রুশ ইতিহাস বিষয়ে বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব স্টিফেন কটকিন। তার অসাধারণ কাজগুলোর একটি হচ্ছে জোসেফ স্ট্যালিনের জীবনী। এখন পর্যন্ত তিনি এর দুটি ভলিউম প্রকাশ করেছেন- প্যারাডক্স অব পাওয়ার, ১৮৭৮-১৯২৮, যেটা পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়ার তালিকায় ছিল, এবং ওয়েটিং ফর হিটলার, ১৯২৯-১৯৪১। তৃতীয় ভলিউমটি হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কে নিয়ে, ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যু এবং তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত শাসনামল নিয়ে। অনেকদিন ধরে নিষিদ্ধ থাকা বেশ কিছু সোভিয়েত নথির সাহায্য নিয়ে স্ট্যালিনের জীবনী লিখেছেন, যা স্ট্যালিন সম্পর্কিত পূর্ববর্তী জীবনীগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।
একাডেমিক ঘরানায় কটকিনের বিশেষ সুনাম আছে। তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হোভার ইন্সটিটিউশনের সিনিয়র ফেলো। সম্প্রতি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে যুদ্ধ প্রসঙ্গ ছাড়াও রাশিয়ার ইতিহাসের অনেক বিষয় উঠে এসেছে। পাঠকদের জন্য এই সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করা হলো।
ইউক্রেন-রাশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির কারণ নিয়ে আমরা অতীতে ও বর্তমানে আলোচনা শুনে আসছি। জর্জ কেনান এটার জন্য দায়ী করছেন পূর্ব-ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণকে। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জন মার্শহেইমারও একই সুরে দায়ী করছেন যুক্তরাষ্ট্রকে। এ প্রসঙ্গে আপনার মন্তব্য শুনতে চাই।
কটকিন: জর্জ কেনানকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করি। জন মার্শহেইমারও একজন বড় পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু আমি খুবই সম্মানের সাথে তাদের তত্ত্বের সাথে দ্বিমত করি। সমস্যা হচ্ছে তারা মনে করছেন ন্যাটোর সম্প্রসারণ না হলে রাশিয়া আজ এমন করত না, কিংবা এমন পরিস্থিতিই তৈরি হতো না। আমরা রাশিয়াকে আজ যা করতে দেখছি, তা অবাক করার মতো কোনো বিষয় নয়। আপনি যদি ইতিহাসের প্যাটার্ন অনুযায়ী একে বিচার করেন, এটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়।
ন্যাটোর জন্মের অনেক আগে উনবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ার অবস্থা ছিল এমন- তাদের একজন স্বৈরশাসক ছিল, সেখানে নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড ছিল, সেখানে সামরিকবাদ প্রচলিত ছিল। রাশিয়া সবসময়ই ভিনদেশীদের এবং পশ্চিমা বিশ্বকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছে। আমরা যে রাশিয়াকে চিনি, সেটা এমন না যে হঠাৎ করে গতকাল এমন হয়ে গেছে কিংবা নব্বই দশকে হয়েছে। তারা মোটেও পশ্চিমাদের কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য এমন হয়নি। রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডের জন্যই তাদেরকে এমন অবস্থায় আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি।
আমি বরং আরো যোগ করে বলব, ন্যাটোর সম্প্রসারণের জন্যই রাশিয়ার ইতিহাসের প্যাটার্ন অনুসরণ করা সহজ হয়েছে, যা আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি। যদি পোল্যান্ড আর বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো ন্যাটোর সদস্য না হতো, তাহলে আমরা এখন কী দেখতাম? ইউক্রেন আজ যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাদেরও একই পরিণতি বরণ করতে হতো। বরঞ্চ পোল্যান্ড সদস্য হওয়ার কারণে ন্যাটো আরো শক্তিশালী হয়েছে। পোল্যান্ড রাশিয়ার বিপক্ষে অতীতে বিভিন্ন সময়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে, যা ন্যাটোর অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে দেখা যায়নি। জর্জ কেনান নিঃসন্দেহে একজন অসাধারণ বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন এবং রাশিয়া বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু আমার কাছে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পশ্চিমা বিশ্বকে দায়ী করা সঠিক বিশ্লেষণ মনে হয় না।
আপনার রাশিয়া বিষয়ক আলোচনা নিয়ে ছয় বছর আগে ফরেন অ্যাফেয়ার্সের একটা কলামের কথা মনে পড়ে যেখানে আপনি লিখেছিলেন, “রাশিয়ার পাঁচশ বছরের পররাষ্ট্রনীতি ছিল খুবই উচ্চাভিলাষী, যা দেশটির ধারণ ক্ষমতারও বাইরে ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে ইভান দ্য টেরিবলের সময় থেকে রাশিয়া প্রতিদিন ৫০ বর্গমাইল করে তাদের ভূখণ্ড বর্ধিত করতে থাকে, যা কয়েকশত বছর প্রচলিত থাকে। এতে বিশ্বের ছয় ভাগের এক ভাগ ভূমিই রাশিয়ার দখলে চলে আসে।”
আপনি এরপর রাশিয়ার উত্থানের তিনটি ‘ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত’ নিয়ে আলোচনা করেন- প্রথমে পিটার দ্য গ্রেটের উত্থান, এরপর নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে প্রথম আলেক্সান্ডারের বিজয়, এবং এরপর অবশ্যই হিটলারের বিরুদ্ধে স্ট্যালিনের বিজয়। এরপর আপনি বলেন, “এই বিশেষ মুহূর্তগুলো বাদ দিলে রাশিয়া প্রায় সবসময়ই তুলনামূলক দুর্বল পরাশক্তি ছিল।” আপনি কি একটু ব্যাখ্যা করবেন, রাশিয়ার এমন নীতি বর্তমানে পুতিনের অধীনের সময়টাতে কীভাবে প্রভাব ফেলছে?
