আমাদের দেশের আহসান হাবিব পেয়ার কিংবা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের গুরমিত রাম রহিম সিং ইনসান, দুজনের মাঝে শারীরিক দূরত্ব হাজার হাজার মাইল হলেও মানসিক দূরত্ব নেই একটুও। কারণ দুজনই প্রতারক, দুজনই ভন্ড, দুজনই ধর্ম ব্যবসায়ী। গত মাসাধিককাল ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর সংবাদ মাধ্যমগুলো সরগরম রয়েছে এ দুজনের নানা কুকীর্তির খবরের কারণে।
তবে তারাই তো এ লাইনে প্রথম না; তাদের আগে আরো অনেকে এসেছে, এখনো অনেকে আছে, আবার সামনেও যে অনেকেই আসবে তা তো না বললেও চলে। ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের ছয়টি দেশের এমনই ছয়জন ভন্ড ধর্ম ব্যবসায়ীর গল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের লেখাটি।
মুহাম্মাদ সাবির
আজ থেকে মাত্র বছর তিনেক আগেকার কথা। পাকিস্তানের নাগরিক মুহাম্মাদ সাবিরকে ঘিরে তখন জড়ো হয়েছে অনেক মানুষ। তার দাবি ছিলো, তিনি নাকি স্রষ্টার কাছ থেকে বিশেষ এক উপহার পেয়েছেন, মৃতকে পুনরায় জীবিত করার ক্ষমতা। সেদিন তার কথার মাঝে কী ছিলো কে জানে, তবে অনেকেই তার সেই ভাঁওতাবাজি বিশ্বাস করেছিলো। এমনকি সাবির নিজেও বোধহয় তার এই বুজরুকি বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন।
দাবি করা হয়েছে, এখন তো প্রমাণ দরকার। তাই সাবির আহ্বান জানালেন তার সমর্থকদের মাঝে থেকে কাউকে সামনে এগিয়ে আসতে। অনেক মানুষ থাকলেও এগিয়ে আসার সাহস দেখিয়েছিলো মাত্র একজন, নাম তার মুহাম্মাদ নিয়াজ। সাবির নিয়াজকে একটি টেবিলের পায়াতে হাত পেছনের দিকে বাঁধলেন। এরপর গলার মাঝে চালিয়ে দিলেন ছুরি।
ভক্তরা তখন চোখ বড় বড় করে সব দেখছিলো। কিছুক্ষণ পরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো নিয়াজ। ওদিকে নিয়াজ যখন তড়পাচ্ছিলো, তখন বিড়বিড় করে মন্ত্র আউড়াচ্ছিতলেন সাবির। কিছুক্ষণ পর তিনি নিয়াজকে নির্দেশ দিলেন উঠে বসতে। কিন্তু ততক্ষণে তো নিয়াজ লাশ ছাড়া আর কিছুই না। সাবির বারবার নির্দেশ দিলেও তাই কিছুই হলো না। শেষপর্যন্ত সাবির নিজেও বুঝতে পারলেন তিনি আসলে কী করে ফেলেছেন। বুঝতে পারা মাত্রই দে ছুট!
