বিগত কয়েকদিনে ফেসবুকে ঘুরতে ঘুরতে কারও কারও হয়তো কিছু হাড় জিরজিরে শিশুর ছবি চোখে পড়েছে। কেউ কেউ হয়তো একনজর দেখে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নিজের কাজে, কেউ বা বুঝি এড়িয়েই গেছেন। ভেবেছেন এরকম ছবি দিয়ে লাইক চাওয়ার মানসিকতা থেকে এখনও বুঝি বা বের হতে পারলো না মানুষ। যারা প্রতিনিয়ত ফেসবুক ব্যবহার করেন, কিংবা এর বিভিন্ন হৃদয় ভারাক্রান্ত পোস্ট সম্বন্ধে জানেন, তাদের এরকমটা ভাবা আসলে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু নয়।
বাস্তবিকই ছবিগুলো দুর্ভিক্ষ-কবলিত একটি দেশের ছবি, যার নাম ইয়েমেন। এশিয়া মহাদেশের এক কোনায় আরব সাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত এই দেশটির উত্তরে সৌদি আরব এবং পূবে ওমান। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী ২০১৭ সাল নাগাদ এখানে ২৮.২৫ মিলিয়ন মানুষের বাস। এছাড়াও একটি চমকপ্রদ ব্যাপার আছে ইয়েমেনের অন্তর্গত সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জে; বিশ্বের অন্য কোথাও একসাথে এত জীববৈচিত্র্য দেখা তো যায়ই না, বরং উল্লেখযোগ্য যে, এর ৩৭% প্রজাতির উদ্ভিদ, ৯০% প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৯৫% প্রজাতির মৃৎ-শামুক বিশ্বের মধ্যে শুধুমাত্র এই অঞ্চলেই খুঁজে পাওয়া যায়[১]। এটি সম্প্রতি ইউনেস্কোর বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানসমূহের তালিকাভুক্তও হয়েছে।
প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের এক অপরূপ লীলাভূমি মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি ২০১৫ সাল থেকে চলতে থাকা এক গৃহযুদ্ধে এখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে জর্জরিত, যা ক্রমশই অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর এই দুর্ভিক্ষের শিকার এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭০ লক্ষ মানুষ, যার মধ্যে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু আছে প্রায় ৮৫,০০০। এছাড়াও বিশুদ্ধ পানির অভাবে এখানে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যা ইতোমধ্যেই বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এখন পর্যন্ত ৯ লক্ষের ওপরে কলেরা আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ২ হাজারেরও বেশি মানুষ এ রোগে মৃত্যুবরণ করেছে [২]। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে বেঁচে থাকার প্রধানতম মৌলিক অধিকারই এখন হুমকির সম্মুখীন। কাজেই চলমান এ যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্বন্ধে জানা না থাকলে এর পরিধি ঠাহর করাটা নিতান্ত অবিশ্বাস্য এবং অসম্ভবও বটে।
গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা
ইয়েমেনের বর্তমান গৃহযুদ্ধের সূচনা ২০১৫ সালে হলেও এর সূত্রপাত ২০১১ সাল থেকে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আরব বসন্তের বাতাসই [৩] এর প্রধান কারণ। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বেশ কিছু মুসলিম দেশে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা স্বৈরতন্ত্রের প্রতিবাদে ২০১১ সালের বসন্ত থেকে যে গণজাগরণ সংঘটিত হয়েছে, তারই নাম হচ্ছে আরব বসন্ত। এই আরব বসন্তের সফল বাস্তবায়নের ফলে কিছু দেশে স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়ে এসেছে গণতন্ত্র। কিছু দেশে পরিবর্তন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এখনও। আর কিছু দেশে চলছে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ, যার ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