কটকিন: আমরা ইরাক প্রসঙ্গেও এমন আলোচনা করেছিলাম। ইরাকের পরিস্থিতির জন্য কি সাদ্দাম দায়ী ছিলেন, নাকি ইরাকের পরিবেশই সাদ্দামকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল? অন্যভাবে বলা যায়, ব্যক্তিত্বের একটা প্রভাব থাকে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে সেখানে কাঠামোগত কিছু বিষয়ও থাকে, যা ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে সাহায্য করে। স্ট্যালিনের বইয়ে আমি একটা বিষয় আলোকপাত করেছিলাম যে, সে সময়ের পরিস্থিতিতে একজন স্বৈরশাসক হওয়া এবং রাশিয়ার মতো পরাশক্তির দেশ পরিচালনা করা স্ট্যালিনের ব্যক্তিত্ব তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছিল।
রাশিয়ার শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য, নৃত্য, চলচ্চিত্র যদি বিবেচনা করেন, তাদের সভ্যতা অসাধারণ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর বিশেষ অবস্থান আছে। পুরো সভ্যতাটাই একটা দেশের চেয়েও বড় কিছু। একই সাথে রাশিয়া মনে করে, বিশ্বে তাদের একটা ‘বিশেষ মর্যাদা’ আছে। তাদের একটা বিশেষ লক্ষ্য আছে। তারা প্রাচ্য দর্শনে বিশ্বাসী, পশ্চিমা দর্শনে নয়। এর সাথে তারা একটা পরাশক্তি হিসাবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে চায়। তাদের সমস্যা সবসময় শুধু নিজেদের আত্মপরিচয় নিয়েই ছিল না। বরং তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলোর সাথে সামর্থ্য কখনোই সামঞ্জস্য ছিল না। তাদের সবসময়ই এই আকাঙ্ক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাদের সফল না হওয়ার কারণ পশ্চিমা বিশ্ব সবসময়ই তাদের তুলনায় শক্তিশালী ছিল।
রাশিয়া একটা পরাশক্তি দেশ, কিন্তু একমাত্র পরাশক্তি নয়। ইতিহাসে শুধু কিছু ব্যতিক্রম ঘটনা দেখা যায়, যেগুলোর কথা আপনি উল্লেখ করলেন। তারা পশ্চিমের সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য, অথবা অন্ততপক্ষে পশ্চিমের সাথে নিজেদের ব্যবধান ঘুচানোর জন্য কর্তৃত্ববাদী নীতিতে কাজ করে থাকে। তারা পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য খুবই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক পদ্ধতিতে কাজ করে। এটা কিছু সময়ের জন্য কাজ করে, কিন্তু তা খুবই ভাসা ভাসাভাবে।
রাশিয়া দ্রুত অর্থনীতিতে উন্নতি করতে থাকে, এরপর সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হতে থাকে, এবং এরপর অবশ্যই একটা ভূখণ্ডে আক্রমণ করে। এরপর লম্বা সময়ের জন্য তাদের মধ্যে স্থবিরতা দেখা যায়, যা সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলে। তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টাটা সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলে, এবং পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাদের ব্যবধান আরো বাড়তে থাকে। পশ্চিমা বিশ্ব প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত করতে থাকে। পশ্চিমা বিশ্ব সামরিক দিক দিয়েও সমৃদ্ধ।
রাশিয়ার ইতিহাসের এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বাজে দিক হচ্ছে রুশ রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে একজন শাসকের সংমিশ্রণ। তারা চায় রাশিয়াকে বিশ্ব শাসন করার মতো পরাশক্তি হিসাবে দেখতে। কিন্তু এর বিপরীতে তারা পায় একটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা। তারা একটা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পায়, যা শাসককে কেন্দ্র করে থাকা ব্যক্তিবর্গের স্বেচ্ছাচারে রূপ নেয়। রুশরা এর বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আছে, কারণ তারা ব্যতিক্রমবাদী মনোভাব থেকে বের হতে পারছে না। তারা এমন জায়গায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করে, যার সামর্থ্য তারা রাখে না। অ্যাংলো-আমেরিকান মডেলের বিশ্বব্যবস্থার চেয়ে ইউরাশিয়া অনেক দুর্বল। ইরান, রাশিয়া এবং চীন একই মডেলে চলছে। তারা এভাবেই পশ্চিমা বিশ্বের সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করছে।
পুতিনবাদ কী? এটা স্ট্যালিনবাদের মতো না। এটা অবশ্যই শি জিনপিংয়ের চীন কিংবা ইরানের শাসনব্যবস্থার মতোও না। এর বিশেষত্ব কী? এরকম বিশেষ বৈশিষ্ট্য কেন ইউক্রেন আক্রমণের দিকে নিয়ে গেল, যেটাকে নির্মমতার পাশাপাশি বোকামিও বলা যায়?
