Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সিল্ক রোডের বাঁকে রোমাঞ্চের খোঁজে

পৃথিবীর মানচিত্রে বিশাল একটা জায়গা দখল করে আছে মধ্য এশিয়া। পেরুর মাচুপিচু, মিশরের পিরামিড, চীনের মহাপ্রাচীরের মতো অতি আলোচিত কোনো নিদর্শন এখানে নেই; তবে অনন্য ভূ-প্রকৃতি, বিশুদ্ধ ঐতিহ্য, বিচিত্র সংস্কৃতি, সমৃদ্ধ ইতিহাস ও আধুনিক শহর নিয়ে মুখর মধ্য এশিয়া। ইরান ও আফগানিস্তানের উত্তরে, রাশিয়ার দক্ষিণে জিগস পাজলের মতো কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান নিয়ে গঠিত এলাকার নামই মধ্য এশিয়া।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগপর্যন্ত এই দেশগুলো তারই অংশ ছিল। অঞ্চলটি রুক্ষ পাহাড়, অনুর্বর সমভূমি নিয়ে গঠিত। সুবিশাল পর্বতমালা মধ্য এশিয়ার শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য। পৃথিবীর কাছে খুব একটা পরিচিত নয় বলে খুব কমই পর্যটকের দেখা মেলে এখানে। অবশ্য সাম্প্রতিককালে মধ্য এশিয়া পর্যটনবিমুখতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বেশ জোরেশোরেই।

তো… কথা হচ্ছে- কেন জীবনে খুব অল্পই নাম শোনা এই বিশাল অঞ্চলে পা রাখতে চাইবেন আপনি? এরই ১০টি কারণ জানাবো এই লেখায়।

১. দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চার

মধ্য এশিয়ার মাটিতে পা রাখলে আপনার পক্ষে অ্যাডভেঞ্চার এড়ানো অসম্ভব। তুষারঢাকা পাহাড়, ছড়ানো তৃণভূমি আর ঘন বনে ছাওয়া এই অঞ্চল বিজন প্রান্তরে লেকের ধারে ক্যাম্পিং, পাহাড়ের ট্রেকিং, হাইকিং, ঘোড়ায় চড়া, পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া সর্পিল পথে রোডট্রিপের জন্য উন্মুক্ত। মধ্য এশিয়ার দুনিয়ার কাছে প্রায় অচেনা ট্রেকিং ট্র্যাকগুলোতে কদাচিৎ পা পড়ে মানুষের। তাই খুব সযতনে লুকিয়ে রাখা প্রকৃতির এই অকৃত্রিম সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করতে পারবেন আপনি।

Image Source: Against The Compass

শ্বাসরুদ্ধকর গিরিপথগুলোতে হাইকিংও কম রোমাঞ্চকর নয়। আলাউদ্দীন পাসের কাছেই তাজিক রাজধানী দুশানবে। ট্রেকিংয়ের পর ক্লান্ত শরীরকে জিরিয়ে নিতে পারেন এখানে।

২. সমৃদ্ধ শহর

ঐতিহাসিক সিল্করোডের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে থাকা শহরগুলো মধ্য এশিয়ার সেরা রত্ম। উজবেকিস্তানের বুখারা, সমরকন্দ, খিভা মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত পুরনো শহর। এই শহরগুলোতে পর্যটকরা পুরনো সভ্যতাগুলোর চিহ্ন কাছ থেকে দেখতে পারবেন। শহর ঘুরে ক্লান্ত হলে আগের যুগের বণিকদের বিশ্রামের জন্য বানানো ক্যারাভানসরাইয়ে জিরিয়ে নিতে পারবেন কিছুক্ষণ। আধুনিক শহরের মাঝে কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকের ব্যস্ত বাজার, তাসখন্দের প্রশস্ত রাজপথ দেখার মতো।

বুখারা; Image Source: Wikimedia Commons

৩. অনুপম স্থাপনা

মধ্য এশিয়ার স্থাপত্যের তুলনা নেই। বিশাল গম্বুজ, সুউচ্চ মিনার, বহাল তবিয়তে টিকে থাকা প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ মধ্য এশিয়াকে স্থাপনায় সমৃদ্ধ করেছে। সূক্ষ্ম ও নিখুঁত কারুকাজের অনুপম স্থাপত্যসম্ভার বিস্ময়াভিভূত করবে আপনাকে। উজবেকিস্তানের রেজিস্তান স্কয়ারের বিশালতায় মুগ্ধ হবেন আপনি।

রেজিস্তান স্কয়ার; Image Source: Wikimedia Commons

তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাতের সারি সারি সাদা মার্বেলের ভবনের ভৌতিক সৌন্দর্যে চোখ কপালে উঠবে, মনে হবে আছেন বোধহয় ভিনগ্রহে!

