Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইয়ো জং: উত্তর কোরিয়ার স্বৈরতন্ত্রের পর্দার পেছনের শাসক

উত্তর কোরিয়া- আজকের বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে দেশগুলোর নাম না আসলেই নয় তাদের মধ্যে অন্যতম। বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলেও খুব কম সময়ের মধ্যেই দেশটি হয়ে উঠেছে অন্যতম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। অন্যন্য শক্তিধর দেশগুলোর হুমকির তোয়াক্কা না করে একের পর এক অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এখন দেশটি রয়েছে আলোচনার শীর্ষে। আর এই দেশের শাসনব্যবস্থা তো বিশ্বরাজনীতির আলোচনার অন্যতম মূল বিষয়।

বিগত কয়েক দশক থেকেই উত্তর কোরিয়ায় চলছে পারিবারিক স্বৈরশাসন। কিম জং উনের পরিবারের কাছেই যুগের পর যুগ থেকে দেশটির সর্বোচ্চ ক্ষমতা গচ্ছিত আছে। ক্ষমতাসীন ব্যক্তির মনোনীত পরিবারিক সদস্যই পরের প্রজন্মের স্বৈরশাসক হিসাবে দেশ শাসন করে। পুরুষতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নারীদের সেখানে তেমন ভূমিকা নেই বললেই চলে। কিংবা ভূমিকা থাকলেও নারীদের সেখানে মিডিয়ার আড়ালে রাখার চেষ্টাই বেশি করা হয়। কিন্তু আড়াল করার চেষ্টা যত বেশি, মানুষের আগ্রহও বাড়ে তত বেশি।

আলোচিত এই দেশটির ক্ষমতাসীন পরিবারের প্রভাবশালী নারী সদস্যদের নিয়ে তাই বিশ্বগণমাধ্যম বেশ ভালোই আগ্রহ দেখিয়ে থাকেন। ২০১২ সালে সবার দৃষ্টিতে আসা বর্তমান স্বৈরশাসক কিম জং উনের স্ত্রী রি সোল জুয়ের বর্তমান, অতীত, জীবনধারা, এমনকি তার ব্যবহৃত পোশাক বা ব্যাগের ব্র্যান্ড নিয়েও বিশ্লেষকদের আগ্রহের শেষ নেই। কিন্তু রি ছাড়াও আরো একজন নারী আছেন এই পরিবারে যিনি যথেষ্ট আড়ালে থাকলেও বিশ্লেষক, অনুসন্ধানকারী, গণমাধ্যম, এমনকি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও উত্তর কোরিয়ার রাজনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহী, এমনকি চিন্তিতও। আবার অনেক গবেষক ও পর্যবেক্ষক এটাও বলেন যে, কিম কেবল সবার দৃষ্টি ধরে রাখার জন্য এক মানসমূর্তি। প্রকৃতপক্ষে সকল পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্তের পেছনে এই নারীর পরিকল্পনা থাকে। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কলকাঠি নেড়ে যাওয়া এই নারী কিমের বোন কিম ইয়ো জং, কদাচিৎই যার দর্শন পাওয়া যায়।

বরাবরই ভাইয়ের স্নেহধন্য আর বিশ্বস্ত তিনি; Source: newsbreak.ng

কিম জং উনের বর্তমান উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী, একচ্ছত্র ক্ষমতাবান। সেইসাথে জনগণের কাছাকাছি থাকা অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা হিসাবে যে প্রতিমূর্তি আধুনিক বিশ্ব দেখছে তার পিছনে পরিকল্পনাকারী এবং সর্বদা সতর্ক অবস্থানে থাকা মস্তিষ্কগুলোর মধ্যে একটি যে কিমেরই ছোট বোন কিম ইয়ো জং- সে বিষয়ে তেমন কোনো সন্দেহ নেই বললেই চলে। বিশেষ করে ২০১২ সালে যখন থেকে দেখা যায়, নারী হওয়া সত্ত্বেও ইয়ো তরতর করে সেখানকার ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ থেকে উচ্চতর পদে বহাল হচ্ছেন। অসুস্থ কিম বোনের হাতে নির্দ্বিধায় দায়িত্ব অর্পণই বলে দেয় ইয়োর ওপর তার কতখানি বিশ্বাস আছে।

এমনকি বিশ্লেষকরা এটাও বলে থাকেন, জনগণের হাসপাতাল, নতুন স্কুল, অনাথ বাচ্চাদের আশ্রয়স্থল থেকে শুরু করে সরকারী কর্মকর্তা বা সাধারণ মানুষদের আবাসস্থল নিয়মিত পরিদর্শন করার কিমের যে জনদরদী রূপ আছে তা ইয়োরই পরিকল্পনা। বলাই বাহুল্য, ভাইবোনদের মাঝে কিমের সবচেয়ে কাছের ও স্নেহধন্য এই বোনই উত্তর কোরিয়ায় তার একচ্ছত্র রাজত্বের সামনে এক অন্যতম শক্তিশালী দুর্গ।

দেশের শাসনব্যবস্থায় ইয়োর প্রভাব স্বীকার করতেই হবে; Source: newindianexpress.com

বয়সের দিক থেকেও কিমের সাথে ইয়োর দূরত্ব খুব বেশি নয়। মাত্র চার বছরের ছোট ইয়ো প্রথম ক্যামেরাবন্দি হন ২০১০ সালে তাদের দল কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টির সম্মেলনে। এর পূর্বে তার দর্শন পাওয়া ছিলো খুবই বিরল ঘটনা। ২০১০ সালের পর থেকে ইয়োকে প্রায়ই বাবা কিম জং ইলের সাথে বিভিন্ন যাত্রায় দেখা যেতো। ২০১১ সালে বাবার মৃত্যুর পর ভাইয়ের পাশে থেকে শোক পালন করতেও দেখা যায়। ইয়োর প্রতি কিমের এই বিশ্বাস বা পক্ষপাতের কারণ তারা সহোদর বলেও হতে পারে।

