ফোর্বস ম্যাগাজিন প্রতি বছরই বিশ্বের সেরা ধনীদের তালিকা প্রকাশ করে থাকে। যথারীতি এবারও তারা প্রকাশ করেছে বর্তমান সময়ের সেরা ধনীদের তালিকা। গত মঙ্গলবার প্রকাশ করা ফোর্বসের এ তালিকা থেকে দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বে বিলিয়নিয়ারের (শতকোটি ডলারের মালিক) সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি এবং তাদের সম্পত্তির পরিমাণও অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
এই মুহূর্তে বিশ্বে মোট বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ২,২০৮ জন, গত বছরের চেয়ে ১৬৫ জন বেশি। এদের গড় সম্পত্তির পরিমাণ রেকর্ড সৃষ্টিকারী ৪.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে তালিকার শীর্ষে আছেন আমাজনের প্রধান জেফ বেজোস। আর ৯০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন সাবেক শীর্ষ ধনী বিল গেটস।
ফোর্বসের এই তালিকা থেকে জানা যায়, এই ২,২০৮ জনের মধ্যে ৬৩ জনেরই বয়স ৪০ বছরেরও কম। এ সংখ্যাও ২০১৭ সালের তুলনায় বেশি। সে সময় তরুণ বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ছিল ৫৬। ৪০ বছরের আগে শতকোটি ডলারের মালিক হওয়া সহজ কথা নয়। অবশ্য এদের সবাই যে নিজের প্রচেষ্টায় এই অবস্থানে এসেছেন, এমন না। ৬৩ জনের মধ্যে ২৭ জন এ সম্পত্তি লাভ করেছেন উত্তরাধিকারসূত্রে। আর বাকি ৩৬ জন এই বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি গড়েছেন সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায়।
এই ৬৩ জন তরুণ ধনী ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের ১৮টি দেশ জুড়ে। এদের মধ্যে ৪৭ জন পুরুষ এবং বাকি ১৬ জন নারী। উল্লেখ্য, পুরুষদের প্রায় সকলেই স্বপ্রতিষ্ঠিত, অন্যদিকে নারীদের সকলেই উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জিত সম্পত্তির মালিক। এই ৬৩ জনের মধ্যে ২৬ জনই এই বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি অর্জন করেছেন প্রযুক্তি সম্পর্কিত ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে। চলুন জেনে নিই এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু তরুণ ধনীর পরিচয়।
অ্যান্ডারসেন ভগ্নীদ্বয়, সর্বকনিষ্ঠ বিলিনিয়ার
বর্তমান বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ বিলিয়নার আলেক্সান্দ্রা অ্যান্ডারসেন এবং ক্যাথেরিনা অ্যান্ডারসেন। তাদের বয়স যথাক্রমে মাত্র ২১ এবং ২২ বছর। পরপর তিন বছর ধরে তারা বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ বিলিয়নিয়ারের স্থান ধরে রেখেছেন। বর্তমানে তাদের প্রত্যেকের সম্পত্তির মূল্য প্রায় ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১১,৬২০ কোটি টাকা।
অ্যান্ডারসেন ভগ্নীদ্বয় তাদের সম্পত্তি পেয়েছেন তাদের বাবা জোহান হেনরিক অ্যান্ডারসেনের কাছ থেকে। জোহান অ্যান্ডেস ছিলেন বিখ্যাত নরওয়েজিয়ান ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তা। তিনি ছিলেন নরওয়ের প্রাইভেট হোল্ডিং কোম্পানী ‘ফার্ড’ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং মালিক। ২০০৭ সালে তিনি কোম্পানীর মালিকানা তার দুই কন্যা আলেক্সান্দ্রা এবং ক্যাথেরিনার কাছে হস্তান্তর করেন। ২০১৬ সালে ফোর্বস প্রথম তাদের কথা জানতে পারে। সে সময় থেকেই তারা বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ বিলিয়নিয়ার হিসেবে ফোর্বসের তালিকায় স্থান পেয়ে আসছেন।
জন কলিসন, সর্বকনিষ্ঠ স্বপ্রতিষ্ঠিত বিলিয়নিয়ার
২৭ বছর বয়সী আইরিশ উদ্যোক্তা জন কলিসন বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ বিলিয়নিয়ার। তিনি এবং তার বড় ভাই, ২৯ বছর বয়সী প্যাট্রিক কলিসন ২০১০ সালে স্ট্রাইপ নামে সান ফ্রানসিসকো ভিত্তিক একটি অর্থ আদান-প্রদানের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান চালু করেন, যার বর্তমান মূল্য ৯.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জন এবং প্যাট্রিক যখন কলেজের ছাত্র ছিলেন, তখনই তারা কোম্পানীটি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন।
স্ট্রাইপের কর্ণধার হিসেবে কলিসন ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মূল্য বর্তমানে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।স্ন্যাপচ্যাটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইভান স্পিজেলের বয়সও কলিসনের মতোই ২৭ বছর এবং তার সম্পত্তির পরিমাণ কলিসনের চেয়ে অনেক বেশি (৪.১ বিলিয়ন ডলার) হলেও কলিসন স্পিজেলের চেয়ে কয়েক মাসের ছোট হওয়ায় বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ স্বপ্রতিষ্ঠিত বিলিয়নিয়ার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