আরব বসন্ত
সময়টা ২০১১ এর জানুয়ারি। তিউনিসিয়ায় গণবিপ্লবের জোয়ার এসে ঠেকেছে মিসরে। তাহরির চত্বরে চলছে দুর্নীতি আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদের সফল মঞ্চায়ন। ফলাফল, ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে প্রায় ৩০ বছর ধরে মিসর শাসন করে চলা হোসনি মুবারকের পদত্যাগ [৪]।
মঞ্চ এখন ইয়েমেন
গণবিপ্লবের এই সাফল্য এবার জোয়ারকে আরও শক্তিশালী, আরও ত্বরান্বিত করে নিয়ে আসে ইয়েমেনে। জ্বলে ওঠে ইয়েমেন। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গরীব এই দেশে দুর্নীতি, দারিদ্র্য, বেকারত্বের ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত সাধারণ জনতার প্রতিবাদে মুখরিত হতে থাকে ইয়েমেনের রাজপথ। দাবানলকে আরও উস্কে দেয় একটি সংবিধান সংশোধনের পায়তারা। যে সংশোধনের বলে সারাজীবন প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ [৫]। জনতার দাবি একটাই- পদত্যাগ করে হবে প্রেসিডেন্টকে।
প্রবল প্রতিবাদের মুখে মার্চের ১১ তারিখ সালেহ বলেন, জনতার সকল দাবি মেনে নেয়া হবে। প্রস্তাব করেন সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ সংসদীয় পদ্ধতির, যাতে নির্বাচনী আইনগুলো পুনর্বিবেচনা করা হবে। পদত্যাগ করতে নারাজ সালেহ আরও বলেন, তিনি পরবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আর লড়বেন না।
এরপর ঘটনা এগোতে থাকে হ্যাঁ এবং না এর মধ্যে দিয়ে। উপসাগরীয় দেশগুলোর পরিষদ গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) মধ্যস্থতায় চলতে থাকা এক চুক্তিতে এপ্রিলের ২৩ তারিখ সালেহ পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। কিন্তু ৩০ তারিখেই আবার মত উল্টে ফেলেন এবং পরবর্তীতে চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অসম্মতি জানান তিনি।
এ অবস্থায় জিসিসির মধ্যস্থতাকারী কোনো সুষ্ঠু সমাধানে ব্যর্থ হয়ে মে মাসের ১৯ তারিখ ইয়েমেন ত্যাগ করলে পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে থাকে আন্দোলনকারীদের এবং অবশেষে জুনের ৩ তারিখে প্রেসিডেন্ট ভবন লক্ষ্য করে মিসাইল ছোঁড়ার মধ্যে দিয়ে তা সশস্ত্র রূপ নেয়। একই দিনে সালেহ এবং অন্যান্য উঁচু পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তারা একটি মসজিদে নামাজরত অবস্থায় খুব নিকটেই একটি বোমা ফাটানো হলে গুরুতর আহত হন সালেহ [৫]। সৌদি আরবে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সেপ্টেম্বরে ফেরেন তিনি। তার ঠিক দু’মাস পরে নভেম্বরের ২৩ তারিখে কোনো ধরনের আইনি জটিলতা থেকে মুক্তির (ইমিউনিটি) বিনিময়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে সম্মত হন সালেহ।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট আব্দ রাব্বু মনসুর হাদির কাছে প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে ইয়েমেনের শাসক হিসেবে আলী আব্দুল্লাহ সালেহর ৩৩ বছরের শাসনকালের অবসান ঘটে। প্রাথমিক বিজয় হয় বিপ্লবীদের।
কিন্তু সফল বিপ্লবের পর…
দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট হাদি চলমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার পাশাপাশি আরেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। আর তা হলো, মুসলিমদের মধ্যে সুন্নি-শিয়া বিরোধ। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক থেকে শিয়া মতবাদী মুসলিমদের মধ্য থেকে সা’দাহ অঞ্চল থেকে একটি আন্দোলনের জন্ম হয়, যার নাম হুথি আন্দোলন। একুশ শতকের প্রথম দশকে এদের বেশ কিছু বিদ্রোহের প্রচেষ্টা প্রতিহত করেন সালেহ। কিন্তু, দেশের এমন অস্থিতিশীল পরিবেশের সুযোগ নিয়ে পুনরায় চাঙ্গা হয় তারা এবং ২০১১ এর ডিসেম্বরে ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলে সাদা রাজ্যের দাম্মাজ শহরে ঘাঁটি গাড়ে, যা সেই অস্থির সময়ে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয় সামরিক বাহিনী।