উত্তেজিত জনতার হাত থেকে অবশ্য বাঁচতে পারে নি বেচারা ভন্ড। জনতা তাকে ধরে ঠিকই পুলিশে সোপর্দ করেছিলো।
জেমি কুটস
সাপ নামক প্রাণীটিকে দেখলেই আমরা ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যাই। এর কামড়ের হাত থেকে সাধের জীবনটাকে বাঁচানোই তখন হয়ে ওঠে আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য, সাপটি বিষাক্ত কিনা সেটা যাচাই করার সময় তখন থাকে না। সে যা-ই হোক। কেন্টাকির ধর্ম প্রচারক জেমি কুটস অবশ্য এসবের ধার ধারতেন না। তার দাবি ছিলো, ঈশ্বর তাকে এক অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা দিয়েছেন, যার বদৌলতে কোনো সাপের কামড়ই তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না।
এটা ছিলো নিজেকে অতিমানব প্রচারের জন্য তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। মজার ব্যাপার হলো, ‘প্রাথমিকভাবে’ এতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। ধর্মসভায় উপস্থিত অগণিত লোকের সামনে তিনি একহাতে সাপ ধরে রাখতেন, মুখে বিড়বিড় করে আউড়ে যেতেন নানা মন্ত্র। এরপর অন্য হাতে স্বেচ্ছায় খেতেন সাপের কামড়। এভাবে নয়বার সাপের কামড় খেয়েছিলেন তিনি, আর কাকতালীয়ভাবে প্রতিবারই বেঁচে গিয়েছিলেন। এমনকি একবার তার ধর্মসভায় উপস্থিত এক নারীকে একটি সাপ কামড়ে দেয়। সবাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলেও তিনি বাঁধা দেন। শেষ পর্যন্ত সেখানেই সেই নারীর মৃত্যু হয়। এতে একটুও বিচলিত হন নি কুটস। বরং তিনি জানান, সেই নারীর ঈশ্বরে বিশ্বাসে ঘাটতি ছিলো। তাই ঈশ্বরের কৃপা তার উপর বর্ষিত না হওয়ায় মৃত্যু হয়েছে তার!
কুটস হয়তো ভাবতেও পারেন নি ঠিক একই পরিণতি অপেক্ষা করছে তার জন্যও। সাবির-নিয়াজের মতো এ ঘটনাও ঘটেছিলো ২০১৪ সালে। দশমবারের মতো স্বেচ্ছায় সাপের কামড় খান তিনি। তার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়লে অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত এসে পড়েছিলো। কিন্তু তার বোকা ভক্তরা ভেবেছিল, তাদের গুরু বুঝি এবারও বেঁচে যাবেন। শেষপর্যন্ত একঘন্টা বিষের জ্বালা সহ্য করেই পরপারে পাড়ি জমান কুটস।
অ্যালেক এন্দিওয়ান
পাকিস্তান, আমেরিকা ছেড়ে এবার চলুন ঘুরে আসা যাক দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। ঘটনাটি ঘটেছিলো গত বছর। দেশটির এক ধর্ম প্রচারক, নাম অ্যালেক এন্দিওয়ান, ঘুরতে গিয়েছিলেন ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কে। সেখানে গিয়ে তার হঠাৎ বোধহয় মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছিলো। তাই তিনি ভাবতে শুরু করে দিলেন, পবিত্র আত্মা (Holy Spirit) তাকে অসুরের মতো শক্তি দান করেছে। এটুকু ভেবেই স্থির থাকতে চাইলেন না তিনি, চাইলেন সবাইকে তার সেই শক্তি দেখাতে। ন্যাশনাল পার্কে থাকা সিংহগুলোর সাথে খালি হাতে লড়াই করে তাদের পরাস্ত করার মাধ্যমেই নিজের সুপারম্যান হয়ে যাবার প্রমাণ দিতে চাইলেন তিনি।
