অনুবাদকের নোট: রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রাইন আক্রমণ করে। এই হামলার প্রাক্কালে ইউক্রাইনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার জনগণের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন। ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২২-এ ক্বাতারভিত্তিক আল জাজিরা ইংলিশে প্রকাশিত ভাষণটির লিখিত রূপ বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হল।
ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২২
আজকে আমি রুশ ফেডারেশনের প্রেসিডেন্টকে কল করেছিলাম। জবাব হিসেবে পেয়েছিলাম নীরবতা। যদিও নীরব থাকার কথা ছিল দনবাস অঞ্চলের। তাই আমি রাশিয়ার জনগণের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলতে চাই। আর সেটা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে না। ইউক্রেনের একজন নাগরিক হিসেবে।
দুই হাজার কিলোমিটারেরও বেশি বড় একটা সাধারণ সীমান্ত আমাদেরকে বিভক্ত করে রেখেছে। এই সীমান্ত জুড়ে আপনাদের রাষ্ট্র সেনা মোতায়েন করেছে। প্রায় ২ লাখ সৈন্য। হাজারো সাঁজোয়া যানে ছেয়ে গেছে রুশ-ইউক্রেন সীমান্ত। আপনাদের নেতারা তাদেরকে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। আরেকটা দেশের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ চালানোর অনুমতি দিয়েছেন। আর এই পদক্ষেপটা ইউরোপ মহাদেশে একটা বড় যুদ্ধ শুরু করতে পারে।
আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, আমাদের যুদ্ধের দরকার নেই। স্নায়ুযুদ্ধ বা তপ্তযুদ্ধ কোনোটারই না। শংকর যুদ্ধেরও না। কিন্তু শত্রুসেনা যদি আমাদেরকে আক্রমণ করে; আমাদের কাছ থেকে আমাদের দেশ, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের জীবন, আমাদের শিশুদের জীবন কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চালায়; আমরা রুখে দাঁড়াব। আক্রমণ চালাব না আমরা, স্রেফ রুখে দাঁড়াব। আর যখন আপনাদের রাষ্ট্র আমাদেরকে আক্রমণ করবে, আপনারা আমাদের মুখ দেখবেন। পিঠ না, মুখ।
এই যুদ্ধটা অনেক বড় একটা দুর্যোগ। আর এই দুর্যোগের জন্য কঠিন মূল্য চুকাতে হবে। আক্ষরিক অর্থেই। মানুষ অর্থকড়ি হারাবে, সম্মান খোয়াবে, জীবনমানের অবনতি ঘটবে। মানুষ তাদের স্বাধীনতা হারাবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, মানুষ তাদের ভালোবাসার মানুষদেরকে হারাবে। হারাবে নিজেদেরকে।
আপনাদের রাষ্ট্র আপনাদেরকে বলেছে, ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। বাস্তবে অতীতে কোনোদিন এমন কিছু ঘটেনি, বর্তমানে ঘটছে না, ভবিষ্যতেও ঘটবে না। আপনাদের রাষ্ট্র ন্যাটোর কাছে সুরক্ষা গ্যারান্টি চাচ্ছে। কিন্তু আমরা ইউক্রেনীয়রাও সুরক্ষা গ্যারান্টি দাবি করছি। আমরা ইউক্রেনের জন্য আপনাদের কাছ থেকে সুরক্ষা গ্যারান্টি দাবি করছি। আপনাদের রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুরক্ষা গ্যারান্টি দাবি করছি। বুদাপেস্ট স্মারকলিপিতে বর্ণিত অন্যান্য সুরক্ষা গ্যারান্টিও দাবি করছি।
কিন্তু আমাদের আসল লক্ষ্য ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা। আমাদের জনগণের জন্য, ইউক্রেনীয়দের জন্য, সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তার জন্য আমরা যে-কারো সাথে সংলাপে বসতে রাজি আছি। আপনাদের রাষ্ট্রের সাথেও। যেকোনো উপায়ে আর যেকোনো জায়গায়। যুদ্ধ বেঁধে গেলে সকলেই সুরক্ষা গ্যারান্টি থেকে বঞ্চিত হবে। কারো কোনো প্রকার সুরক্ষা গ্যারান্টি থাকবে না।
যুদ্ধ বাঁধলে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে? রাশিয়া আর ইউক্রেনের জনগণ! কারা একেবারেই চায় না কোনো যুদ্ধ বাঁধুক? রাশিয়া আর ইউক্রেনের জনগণ! কারা এই যুদ্ধটাকে শেষপর্যন্ত থামিয়ে দেবে? রাশিয়া আর ইউক্রেনের জনগণ! কিন্তু সেইসব শান্তিকামীরা কি আপনাদের মধ্যে আছেন? আমি নিশ্চিত, আছেন।
আমি জানি রুশ রাষ্ট্র রাশিয়ার টিভি চ্যানেলগুলোতে আমার ভাষণটা প্রচার করবে না। কিন্তু রাশিয়ার জনগণকে এটা দেখতেই হবে। তাদেরকে সত্যটা জানতেই হবে। আর সত্যটা হলো এই, দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই রাশিয়াকে থামতে হবে। আর রুশ নেতারা যদি আমাদের সাথে শান্তির স্বার্থে পর্দার আড়ালে বৈঠকে বসতে না চান, হয়তো তারা পর্দার আড়ালে আপনাদের সাথে বৈঠকে বসবেন। রুশরা কি যুদ্ধ চান? আমি এই প্রশ্নটার একটা জবাব শুনতে চাই। কিন্তু জবাবটা শুধু আপনারাই দিতে পারেন। শুধু আপনারাই, রুশ ফেডারেশনের নাগরিকবৃন্দ, জবাবটা দিতে পারেন।
অনুবাদকের সংযোজন: রাশিয়ার জনগণ শুরু থেকেই আগ্রাসনের প্রতিবাদ করছেন। রুশ মানবাধিকার সংস্থা ওভিডি-ইনফোর ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্যানুসারে, ইউক্রাইনে রুশ আগ্রাসনের প্রথম সপ্তাহে (২৪ ফেব্রুয়ারি-২ মার্চ) রাশিয়ার ১২১টি শহরের ৭,৬২৯ জন প্রতিবাদীকে আটক করেছে রুশ পুলিশ। মস্কোর ইউক্রাইন দূতাবাসের সামনে যুদ্ধবিরোধী পোস্টারসহ প্রতিবাদ করার ও ফুল ছড়ানোর অপরাধে ৭-১১ বছর বয়সী ৫ রুশ শিশুকে আটক করা হয়েছে।
মূল লেখা: https://www.aljazeera.com/news/2022/2/24/russia-ukraine-crisis-president-zelenskky-speech-in-full