্পর্ক এবং প্রতিষ্ঠানটি নিরাপত্তার জন্য হুমকি কি না, তা পুনর্বিবেচনা করে দেখছে দেশগুলো। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান রেন বলেন, “হুয়াওয়ের প্রযুক্তি কখনোই নজরদারিতে ব্যবহৃত হয়নি এবং হবেও না। এর কোনো প্রমাণ নেই।” কিন্তু রেনের এই কথায় ভরসা করতে পারছেন না সমালোচকগণ। কেননা, চীনের প্রতিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও বাধ্যতামূলকভাবে কমিউনিস্ট পার্টির একটি কমিটি থাকতে হবে। সরকারিভাবে এ কমিটির কাজ হলো রাষ্ট্রীয় নীতি ও কমিউনিস্ট ভাবধারা থেকে কোনো প্রতিষ্ঠানকে বিচ্যুত হতে না দেয়া। কিন্তু সমালোচকদের দাবি, এ কমিটিগুলো সক্রিয়ভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর সরকারের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বজায় রাখে। এ প্রসঙ্গেও রেনের জবাব আছে। তিনি জানান, হুয়াওয়ের কমিউনিস্ট কমিটি প্রতিষ্ঠানটির কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে থাকে না। তাদের একমাত্র কাজ হলো প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের দেশীয় আদর্শ ও চেতনায় শিক্ষিত করা।

হুয়াওয়ের সাইবার সেন্টার; Image Source: houstonchronicle.com

২০১৯ সালের শুরুতেই হুয়াওয়ের সমস্যার ঘোলা জল আরো ঘোলা করেছে পোল্যান্ড। সেখানে তথ্য চুরির অভিযোগে গ্রেফতার হন দুজন ব্যক্তি, যাদের একজন হলেন হুয়াওয়ের এক কর্মকর্তা। ১৯ জানুয়ারি এ ঘটনার মাত্র ১০ দিন পরই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ভয়াবহ দুঃসংবাদ পায় হুয়াওয়ে। ইইউ’র অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে হুয়াওয়ের সকল ধরনের প্রযুক্তি বন্ধ করা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা উত্থাপন করার কথা ভাবছে সংস্থাটি। তাদের এ ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে হুয়াওয়ে এসব উদ্বেগকে হাস্যকর দাবি করেছে। রেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “হুয়াওয়ের প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের সাথে পেরে উঠতে না পেরে যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযোগ এনেছে!” তাছাড়া ইইউতে তারা একটি ‘সাইবার সেন্টার’ খুলেছে যাকে তারা অভিহিত করছে তথ্যের ‘ব্ল্যাক বক্স’ হিসেবে। এটি ইউরোপে হুয়াওয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নির্ধারণে কাজ করবে। প্রতিষ্ঠানটির এই পদক্ষেপ জনমনে সন্দেহ দূর করবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। আপাতত, অনিশ্চিত সময় পার করছে কোম্পানিটি।

This article is written in Bangla language. Its about the roumor of Tech giant Huawei being involved in an information spying.
All necessary references are hyperlinked inside the article.

 

Featured Image: msn.com

Related Articles

Exit mobile version