ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি জেলা ‘পিলিভিত’। হিমালয়ের পাদদেশ ঘেঁষে ভারত-নেপাল সীমান্তে এর অবস্থান। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে গভীর সব অরণ্য। সেই অরণ্যে বাস করছে হিংস্র সব জন্তু-জানোয়ার। পশু-পাখির বৈচিত্র্যও আছে প্রচুর। সেসব জঙ্গলের ধার বেয়ে বয়ে চলে অসংখ্য ছোট ছোট নদী। আর সেই নদীর পাড়ে জঙ্গলের শেষ প্রান্তে আছে হাজার মানুষের বাস।
ভাগ্যদেবী এখানে খুব একটা সুপ্রসন্ন নয়। খাদ্যের জন্য নিয়ত সংগ্রাম এই ছন্নছাড়া মানুষদের। কখনো খাদ্যের খোঁজে বনে গিয়ে পড়তে হচ্ছে হিংস্র পশুর কবলে। দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের জোগাড়ও এদের হয়ে ওঠে না। সরকারও এসব গ্রামের প্রতি বেশ উদাসীন। উপরন্তু বন বিভাগের আইনের কড়াকড়ি দিন দিন বেড়েই চলেছে। বেআইনিভাবে গাছ কাটা এবং পশু হত্যার বিচারে প্রতিনিয়ত হাজতে পোরা হচ্ছে অনেক গ্রামবাসীকেই। নিরুপায় হয়ে গ্রামবাসী খুঁজে নিলেন অভিনব কিন্তু হৃদয় বিদারক এক পন্থা। অভাবের রোষানলে খুঁজে পাওয়া এই অদ্ভুত চিন্তাটাকে বাস্তব বিবেচনায় মানবতার পরিপন্থীই বলা যায়।
পিলিভিত যেমন বিরল প্রজাতির গাছপালার জন্য বিখ্যাত, তেমনি এর অরণ্যের গহীনে রয়েছে হিংস্র বাঘের আবাসভূমি। সরকারের বাঘ রক্ষা কর্মসূচি দিন দিন বেড়েই চলেছে এই সব অঞ্চলে। ফলে সেখানে গড়ে উঠেছে ‘পিলিভিত বাঘ সংরক্ষণ কেন্দ্র’ বা ‘পিটিআর’। ৮০০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই জঙ্গলে বাঘের আবাসভূমি। শিকার এবং শিকারির সামঞ্জস্যপূর্ণতা রক্ষা করাই এ কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য। পি টি আরের হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৩৬টির উপর বাঘের আশ্রয়স্থল এই পিলিভিত জঙ্গল।
পিলিভিত জঙ্গলের পাশেই সেই ছোট্ট গ্রাম। এ গ্রামেই একদিন সকালে গ্রামবাসীরা যখন জীবিকার খোঁজে বের হয়েছে, তখন গ্রামের শেষদিকে জঙ্গলের পাশের খোলা জমিতে একটি মৃতদেহ পাওয়া গেল। সাড়া পড়ে গেল চারিদিকে। লাশের আধ-খাওয়া শরীর দেখে বুঝতে বাকি রইল না, এ বাঘের কীর্তি। খোঁজ নিতেই নিহত বৃদ্ধের বাড়ির ঠিকানা পাওয়া গেল। পরিবারের সকলেই শোকের পরিবর্তে তড়িঘড়ি করে পিটিআরে খবর দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পিটিআর থেকে লোক এসে সরেজমিনে তদন্ত করে বাঘের থাবাতেই বৃদ্ধ হত্যা হয়েছে বলে প্রমাণ পেল। ভারতে বন বিভাগের আইন বেশ কড়া। কেন্দ্র সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, বন্য জন্তুর হামলায় মৃত্যু হলে মৃতের পরিবারকে ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। আক্রান্ত পরিবার খুব দ্রুতই ক্ষতিপূরণ পেয়ে গেল। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু গোলমালটা শুরু হলো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পর থেকে।
বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর এই ঘটনা ঘটে এ বছরের শুরুর দিকে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস শুরু হতেই, প্রথম পনের দিনের মাথায় সেই গ্রামে বাঘের কবলে মৃত্যুর সাতটি অভিযোগ জমা পড়ে পিটিআরে! কর্তৃপক্ষের তখন টনক নড়ে ওঠে। কারণ পিলিভিতের জঙ্গলটি ছিল বেশ গভীর এবং সেখানে বাঘের খাদ্যের অভাব হবার কথা নয়। আর নিতান্তই খাদ্যের অভাব না হলে বাঘ সাধারণত লোকালয়ে আসে না। এটা আরও চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, কারণ বাঘ কোনো গরু-ছাগল না মেরে সরাসরি মানুষের উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল।
পিটিআর-এর এক জরুরি বৈঠকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যের সম্মুখীন হয়। গ্রামের যে ক’জন বাঘের থাবার শিকার হয়, তাদের সকলেই ছিলেন বয়সে বৃদ্ধ। পাশাপাশি বাঘের থাবায় নিহত লাশগুলো জঙ্গলের ভেতরে কোথাও পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে জঙ্গলের বাইরে, লোকালয়ে। অর্থাৎ দেখে মনে হচ্ছিলো বাঘ লোকালয়ে এসে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।