পাভেল দুরোভ, নব্য সর্বকনিষ্ঠ বিলিয়নিয়ার
পাভেল দুরোভকে বলা হয় রাশিয়ার মার্ক জাকারবার্গ। কারণ জাকারবার্গের মতোই তিনিও একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের প্রতিষ্ঠাতা এবং তার বয়সও ৩৩ বছর। ২০০৭ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে দুরোভ ভিকন্তাকতে (ভিকে) নামে একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাইট প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত তার সাইটটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০০ মিলিয়নে, যা রাশিয়ার সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
দুরোভকে রাশিয়ান গোয়েন্দাবাহিনী তার ব্যবহারকারীদের তথ্য দেওয়ার জন্য বাধ্য করলে তিনি ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে সাইটটির ১২ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে রাশিয়া ত্যাগ করেন এবং দুবাইয়ে গিয়ে স্থায়ী হন। তিনি জনপ্রিয় ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা, যার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। তার সম্পত্তির মূল্য প্রায় ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
মার্ক জাকারবার্গ, শীর্ষ তরুণ বিলিয়নিয়ার
সাম্প্রতিক বছরগুলোর মতো এবারও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী তরুণ হিসেবে ফোর্বসের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। ৩৩ বছর বয়সী মার্কিন নাগরিক জাকারবার্গ একই সাথে বিশ্বের পঞ্চম ধনী ব্যক্তি । ২০০৪ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রতিষ্ঠা করা ফেসবুকে বর্তমানে জাকারবার্গের শেয়ার ১৭ শতাংশ। তার বর্তমান সম্পত্তির মূল্য ৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জাকারবার্গ এবং তার স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাদের ফেসবুক থেকে আয়ের ৯৯ শতাংশই তারা দান করে দিবেন।
ইয়্যাং হুইয়ান, দ্বিতীয় শীর্ষ তরুণ বিলিয়নিয়ার
চল্লিশের চেয়ে কম বয়সী ধনীদের তালিকায় জাকারবার্গের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন চীনা নাগরিক ইয়্যাং হুইয়ান। ৩৬ বছর বয়সী ইয়্যাং ২০০৭ সালে তার বাবা ইয়াং কেওক কেয়াং-এর কাছ থেকে রিয়েল স্টেট কোম্পানি কান্ট্রি গার্ডেন হোল্ডিংসের ৫৭ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা লাভ করেন। তিনি কোম্পানিটির ভাইস চেয়ারম্যান। বর্তমানে ইয়্যাং হুইয়ানের মোট সম্পত্তির মূল্য ২১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি একইসাথে সমগ্র এশিয়ার মধ্যে শীর্ষ ধনী।
লুকাস ওয়াল্টন, তৃতীয় শীর্ষ তরুণ বিলিয়নিয়ার
লুকাস ওয়াল্টন হচ্ছেন চল্লিশের নিচে তৃতীয় শীর্ষ ধনী। তরুণ পুরুষ বিলিয়নারদের মধ্যে তিনিই একমাত্র যিনি তার সম্পত্তি অর্জন করেছেন উত্তরাধিকারসূত্রে। তার দাদা স্যাম ওয়াল্টন ছিলেন ওয়ালমার্টের প্রতিষ্ঠাতা। লুকাস তার প্রায় সম্পূর্ণ সম্পত্তি পেয়েছেন তার বাবা জন ওয়াল্টনের কাছ থেকে, যিনি ২০০৫ সালে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। তিনি বাবার সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের মালিকানা অর্জন করেন। বর্তমানে তার সম্পত্তির মূল্য ১৫.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার বর্তমান বয়স ৩২ বছর। তার সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তার ছবিও গণমাধ্যমে বিরল।
এছাড়াও তরুণ বিলিয়নিয়ারদের তালিকায় ১৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে চতুর্থ স্থানে আছেন ৩৩ বছর বয়সী ডাস্টিন মস্কোভিটজ, যিনি জাকারবার্গের রুমমেট হিসেবে ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১০.১ বিলিয়ন ডলার নিয়ে পঞ্চম স্থানে আছেন ফেসবুকের আরেকজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা এডুয়ার্ডো স্যাভেরিন। ফেসবুক ছাড়াও ইনস্টাগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা কেভিন সিসট্রম, উবারের প্রতিষ্ঠাতা ট্র্যাভিস কালানিক, পিন্টারেস্টের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইভান শার্প সহ অনেকেই আছেন তরুণ বিলিয়নিয়ারের এ তালিকায়।
সব মিলিয়ে এই ৬৩ জন তরুণ বিলিয়নিয়ারের মোট সম্পত্তির মূল্য ২৬৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে প্রায় ৫,৬০০ গুণ বেশি। ২০১৭ সালে চল্লিশের নিচে যে ৫৬ জন বিলিয়নিয়ার ছিলেন, তাদের মোট সম্পত্তির তুলনায় এবারের মোট সম্পত্তি ৫৭ ট্রিলিয়ন বেশি। গত বছর যারা তালিকায় ছিলেন, তাদের ৩০ জন এই এক বছরে আগের চেয়ে আরো ধনী হয়েছেন এবং ১১ জন কিছু পরিমাণ সম্পত্তি হারিয়েছেন।