সামনেই একপাল সিংহ মজা করে একটি ইম্পালা দিয়ে তাদের ভোজনপর্ব সারছিলো। অ্যালেক তাদের দেখে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন, তারপর বীরদর্পে এগিয়ে যেতে লাগলেন তাদের দিকে, যেন আজকেই পুরোপুরি খতম করে দেবেন সিংহের দলটিকে। ওদিকে শিকারকে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে সিংহগুলোও উঠে দাঁড়ালো। ইম্পালা ছেড়ে তারা ছুটে আসতে লাগলো অ্যালেকের দিকে। এবার যেন হঠাৎ করে শুভবুদ্ধির উদয় হলো অ্যালেকের। জান বাঁচাতে গাড়ির দিকে পড়িমরি করে ছুট দিলেন তিনি। কিন্তু সিংহের সাথে দৌড়ে মানুষ পারবে কেন? অল্প সময়ের মাঝেই সিংহের দল তাকে ঘিরে ধরলো, শুরু করে দিলো আক্রমণ।
সেদিনটাই হতে পারতো অ্যালেকের জীবনের শেষ দিন, হয় নি কেবল পার্কের এক নিরাপত্তারক্ষীর জন্য। তিনি ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে সাথে সাথেই ছুটে যান সেখানে, উপরের দিকে ছোড়েন একটি ফাঁকা গুলি। এরপই সিংহগুলো আস্তে আস্তে অ্যালেককে ছেড়ে চলে যায়।
এ ঘটনা অ্যালেককে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তিনি আসলে বুঝতে পারছিলেন না কেন এমনটা হলো, কেন তার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা কাজ করে নি! সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, “আমি ভেবেছিলাম প্রাণীজগতের উপর নিজের কর্তৃত্ব দেখাতে ঈশ্বর আমাকে ব্যবহার করতে চান।”
এমানুয়েল এসেযোবর
এখন চোখ বুলিয়ে আসা যাক প্রায় সাড়ে আঠারো কোটি মানুষের পশ্চিম আফ্রিকান দেশ নাইজেরিয়া থেকে। এ ঘটনার সময়কালও ২০১৬ সাল। এমানুয়েল এসেযোবর নামক দেশটির এক বিশপের নামে অভিযোগ আনা হয়, তিনি নাকি ভাঁওতাবাজি করে নিজের অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ দিতে গিয়ে এক লোককেই মেরে ফেলেছেন!
মৃত লোকটির পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায়, এমানুয়েল নাকি তাকে ৫,০০,০০০ নাইজেরীয় মুদ্রা দিতে চেয়েছিলেন। অবশ্য এজন্য তাকে একটি কাজ করতে হবে। খুব কঠিন কোনো কাজ না অবশ্য। লোকটিকে একটি কফিনে শুয়ে থাকতে হবে মরা মানুষের মতো করে। সেই কফিনটি রাখা হবে একটি ধর্মসভায়। এরপর এমানুয়েল আহ্বান করলেই কফিনের ভেতর শোয়া থেকে উঠে বসবেন লোকটি। এতে বিমোহিত হয়ে লোকেরা ভাববে, এমানুয়েলের বুঝি জন্ম-মৃত্যুর উপরেও নিয়ন্ত্রণ আছে! আসলে ধর্মপ্রাণ মানুষদের বোকা বানিয়ে নিজের অনুসারী বৃদ্ধিই (এবং সেই সাথে অর্থ) যে ছিলো এমন কাজের পেছনে মূল উদ্দেশ্য, তা তো না বললেও চলে।
এ লক্ষ্যে চুক্তিও সই হয় দুজনের মাঝে। ব্যাপারটিকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করতে শুরুতে কফিনটি বন্ধ করে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কফিনটি ছিলো বায়ুরোধী। তাই লোকটিকে ভেতরে ঢুকিয়ে কফিন আটকে দিলে অল্প সময়ের মাঝেই ভেতরের অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়। তখন দম বন্ধ হয়ে ভেতরেই পরপারে পাড়ি জমায় সে।
অন্যদিকে কিছু সময় পর উপস্থিত দর্শকদের চমকে দিতে বাইরে থেকে তার নাম ধরে ডাকতে থাকে এমানুয়েল। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পরও লোকটি ডালা খুলে বেরিয়ে না আসায় বাইরে থেকেই ডালা খোলা হয়। এরপরেই দেখা যায়, ভেতরে পটল তুলেছে সেই হতভাগা।