বাবা কিম ইলের স্ত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন জাপানী বংশোদ্ভূত নৃত্যশিল্পী কো ইয়ং হুই। সম্ভবত তিনি ছিলেন ইলের তৃতীয় স্ত্রী। তিনিই উন আর ইয়োর মা। বলা হয়, বাবা ইলের সময়ে ফুপু ইয়ং হুইয়ের মতো ইয়ো তার ভাইয়ের বিশ্বস্ত ও প্রভাবশালী অনুগামী পরামর্শদাতা ও নিভৃত সহচর। ১৯৮৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইয়ো এই দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেড়ে ওঠার অনেকটা সময় একসাথে কেটেছে বলেই হয়তো কিম আর ইয়ো একে অপরের এত বিশ্বাসভাজন। উত্তর কোরিয়াতেই শিক্ষাজীবনের প্রথম ধাপ শেষ করে ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত কিম ও ইয়ো পরিবার থেকে দূরে সুইজারল্যান্ডে পড়াশোনা করেন।

সম্ভবত সন্তানদের ওপর দাদা কিম দ্বিতীয় সুংয়ের প্রভাব চাননি বলেই তিনি সন্তানদের পরিবার থেকে দূরে রাখেন। তাদের বাবা ছেলেমেয়েদের একসাথে রাখতেন। তাদের দেখভাল করার লোকদের কাছ থেকে শোনা যায়, বাইরের মানুষদের সাথে মেলামেশা আর নিরাপত্তার ব্যাপারে ইল ছিলেন খুবই সাবধানী। দুই ভাইবোন ব্যক্তিগত বাড়িতে থাকতো, চারপাশে থাকতো কর্মচারী আর প্রহরীদের নিশ্ছিদ্র বেষ্টনী। সুইজারল্যান্ড থেকে ফিরে ইয়ো জং কিম দ্বিতীয় সুং সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করেন বলে ধারণা করা হয়। পরে কিম দ্বিতীয় সুং বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান নিয়েও তিনি পড়াশোনা করেছেন।

ভাইবোনের সম্পর্ক বেশ ভালোই মজবুত; Source: theguardian.com

২০০০ সালের পর থেকে ভাইকে একচ্ছত্র শাসক হিসাবে অধিষ্ঠিত করার জন্য কাজ করে যান ইয়ো। ক্ষমতায় আসার পরও তিনি উনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করে পরামর্শ দেন বলে ধারণা করা হয়। উনের জনদরদী রূপ যে ইয়োরই মস্তিষ্কপ্রসূত- সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু নিজেকে সকলের দৃষ্টির আড়ালে রাখাতেই ইয়োর আগ্রহ বেশি। ২০১১ সালে বাবার মৃত্যুর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে ভাইয়ের পাশেই তাকে পাওয়া গেলেও দেশটির গণমাধ্যমে সে ব্যাপারে কোন খবর দেখা যায় না।

২০১২ সাল থেকে কিমের ভ্রমণ পরিকল্পনার সব দায়িত্ব কাগজে কলমে তার ওপর অর্পিত হলেও দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কমিশনের সাথে তিনি যুক্ত আছেন- এমন কথার উল্লেখ পাওয়া যায় খুব সামান্য। দেশটির গণমাধ্যম প্রথম ইয়োর কথা উল্লেখ করে ২০১৪ সালের ৯ মার্চ যখন তিনি উনের সাথে দেশের সর্বোচ্চ সংসদের জন্য ভোট দিতে যান। দলের গুরুত্বপূর্ণ কর্মী হিসেবে প্রথমে পরিচয় দিলেও মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে সেই বছরের ২৮ নভেম্বর তিনি ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স পার্টির একটি শাখার সহকারী পরিচালক পদ অলংকৃত করেন। পরে শাখাটির সম্পূর্ণ দায়িত্বই নেন তিনি। এরপর থেকেই প্রত্যক্ষভাবেই সক্রিয় তিনি পার্টির ক্ষমতার রাজনীতিতে। দেশটির রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থায় ইয়োর প্রভাব বিশ্বের সামনে আরো পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে যখন ২০১৪ সালের শেষের দিকে অসুস্থ কিম তার ওপর সর্বোচ্চ শাসকের দায়িত্ব দিয়ে দিতে কুন্ঠা বোধ করেন না।

রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আর বিচক্ষণতায় পারদর্শী এক নারী তিনি; Source: express.co.uk

ইয়ো পার্টির সহকারী চেয়ারম্যানের দ্বিতীয় ছেলে চো সংকে বিয়ে করেন। শোনা যায়, ২০১৫ সালের দিকে তারা প্রথম সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন। এই বিয়েও কি ইয়ো রাজনৈতিক বিচক্ষণতার নিদর্শন? তা হোক বা না হোক, সম্প্রতি ইয়ো দুই দেশের তিক্ত সম্পর্কের পরেও অতিথি সাক্ষরের খাতায় দক্ষিণ কোরিয়া নিয়ে যে মন্তব্য লিখেছেন তা তার কূটনৈতিক দক্ষতারই প্রমাণ দেয়। ইয়ো সেখানে বলেন, “আমি আশা করি পিয়ং ইয়ং ও সিউল আমাদের নাগরিকদের মনে পাশাপাশি অবস্থান করবে। আর তারা ভবিষ্যতে উন্নতি আর একাত্মতার দিকে এগিয়ে যাবে।” এত কিছুর পরও কিন্তু তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আমেরিকার কাছে আসামীর তালিকাতেই আছেন।

Featured image: independent.co.uk

Related Articles