Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

৯৯৬: চীনের প্রযুক্তিনির্মাতা কোম্পানিগুলোর অন্ধকার অধ্যায়

বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীনের প্রভাব দিনের পর দিন যে বেড়েই চলেছে– এটা কোনো গোপন তথ্য নয়। গত দুই দশক ধরেই চীনের অব্যাহত উন্নতি প্রত্যক্ষ করছে সারা বিশ্ব। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সামরিক উন্নয়নেরও সম্পর্ক আছে। প্রতিটি শক্তিশালী রাষ্ট্র সামরিক খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে পারে, কারণ পরিকল্পিত অর্থনীতি তাদের বিশাল ব্যয়ের সুযোগ করে দেয়।

বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে চীন বর্তমানে এক পাকা খেলোয়াড়, ভূরাজনৈতিক অনেক সমীকরণ বদলে দিয়েছে যার আবির্ভাব। সামনের এক দশকের মধ্যে চীন অর্থনৈতিক দিক থেকে আমেরিকাকে টপকে গেলে যে বিশ্বব্যবস্থায় আরও বড় পরিবর্তন আসবে, এ কথা বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করে দিয়েছেন আরও আগে থেকেই। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পর প্রায় সবক্ষেত্রেই প্রযুক্তি হয়ে দাঁড়াবে মানুষের প্রধান বিকল্প। চীনারা এটা অনুধাবন করেই তাদের প্রযুক্তিশিল্প শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে ফেলেছে।

Image Source: Singularity Hub

আলিবাবা, হুয়াওয়ে, বাইডু, টেনসেন্ট কিংবা শাওমি– চীনা প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা কোম্পানিগুলো দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও দোর্দণ্ড প্রতাপে বাণিজ্য করে চলেছে। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রযুক্তিপণ্যের বাজার বলতে গেলে চীনা কোম্পানিগুলোর দখলে। কারণ, এসব দেশের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী চমৎকার সব প্রযুক্তি চীনা কোম্পানিগুলো সফলভাবে সরবরাহ করতে সমর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এই কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যচর্চা নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন না উঠলেও সম্প্রতি চীনা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চীনা কোম্পানিগুলোর অনৈতিক অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

চীনের শীর্ষ ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদের ক্ষেত্রে ‘৯৯৬’ নামের একটি নিয়ম মেনে চলে। ‘৯৯৬’ বলতে বোঝানো হয় সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করা। অর্থাৎ চীনা প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা কোম্পানিগুলোর কর্মীদের সপ্তাহে ৭২ ঘন্টা পেশাদারি দায়িত্ব পালন করতে হয়! পৃথিবীর প্রায় সব দেশের তুলনায় এই সংখ্যা অনেক বেশি। চীনা সরকারকর্তৃক প্রণীত নিয়ম অনুযায়ী, কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান তার কর্মীদের দিনে সর্বোচ্চ আট ঘন্টা এবং সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪৪ ঘন্টা কাজ করিয়ে নিতে পারবে। এর বাইরে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কর্মীদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়, তাহলে মূল বেতনের বাইরে গিয়ে বাড়তি কর্মঘণ্টার (ওভারটাইম) হিসেবে অর্থ প্রদান করতে হবে। কাগজে-কলমে এই আইন বলবৎ থাকলেও বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। প্রায় সমস্ত প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা কোম্পানি এই নিয়ম বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর ধরে কর্মীদের বাড়তি সময় খাটিয়ে আসছে, কোনো বাড়তি অর্থ প্রদান করা ব্যতিরেকেই।

চীনের বিখ্যাত প্রযুক্তিনির্মাতা কোম্পানিগুলোর কর্ণধারেরা আবার ‘৯৯৬’ নিয়মকে বরাবরই সমর্থন করে এসেছেন। ই-কমার্স প্লাটফর্ম আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা বলেছেন, “ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এই নিয়ম একটি বিশাল আশীর্বাদ। যদি তুমি বাড়তি সময় ও শ্রম না দাও, তাহলে কীভাবে সফলতা তোমার হাতে এসে ধরা দেবে?” এছাড়াও আরেক চীনা ই-কমার্স প্লাটফর্ম জেডডি.কম এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিচার্ড লিউ মনে করেন, যারা এই নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে তারা ‘অলস’। চীনা কোম্পানিগুলো এই নিয়মের কারণে কর্মীদের বাড়তি খাটিয়ে বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারে– মূলত এজন্যই এই নিয়মের পেছনে তারা প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে আসছেন।

Image Courtesy: Fortune

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দ্বারা অনুসৃত এই নিয়মের কারণে চীনে বেশ কিছু সামাজিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। চীনে বর্তমানে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে জন্মহার কমে যাওয়া। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে চীনের কর্মক্ষম জনশক্তি কমে যাচ্ছে, যেটা চীনা সরকারের জন্য একটি আশঙ্কার বিষয়। একসময় চীন ‘এক সন্তান নীতি’ কঠোরভাবে অবলম্বন করে আসলেও বর্তমানে তারা এই নীতি থেকে সরে এসেছে।

