গত ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে লন্ডনের পাতাল কম্যুটার ট্রেনে বিস্ফোরণে প্রায় ৩০ জন আহত হয়েছেন। লন্ডন আর যুক্তরাজ্যের মানুষ এ বছর বেশ কয়েকবারই সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে, হতাহতের সংখ্যাও কম নয়। একসময় প্রায় পুরো পৃথিবী শাসন করা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আজ আর নেই। ব্রিটিশ রাজপরিবার টিকে থাকলেও নেই কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা। পড়াশোনা কিংবা কাজের কারণে যুক্তরাজ্যে প্রতি বছরই পাড়ি জমায় নানান দেশের নানান সংস্কৃতির মানুষ। কিন্তু নানা জাতি, ধর্ম, বর্ণের এই দেশ এ বছর বারবার রক্তাক্ত হয়েছে সন্ত্রাসী হামলায়। চলুন জেনে নেয়া যাক এ বছরে যুক্তরাজ্যের শীর্ষ পাঁচটি সন্ত্রাসী হামলা সম্পর্কে।
ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজ, মার্চ ২২
ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজে পথচারী এবং পুলিশের উপর গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে শুরু হয় আক্রমণ। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি এরপর হাউজ অব পার্লামেন্টের দেয়ালে আঘাত করে থেমে যায়। কিন্তু আক্রমণকারী সেখানেই থেমে যায়নি। গাড়ি থেকে নেমে ধারালো ছুরি দিয়ে আক্রমণ শুরু করে পাহারারত নিরাপত্তাকর্মীদের উপর। নির্মম এই ঘটনায় একজন পুলিশসহ পাঁচজন মারা যান, আহত হন ৫০ জনেরও বেশি মানুষ, যারা ১২টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাগরিক।
আক্রমণকারী খালিদ মাসুদ ঘটনার সময়ই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। ঘটনার পরপরই আইসিস খালিদকে তাদের সেনা বলে এ ঘটনাকে নিজেদের সাফল্য বলে দাবি করে। ৫২ বছর বয়সী খালিদ মধ্যপ্রাচ্যের কোনো অধিবাসী ছিল না, বরং সে একজন ব্রিটিশ নাগরিকই ছিল। ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত সবার কাছে শান্ত এবং বেশ ভালো ছেলে হিসেবেই পরিচিত ছিল সে। ২০০০ সালে বর্ণবাদী এক ঘটনায় একজনকে আঘাত করার কারণে জেলে যেতে হয়েছিল তাকে। এরপর থেকেই বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়তে থাকে খালিদ। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৫ এর নজরদারিতেই ছিল সে কিছুদিন। কিন্তু বড় কোনো অপরাধে জড়িত না হওয়ায় পরে তার উপর আর নজর রাখেনি এমআই-৫।
এ ঘটনায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আরো বেশ কিছু সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করে। তবে তাদের বেশিরভাগকেই ছেড়ে দেয় সন্দেহজনক কোনোকিছু না পাওয়ায়। বার্মিংহামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে গাড়ি ভাড়া করেছিল খালিদ মাসুদ। সেই গাড়ি দিয়েই সাধারণ মানুষের উপর বর্বর এই আক্রমণ চালায় সে।
ম্যানচেস্টার অ্যারেনা, মে ২৩
লন্ডনের ঘটনার দু’মাস পর আবারও রক্তাক্ত হয় যুক্তরাজ্য, এবার সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যস্থল ছিল ম্যানচেস্টার। আমেরিকান গায়িকা আরিয়ানা গ্রান্ডের কনসার্টে হয় এই হামলা। রাত সাড়ে দশটার দিকে কনসার্ট শেষে ম্যানচেস্টার অ্যারেনা থেকে যখন সবাই বের হচ্ছিল, ঠিক তখনই কনসার্ট হলের বাইরে আত্মঘাতী হামলায় কেঁপে ওঠে ম্যানচেস্টার। এই হামলায় নিহত হন ২২ জন, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিশুও ছিল। আহত হয়েছিলেন ১২০ জনেরও বেশি। ঘটনার পরপরই পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে নিরাপত্তাবাহিনী। কনসার্টটি মূলত কম বয়সীদের জন্য হওয়ায়, বেশিরভাগ দর্শকই ছিলেন শিশু কিংবা কিশোর-কিশোরী। ফলে হতাহতের মধ্যেও তাদের সংখ্যাই বেশি। নিহতদের মধ্যে রয়েছে মাত্র ৮ বছর বয়সী শিশুও।
এ হামলার জন্য দায়ী ছিল ২২ বছর বয়সী সালমান আবেদি নামের একজন ব্রিটিশ নাগরিক। আগের বারের মতোই এবারও আইসিস এ হামলার জন্য নিজেদের দায় স্বীকার করে। লেবানিজ বংশোদ্ভূত সালমানের ভাইকে এ ঘটনার পরপরই গ্রেপ্তার হয় সাবধানতার জন্য। এ ছাড়াও ম্যানচেস্টার এবং চারপাশে অভিযান চালিয়ে আরো অনেক সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার করে নিরাপত্তাবাহিনী।
লন্ডন ব্রিজ এবং বোরো মার্কেট, জুন ৩