৪. ইতিহাস ও সিল্করোড

হাজার বছরের পরিব্রাজক, বণিক, ডাকাত, তেজী যোদ্ধাদের পায়ের ছাপ ধারণ করা সিল্করোডের স্থলপথগুলো চলে গিয়েছিল মধ্য এশিয়ার শহর আর মরুভূমির উপর দিয়ে। দীর্ঘদিন মধ্য এশিয়া এই রুটের মাধ্যমে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মাঝে সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করেছে। এই রুট ধরে বিনিময় হয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্ম, জীবনদর্শন। মধ্য এশিয়া সবসময়ই ছিল শিল্প-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উর্বরভূমি। এখানে নানা সংস্কৃতি ও জীবনাদর্শন লালিত হয়েছে, বিচিত্র সংস্কৃতির মিশ্রণে নতুন সংস্কৃতি তৈরী হয়েছে এবং সেসব সিল্করোডের মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীজুড়ে।

Image source: Meer

গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানের কারণে শক্তিশালী অসংখ্য সাম্রাজ্যে গড়ে উঠেছিল এখানে; মুসলিম খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য, চেঙ্গিস খানের মঙ্গোল সাম্রাজ্য, তৈমুর লং ও তার বংশধরদের তিমুরিদ সাম্রাজ্য। ইসলামী শাসনের অধীনে থাকার সময়ে এই অঞ্চলের মুসলিম জ্ঞানসাধকগণ গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। বীজগণিতে মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল-খারিজমি, গণিত ও কাব্যশাস্ত্রে ওমর খৈয়াম, হাদীসশাস্ত্রে ইমাম বুখারি, দর্শনে আল ফারাবীর অতুলনীয় অবদান সমৃদ্ধ করেছে পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারকে।

৫. বিশুদ্ধ সংস্কৃতি

সবগুলো দেশের সংস্কৃতিতে বেশ ভিন্নতা থাকলেও অনেক দিক থেকেই আবার অভিন্ন। ইসলাম এখানে প্রধান ধর্ম, মানুষজন মূলত যাযাবর জীবনযাপন করে, গ্রামাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য ঘোড়াই একমাত্র বাহন। এখনও তির-ধনুক দিয়ে শিকার করার প্রচলন আছে। সব দেশে দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন লক্ষ্যণীয়। জীবনযাত্রা এখনও অনেক সরল, পশ্চিমের দুর্বার গতি এখনও এসে পৌঁছায়নি। এজন্য সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতা রক্ষিত হয়েছে বেশ ভালোভাবেই।

৬.  ইয়ার্টের সরল জীবন

Image source: Wikimedia Commons

মধ্য এশিয়ার ঘাসঢাকা প্রান্তর ধরে কোনো গ্রামে যদি পৌঁছে যান, দেখতে পাবেন মানুষজন বাস করে গোলাকার এক ধরনের ঘরে। কাঠের পাত, ফেল্ট, ক্যানভাস ও ভেড়ার পশমে তৈরি সাদা রঙের এই ঘরকে বলা হয় ইয়ার্ট। ইয়ার্ট গরমকালে ঠান্ডা থাকে, আর শীতকালে থাকে গরম। মধ্য এশিয়ার তীব্র গরম আর তুষারঝরা শীতে তাই এটা আদর্শ আবাস। ইয়ার্টের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটা সুবিধামতো সরানো যায়। যাযাবর মানুষজনের জীবনকে একদমই ঝামেলাহীন করে দিয়েছে এটা।

৭. অতিথিপরায়ণ মানুষজন

রাশিয়া, চীন, ইরানের সাথে সীমান্ত থাকায় মধ্য এশিয়ায় বিচিত্র জাতিসত্তার মানুষের দেখা মেলে। এশীয়, ইউরোপীয় বা আরব যেমনই হোক দেখতে, সবাই অতিথিপরায়ণ। বিদেশীদের খাতির করতে জুড়ি নেই তাদের।

যে কেউ আপনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে তাদের ঘরে মেহমান হতে বলবে। এরকম কোনো আন্তরিক ব্যক্তির ইয়ার্টে অতিথি হলে আপনার হাইকিং হবে সহজ, সেই সাথে ইয়ার্টে থাকার বিচিত্র অভিজ্ঞতা জুটে যাবে কপালে।

৮. স্বপ্নময় পাহাড়

হিমালয় পর্বতমালা যেখানে তিয়ান শান, কুনুলুন কারাকোরাম আর হিন্দুকুশের সাথে মিলেছে, সেখানেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পামির পর্বতমালা। পৃথিবীর কয়েকটি বৃহত্তম পর্বতমালার তুষারঢাকা চূড়াকেই সম্মিলিতভাবে বলা হয় ‘পৃথিবীর ছাদ’। পামির মূলত তাজিকিস্তান ও আফগানিস্তানে পড়েছে, তবে উত্তরে কিরগিজস্তান, দক্ষিণে পাকিস্তান ও পূর্বদিকে চীনে কিছুটা বিস্তৃতি আছে এর। পৃথিবীর ছাদে পা রাখতে পারা যেকোনো পৃথিবীবাসীর জন্য ঈর্ষণীয় সৌভাগ্যের ব্যাপার।