চীনা সরকার বর্তমানে একাধিক সন্তান গ্রহণে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে কর্মক্ষেত্রের অতিরিক্ত চাপে চীনা তরুণরা বিয়ে কিংবা সামাজিক সম্পর্কতে জড়ানোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এছাড়া সন্তান গ্রহণ করলে তার বেড়ে ওঠার পেছনেও সময় দিতে হবে, যেটা ‘৯৯৬’ নিয়মের কারণে সম্ভব নয়। ব্যক্তিজীবনে সময় দেয়ার পরিমাণ একেবারেই কমে যাওয়ার ফলে তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এছাড়া একটানা কাজ করার ফলে শারীরিক ও মানসিক অবসাদও জেঁকে বসছে তাদের মধ্যে। মোটকথা, এই নিয়মের কারণে কোম্পানিগুলো দারুণ সুবিধা লাভ করলেও কর্মীদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

২০১৯ সালে ওপেন সোর্স শেয়ারিং প্লাটফর্ম গিটহাবে প্রথম ‘ওয়ার্কার্স লাইভস ম্যাটার’ (Workers’ Lives Matter) অনলাইন ক্যাম্পেইন শুরু হয় এই নিয়মের প্রতিবাদে। কয়েকজন প্রোগ্রামার এই ক্যাম্পেইন শুরু করেন। তারা সেখানে এই নিয়মের কারণে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সেগুলো লিপিবদ্ধ করেন এবং যেসব স্টার্টআপ কোম্পানি এই নিয়ম অনুসরণ করে, সেগুলোকে কালো তালিকাবদ্ধ করেন। তাদের এই ক্যাম্পেইন ক্রমেই জনপ্রিয়তা পায়।

২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে লি নামের একজন কর্মী কর্মরত অবস্থায়ই বাথরুমে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান এবং পরবর্তীতে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পেছনে ‘৯৯৬’ নিয়মকে দায়ী করা হয়। পরবর্তীতে মামলা হলে চীনা কোর্টের রায়ে দায়ী কোম্পানির পক্ষ থেকে লির পরিবারকে প্রায় এক লাখ বিশ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলা হয়। এছাড়াও সম্প্রতি বেশ কিছু আদালত ‘৯৯৬’ নিয়মকে ‘অবৈধ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে কোম্পানিগুলো এতদিন সরকারি নিয়মকে পাশে সরিয়ে রেখে যেভাবে কর্মীদের বাড়তি খাটাতে বাধ্য করেছে, সেটি সামনের দিনগুলোতে করা সম্ভব হবে না।

Image Source: Forbes

অনেক কর্মীই বলছেন, তারা ‘৯৯৬’ নিয়মের পরিবর্তে ‘৯৫৫’ নিয়ম চান। অর্থাৎ তাদের প্রস্তাবিত তাদেরকে প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত সপ্তাহে পাঁচদিন কাজ করতে হবে। এই নিয়মে তারা সপ্তাহে মোট চল্লিশ ঘন্টা পেশাদারি দায়িত্ব পালন করবেন। পৃথিবীর অনেক দেশেই নিয়োগকর্তারা কর্মীদের কর্মঘন্টা কমিয়ে আনার দিকে মনোনিবেশ করেছে। নিউজিল্যান্ড ও জাপান এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, একটানা কাজ করার ফলে একপর্যায়ে কর্মীদের কাজে মনোযোগের ক্ষমতা কমে যায়। বাড়তি সময়ে কর্মীদের কাছ থেকে যতটুকু ফলাফল পাওয়ার কথা, সেটুকু পাওয়া সম্ভব হয় না। তাই অতিরিক্ত কর্মঘন্টা না খাটিয়ে অল্প সময়ে কর্মীদের সর্বোচ্চ উৎকর্ষতা কাজে লাগানোর দিকেই দৃষ্টি দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয় বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে। ইউরোপের অনেক দেশেই কর্মীদের ব্যক্তিজীবনে একটি বড় সময় ব্যয় করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হয়েছে।

চীনের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা এখনও কমিউনিস্ট ঘরানার। কমিউনিজমে শ্রমিক শোষণ যেন না হয়, সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। এতদিন ধরেও যে চীনে এভাবে কর্মীদের বাড়তি সময় খাটানোর নিয়ম প্রচলিত ছিল, সেটিই এক বড় বিস্ময়। এই নিয়মের কারণে কোম্পানিগুলো সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করতে পারছিল, যেটি দেশের অর্থনীতি শক্তিশালীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিল। সম্ভবত এই কারণেই এতোদিন পর্যন্ত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন থেকে এই নিয়ম বলবৎ করা যে কঠিন হয়ে যাবে, সেটা চীনা সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডেই পরিষ্কার।

Language: Bangla

Topic: 996 rule in Chinese tech companies

References:

১) China steps in to regulate brutal '996' work culture - BBC

২) China’s 996 work culture is labour exploitation by another name - SCMP

৩) In China, criticism of ‘996’ culture grows as employees share work details on GitHub - Lifestyle Asia

৪) This is 996 culture, a grueling 72-hour work week popular in China that's been criticized for ruining work-life balance - Business Insider

Feature Image: Pandaily

Related Articles