গণেশযোগী মহারাজ
একেবারে শুরুতেই বলা হয়েছে পাকিস্তানের কথা। এখন ভারতের কথা না বললে কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
ভারতের ময়ুরেশ্বরের গণেশযোগী মহারাজ ভাবতেন, মৃত্যুকে প্রতিহত করার মতো ক্ষমতা রয়েছে তার। ভক্তকুলের কাছ থেকে জানা যায়, তিনি নাকি এটা তাদের প্রমাণও করে দেখিয়েছিলেন। মাঝে মাঝেই তিনি নাকি ঢকঢক করে গিলে ফেলতেন বিষ, শরীরে ছোবল দেওয়াতেন বিষাক্ত সাপ দিয়ে। তারপরও দিব্যি বেঁচে থাকতেন তিনি। এভাবেই ভক্তকুলের কাছে এক অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত পান তিনি।
২০১৪ সালে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নেন গণেশযোগী। তিনি জানান, এবার তিনি তার সবচেয়ে বড় অলৌকিক ক্ষমতাটি দেখাবেন। এজন্য প্রথমে মারা যাবেন তিনি, ঘুরতে যাবেন পরলোকে। সেখানে তিনদিন থেকে তারপর আবার মাটির পৃথিবীতে ফিরে আসবেন তিনি। পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী ২০০ মিলিলিটার কীটনাশক অগণিত জনতার সামনে ঢকঢক করে গিলে নেন গণেশযোগী মহারাজ। এরপরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। তবে ভক্তদের মতে তার তো আর পুরোপুরি মৃত্যু হয় নি। তাই রাতভর তারা প্রার্থনা করে তাদের গুরুর সুস্থভাবে পুনরাগমনের জন্য।
কিন্তু মৃত ব্যক্তি কি আর কখনো ফেরত আসে? গণেশযোগীও আসেন নি। আস্তে আস্তে তার দেহে পচন শুরু হয়ে যায়। পুলিশ এসে তার লাশ সৎকার করতে চাইলে বাঁধা দেয় ভক্তরা। ডাক্তারি পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়া তারা মানতেই চাইছিলো না যে, তাদের গুরু আর আসবে না! অবশেষে ইসিজি পরীক্ষা করে যখন তারা বুঝলো যে তাদের গুরু আসলেই বেঁচে নেই, কেবলমাত্র তখনই তারা শেষকৃত্যানুষ্ঠানের কাজ শুরু করেছিলো।
শামিসো কেনিয়ামা
সর্বশেষ কাহিনীটা ক্রিকেট খেলার সুবাদে আমাদের অধিক শোনা একটি দেশেরই। সময়কাল ২০১৫, জিম্বাবুয়ের ‘স্বঘোষিত নবী’ শামিসো কেনিয়ামার এক অনুসারী খুব ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। শামিসো অনেক চিন্তা করে জানালেন, তার সেই অনুসারীর পরিবারের উপর প্রেতাত্মার প্রভাব পড়েছে। এ প্রভাব দূর করতে পারলেই সব সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু প্রেতাত্মাকে কীভাবে দূর করা হবে? এজন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মারা যাওয়ার! মারা যাবার পর পাতালপুরিতে গিয়ে প্রেতগুলোকে শায়েস্তা করে তবেই ফিরে আসবেন তিনি।
নিজের আরো পাঁচজন অনুসারীকে নিয়ে সেই ভক্তের বাড়ি গেলেন তিনি। এরপর সেই পাঁচজনকে বললেন একটি গর্ত খুঁড়ে তাকে মাটি চাপা দিয়ে দিতে। কবরে শুয়ে তিনি তাদের কথা পর্যন্ত দিয়ে গিয়েছিলেন যে, প্রেতাত্মাদের একটা ব্যবস্থা করে তবেই তিনি ফিরবেন।
কবরে মাটি ফেলে দেয়া হলো। পরবর্তীতে যখন আবার মাটি খুঁড়ে ভক্তরা তাদের ভন্ড নবীর খোঁজ করতে গেলো, তখন শামিসোর নিথর দেহটি ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় নি তারা। এ যেন স্বেচ্ছায় নিজের কবর নিজেই খনন করা!