Image Source: Bucket Listly Blog

এই অবিশ্বাস্য উচ্চতায় পৌঁছানোর ইচ্ছা থাকলে আপনার সাহায্য নিতে হবে পামির হাইওয়ের। ৪,৬৫৫ মিটারের অবিশ্বাস্য উচ্চতায় অবস্থিত পামির হাইওয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম হাইওয়ে। তাজিকিস্তানের বিপদসঙ্কুল, দুর্গম পাহাড় পাড়ি দিয়ে পামির হাইওয়ে ধরে চলার দুঃসাহস যদি আপনি দেখাতে পারেন, তাহলে পথিমধ্যে সাক্ষাৎ পাবেন রুক্ষ পাহাড়ের কোলে সুদৃশ্য লেকের, হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক দুর্গের, পাথরের গায়ে আঁকা প্রাগৈতিহাসিক ছবি পেট্রোগ্লিফের, আর বিক্ষিপ্ত লোকালয়ে ক্ষণিক দর্শন উচ্ছ্বল শিশুর হাসিমুখ।

৯. ঐতিহ্যবাহী বাজার

সিল্ক রোডের সোনালি যুগে মধ্য এশিয়া ছিল বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। তাই সিল্করোডের শহরে যে নামী বাজার থাকবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। প্রাচীনকালে এসব বাজারে দেশ-বিদেশের বণিকদের কাছে যে শুধুই পণ্যদ্রব্য বিক্রি হতো তা নয়,  বিনিময় হতো নানা সংবাদ আর দর্শনের। এখনকার দিনে শুকনো ফল, তাজা মাংস, হরেকরকম মশলা থেকে জামাকাপড় বা গৃহস্থালীর আসবাব সবই পাওয়া যায় বাজারগুলোতে।

প্রত্যেক দেশের বাজারেই কিছু অনন্যতা মিশে আছে। ভিন্ন সজ্জা, ভিন্ন গড়ন-গঠন হলেও প্রতিটি বাজারের প্রাণপ্রাচুর্যে মুগ্ধ হবেন আপনি। বিখ্যাত বাজার খুঁজলে যেতে হবে তাজিকিস্তানের ওশ, কাজাখাস্তানের আলমাটি, তাজিকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের ইশকাশিম, আর উজবেকিস্তানের বুখারা শহরে।

১০. প্রশান্তিদায়ক প্রকৃতি

মধ্য এশিয়ার শহরগুলোর ব্যস্ততা ছাড়িয়ে এলে পাওয়া যায় মাইলের পর মাইল বিস্তৃত জনমানবহীন তৃণভূমি। তৃণভূমির মাঝখানে পাহাড়-পর্বত। এই পাহাড়ঘেরা তৃণভূমিটি বিখ্যাত ইউরেশিয়ান স্তেপের অংশ। এখানে পাহাড় কেটে পথ করে নিয়েছে খরস্রোতা নদী, তৃণভূমি ছেয়ে আছে রঙিন বুনোফুলে, আকাশটা অনেক বেশি নীল। শান্ত প্রকৃতির এই কোলে শুধু নীরবতার কোলাহল। এখানে গভীর নিঃশ্বাসে প্রাণভরে নেয়া যায় বিশুদ্ধ বাতাস। হিন্দুকুশ ছুঁয়ে বয়ে আসা শীতল বাতাস মনের কোণে জমা পুরনো ক্ষত যেন সারিয়ে দেয়!

কপাল ভালো থাকলে দেখা পেতে পারেন মার্কো পোলো জাতের ভেড়া, সাইগা এন্টিলোপ, তুষারচিতার মতো দুষ্প্রাপ্য বন্য জন্তু-জানোয়ারের।

মধ্য এশিয়ার নগরে-প্রান্তরে জীবন্ত ঐতিহ্য, নির্ভেজাল প্রকৃতি, নিস্তরঙ্গ যাযাবর জীবন, ওয়ালনাটবিথী, তারাভরা আকাশের সান্নিধ্যে কিছুদিন কাটিয়ে আসার পর আপনার মনে অনেকদিন জেগে থাকবে রেজিস্তানের ঐশ্বর্য্য, বুনোফুলের ঘ্রাণ ও শীতল বাতাসের পরশে মনজুড়ানোর স্মৃতি, আর থাকবে আবার ফিরে আসার পিছুটান!

  

Language: Bangla
Topic: 10 reasons to travel to Central Asia
References:
1. Central Asia's Golden Age: Why it Happened, Why it Ended - Wilson Center
2. Reasons to Explore Central Asia - Discover Central Asia Tours
3. 10 REASONS TO TRAVEL TO CENTRAL ASIA - The Planet

Related Articles