পিটিআর কর্মকর্তারা এই ব্যাপারে উর্দ্ধতনদের অবহিত করলে ব্যাপারটি নিয়ে ব্যাপক সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ফলে পুরো বিষয়টি তখন কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরো (ডব্লিউসিসিবি) বা বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ব্যুরোকে জানানো হয়। এই প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকতা কলিম আথারকে পিলিভিত এলাকায় সংঘটিত বাঘের হামলায় মৃত্যুর ঘটনাগুলো তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি পিটিআর ও এর আশপাশে হওয়া এ ধরনের হামলাগুলো যাচাই করেন। প্রতিটি ঘটনা ও মৃতদেহ উদ্ধারের স্থানগুলো আলাদা আলাদা করে খতিয়ে দেখেন। গ্রামের নিহতদের পরিবারের সাথে কথা বলেন। কিন্তু কারো কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য উঠে আসেনি।
তদন্তের সময় এক কৃষকের প্রতি সন্দেহ হয় কলিমের। তার বয়স ষাটের উপরে, নাম জার্নেইল সিং। তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। প্রথমদিকে কিছুই বলতে চাইছিলেন না বৃদ্ধ। কিন্তু একসময় স্বীকার করেন, যেহেতু বাঘের অভয়ারণ্য বানিয়ে ফেলার কারণে বন থেকে আর সম্পদ আহরণ করা যাচ্ছে না, সেহেতু পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে বাঁচাতে এটাই একমাত্র উপায়। তখন প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি পরিবারের লোকজনই বৃদ্ধদের জোর করে ঠেলে দিচ্ছে বাঘের মুখে? জার্নেইল সেই সন্দেহ নাকচ করে দিয়ে বলেন যে, সারাজীবন অনেক পরিশ্রম করেও যখন পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারছিলেন না, তখন বাঘের হাতে মৃত্যুকেই শ্রেয় বলে মনে করেন তারা। তার মতে, গ্রামের বৃদ্ধরা স্বেচ্ছায় এই পরিকল্পনা করেন, যাতে করে পরিবারকে অনাহারে, অপুষ্টিতে মরতে না হয়।
বাঘের হামলায় মৃত্যুর পর তাদের দেহ গ্রামের কাছে জমির মধ্যে ফেলে রাখা হয়, যাতে মনে হয় গ্রামে ঢুকে হামলা চালিয়েছিল বাঘ, আর তাতেই মৃত্যু হয়েছে বৃদ্ধদের। দেহে বাঘের হামলার চিহ্ন স্পষ্ট থাকে। কাজেই বন দপ্তরের কর্মীদের বোঝার উপায় থাকে না যে, এর পুরোটাই পরিকল্পিত। আর দেহ যদি বাঘের রিজার্ভের ভেতর থাকে তাহলে তারা কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে না। তাই দেহগুলোকে রিজার্ভ এরিয়া থেকে বের করে এনে লোকালয়ের জমিতে রাখা হয়।
তদন্তের পর ঘটনার পুরো বিবরণ দিয়ে একটি রিপোর্ট জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছেন ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরোর তদন্তকারী কলিম আথার। তদন্তে গ্রামের অভিবাসীদের দায়ী করে রিপোর্ট জমা দেয়া হয়।
খুব সম্প্রতি ডেইলি মেইলের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, জুলাই মাসের ১ তারিখে পঞ্চান্ন বছর বয়সী এক নারীর একইভাবে বাঘের হাতে মৃত্যুর অভিযোগ আসে। কিন্তু পিটিআরের কর্মকর্তারা অভিযোগটি পুরোপুরি উড়িয়ে দেন। তাদের মতে, লাশটি জঙ্গলের ভেতর থেকে টেনে নিয়ে আসা হয়। দেড় কিলোমিটার দূরে লাশের কাপড়ের ছেঁড়া অংশ খুঁজে পাওয়া যায়। এখন উৎসুক জনতার প্রশ্ন, আসলেই কি এটি বয়স্ক নারীটির আত্নহত্যা, নাকি ‘বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে’ গল্পের মতো সত্যিই বাঘের থাবা নেমে এসেছে কপালে। যখন আগের তদন্তগুলোরই এখনো কোনো সুরাহা হয়নি, এমতাবস্থায় কেনই বা আবার এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি?
ঘটনাটি সত্য বা মিথ্যা যা-ই হোক না কেন, মূল প্রশ্ন মানবতার। এই সকল গরীব দুঃখী লোকেরা অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে, যাদের দেখার কেউ নেই। বিশাল ভারত রাষ্ট্র যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রতিদিন উন্নত রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, সেখানে এ ধরনের হৃদয় বিদারক ঘটনা সত্যিই নাড়া দিয়ে গেছে পুরো বিশ্বকে। মানুষ কতটা নিরুপায় হলে বাঘের মুখে স্বেচ্ছায় গিয়ে পড়তে পারে, তা কোনো বর্ণনায় তুলে আনা সম্ভব নয়।
আসলেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা এমন কত ঘটনার সাক্ষী হই, যেখানে বাস্তবতা আর কল্পনা মিলে একাকার হয়ে যায়। প্রকৃতির মধ্যে ঘটে যাওয়া এমন বাস্তব ঘটনা জানার পর ‘জীবন থেকে গল্প, নাকি গল্প থেকে জীবন’- সেই বিষয়ে মনে বিস্তর সন্দেহ জেগে ওঠে।
ফিচার ছবিসূত্র: huffingtonpost.com