এদিকে নতুন প্রেসিডেন্টের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে এবং তাদের অধিকৃত অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে শিয়া-সুন্নি সংঘর্ষ চলমান রাখে পুরো ২০১২ সাল ধরেই। হাদি একে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করলেও ২০১৩ সালের বিভিন্ন সময়ে সৌদি আরব প্রায় ৪ লাখের মতো ইয়েমেনি অভিবাসীদের ফেরত পাঠালে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুনরায় দারিদ্র্যপীড়িত, আবাসহীন জনগণের মধ্যে হাহাকার রব ওঠে। বিপ্লবের প্রাথমিক বিজয়ের ইন্দ্রজাল থেকে বের হয়ে তারা বুঝতে পারে, ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও বদলায়নি আর কিছুই।
এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে হুথিরা আবার সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করলে এবার তাতে যোগ দেয় বেশ কিছু সুন্নিও। একযোগে আক্রমণ চালিয়ে সাদা থেকে অগ্রসর হয়ে ২০১৪ এর ২১ সেপ্টেম্বর হুথিরা রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নিলে দুই পক্ষের সমন্বয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠনের দাবি করতে থাকে তারা। উপায়ান্তর না দেখে হাদি তা কার্যকরও করেন। সুযোগসন্ধানী হুথিরা এবার পুরো দেশের ক্ষমতা নিতে চাইলে পরবর্তী মার্চেই সৌদি আরব পালিয়ে যান হাদি। হুথিদের এ অগ্রযাত্রার পেছনে সালেহর সমর্থন আছে বলে মনে করেন অনেকে।
ঘরের ভিতর পর
ইয়েমেনে হুথিদের উত্থানের পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় শিয়া শক্তি ইরানের সমর্থন আঁচ করে নড়েচড়ে বসে সৌদি আরব ও আরও ৮ সুন্নি মতাদর্শী আরব রাষ্ট্র [৬]। হুথিদের হটিয়ে হাদিকে পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে বহাল করার লক্ষ্যে তারা একযোগে ইয়েমেনে বিমান আক্রমণ পরিচালনা করে। মূলত এখান থেকে শুরু হয় যুদ্ধ। ২০১৫ এর আগস্টে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় শহর আদেনে এই জোটের সেনাবাহিনী অবতরণ করে এবং এখান থেকে হুথিদের হটিয়ে দেয়, কিন্তু হুথিরা তখনও রাজধানী সানাতে তাদের দখল ধরে রেখেছে।
এভাবে একদিকে সৌদি নেতৃত্বাধীন হাদিপন্থী জোট, অন্যদিকে হুথিদের আক্রমণ পাল্টা আক্রমণের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকে গৃহযুদ্ধ। ২০১৭ এর নভেম্বরে সৌদি আরবের রিয়াদ লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক মিসাইল ছোঁড়া হলে সৌদি আরব এ এলাকায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে এবং ফলস্বরূপ বিভিন্ন স্থান কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। জীবন ধারণের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়লে জুলাই ২০১৭-তে কলেরার প্রকোপ শুরু হয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত এ প্রকোপ আগের সীমা-পরিসীমা তো ছাড়িয়ে গেছেই, সাথে যোগ হয়েছে দুর্ভিক্ষ, যা ক্রমশই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
আর কত প্রাণনাশের পর সকল পক্ষের বিবেক জেগে উঠবে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।