ম্যানচেস্টারে আত্মঘাতী হামলার দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে লন্ডন আবারো শিকার হয় হামলার। এবারও আগেরবারের মতো পথচারীদের উপর গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে এবং এরপর গাড়ি থেকে নেমে ছুরি দিয়ে আক্রমণ করে। জুনের ৩ তারিখে রাত ১০ টার দিকে লন্ডন ব্রিজে পথচারীদের উপর ভ্যান উঠিয়ে দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। প্রতক্ষ্যদর্শীদের ভাষ্যমতে, গাড়িটি বেশ জোরে চলছিল, অন্তত ঘণ্টায় ৫০ মাইল বেগে।
পথচারীদের উপর আক্রমণ শেষ করে ভ্যান থেকে নেমে আক্রমণকারীরা বোরো মার্কেটের ভেতরে ক্যাফে এবং পাবের লোকদের উপর আক্রমণ শুরু করে ছুরি দিয়ে। এ সময় ক্যাফে এবং পাবের লোকেরা হাতের কাছে থাকা কাঁচের বোতল দিয়ে আত্মরক্ষা এবং পাল্টা আক্রমণের চেষ্টাও করেছিলেন। প্রায় ১৮ মিনিট ধরে চলা এই আক্রমণে নিহত হন ৮ জন, আহত হন অন্তত ৪৮ জন। এবারো বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকরা শিকার হন হামলার।
এ ঘটনার পেছনে দায়ী ছিল তিনজন- খুররাম ভাট, ইউসুফ জাঘবা এবং রাশিদ রেদোয়ান। তিনজনই পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ঘটনাস্থলে। এবারও এ ঘটনার দায় স্বীকার করে আইসিস। ঘটনার জন্য দায়ী তিনজনই বিভিন্ন সময় আইনভঙ্গ করেছিল। পুলিশের নজরদারিতেও ছিল কিছুদিন। এদের মধ্যে একজন হামলার এক বছর আগে গ্রেপ্তার হয়েছিল তুরস্ক দিয়ে সিরিয়া যাবার পথে। আরেকজনকে মসজিদ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল মসজিদের ইমামের সাথে বেয়াদবি করার কারণে।
ফিন্সব্যারি পার্ক মসজিদ, জুন ১৯
লন্ডন ব্রিজ ঘটনার ১৬ দিনের মাথায় আবারো পথচারীদের উপর গাড়ি উঠিয়ে হামলা। এবার আক্রমণের শিকার রমজান মাসে তারাবীর নামাজ পড়ে ঘরে ফেরা মুসল্লিরা। আগের দু’মাসে আইসিস এর হামলার রেশ ধরে ইসলামফোবিয়ার শিকার হয় যুক্তরাজুয়ের অধিবাসীরা। মাঝরাতের এ হামলায় নিহত হন একজন, আহত হন আরো দশজন।
এ ঘটনার জন্য গ্রেপ্তার হন ৪৮ বছর বয়সী কার্ডিফ নিবাসী ড্যারেন অসবর্ন। তার মুসলিম প্রতিবেশীদের সাথে তার আচরণ ভালো থাকলেও, কয়েক মাসের ঘটনায় তার আচরণ কিছুটা পাল্টে যেতে থাকে। এই পাল্টে যাওয়াই নিয়ে নেয় একজনের প্রাণ। আক্রমণকারী অসবর্ন এক পর্যায়ে জনতার কাছে ধরা পড়ে, কিন্তু মসজিদের ইমামের কল্যাণে গণপিটুনি থেকে রক্ষা পায়। পরে ইমাম তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, হামলা চালানোর সময় অসবর্ন “আমি সব মুসলিমকে হত্যা করব” বলে চিৎকার করছিল। লন্ডনের মেয়র সাদিক খান এ ঘটনাকে ‘ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
পারসোনস গ্রিন স্টেশন, সেপ্টেম্বর ১৫
সেপ্টেম্বরের সকালে যখন সবাই অফিস কিংবা স্কুল-কলেজে যাবার জন্য সাবওয়েতে ভিড় করে, ঠিক তখনই পশ্চিম লন্ডনের পারসোনস গ্রিন স্টেশনে ঘটে এক বোমা বিস্ফোরণ। পাতাল ট্রেনে ঘটা এ বিস্ফোরণ আরো একবার রক্তাক্ত করে লন্ডনকে। তবে এবারে কেউ মারা না গেলেও আহত হয়েছেন ৩০ জন। আহতদের কেউই খুব বেশি খারাপ অবস্থায় নেই বলেই পুলিশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে, এ হামলায় ব্যবহৃত হওয়া বিস্ফোরকটি ঠিকভাবে বিস্ফোরিত না হওয়ায় হতাহত এবং ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণ বেশি হয়নি। তা না হলে, পিক আওয়ারে ঘটা এ হামলায় বেশ বড় হতাহত হবার সম্ভাবনা ছিল। এখন পর্যন্ত এ হামলার জন্য কেউ দায় স্বীকার না করলেও, পুলিশ ১৮ এবং ২১ বছর বয়সী দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে তাদের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি। এর পাশাপাশি বেশ কিছু জায়গায় পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে সন্দেহভাজনের খোঁজে।
এসব বড় হামলার বাইরেও যুক্তরাজ্য শিকার হয়েছে আরো বেশ কিছু সন্ত্রাসী ঘটনার। বাকিংহাম প্যালেসের বাইরে এক হামলায় দুজন পুলিশ অফিসার আহত হয়েছিলেন আগস্টের ২৫ তারিখে। সন্ত্রাসী হামলার বাইরেও এ বছর লন্ডনে ঘটে গিয়েছে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা। পশ্চিম লন্ডনের গ্রিনফেল টাওয়ারে গত ১৪ জুন মাঝরাতে আগুন লেগে মারা গিয়েছে ৭৯ জন, আহত হয়েছে শতাধিক। মর্মান্তিক এ ঘটনায় ঘরছাড়া হয়েছে অনেক পরিবার। ২০১৭ সাল যেন যুক্তরাজ্য, বিশেষ করে লন্ডনের জন্য অভিশাপ হয়ে রয়েছে।