কটকিন: দেখুন, সাধারণভাবে দেখলে যুদ্ধ জিনিসটাই একটা ভুল পদক্ষেপ। যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অনুমানের ওপর ভিত্তি করে, এতে আপনি যা বিশ্বাস করেন তা বাস্তবায়িত হয় না। অবশ্যই বর্তমান সময়টা স্ট্যালিন বা জারের সময়ের মতো না। তাদের যুগের সাথে তুলনা করলে রাশিয়ায় বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে নগরায়ন হয়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে। বহির্বিশ্বেও পরিবর্তন এসেছে। আর এটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। বিস্ময় এ কারণে যে, এত পরিবর্তন হওয়ার পরও আমরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে যাচ্ছি।
আপনি ক্ষমতায় দেখছেন এক স্বৈরাচারী শাসককে, যিনি সব সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে নিজে নিয়ে থাকেন। তিনি কি অন্যদের পরামর্শ শুনেন? শুনতে পারেন। আমরা জানি না তাদের কার্যক্রম আসলে কীভাবে চলে। তিনি কি পরামর্শগুলো কানে তুলেন? আমরা জানি না। তার অধীনস্থরা কি তাকে এমন তথ্যগুলো জানান, যেগুলো তিনি শুনতে পছন্দ করেন না? সম্ভাবনা কম। তিনি কি মনে করেন, তিনি অন্য সকলের চেয়ে বেশি বুঝেন? এরকমটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তিনি কি নিজের প্রোপাগান্ডা কিংবা বিশ্ব নিয়ে তার ষড়যন্ত্রমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিশ্বাস করেন? এটাও হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এগুলো কেবলই অনুমান। রুশ কিংবা বিদেশি, খুব কম লোকই পুতিনের সাথে কথা বলেন।
তাই আমরা ধরে নিচ্ছি তিনি সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত নন, যদিও আমরা নিশ্চিত নই। তিনি সেগুলোই জানতে পারছেন যা তিনি শুনতে চান। যেকোনোভাবেই হোক, তিনি বিশ্বাস করেন তিনিই শ্রেয় এবং তিনিই অন্যদের চেয়ে স্মার্ট। একনায়কতন্ত্রের এটাই সমস্যা। একনায়কতন্ত্র, এমনকি কর্তৃত্ববাদী শাসনও এ কারণেই একইসাথে শক্তিশালী ও দুর্বল। একনায়কতন্ত্র এমন পরিস্থিতি তৈরি করে, যা নিজেকেই অবমূল্যায়ন করে। তথ্য প্রবাহ তখন খারাপ হয়ে যায়। ধান্দাবাজদের সংখ্যা বেড়ে যায়। সঠিকভাবে কাজ সম্পাদন করার প্রক্রিয়া কমে যায়। ভুলের সংখ্যা বেড়ে যায়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, পুতিন বিশ্বাস করতেন ইউক্রেন কোন প্রকৃত রাষ্ট্র নয়। ইউক্রেনীয় জনগণরাও প্রকৃত জনগণ নয়, তারা আসলে রুশদের মতোই। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন ইউক্রেন সরকারকে সহজেই সরিয়ে ফেলা যাবে। নিজের সামরিক বাহিনী নিয়ে তিনি বিশ্বাস করতেন, অথবা তাকে বলা হয়েছিল কিংবা তিনি বিশ্বাস করতে চাইতেন একে এমনভাবে আধুনিকায়ন করা হয়েছে যে, এর দ্বারা শুধু একটা সামরিক আক্রমণই নয়, একটা অভ্যুত্থানও ঘটানো সম্ভব। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন কয়েক দিনের মাঝেই কিয়েভ দখল করে একটা পুতুল সরকার বসিয়ে ফেলবেন, অথবা বর্তমান প্রেসিডেন্টকে জোরপূর্বক চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করাবেন।
কিন্তু আপনি ১৯৬৮ সালের আগস্টের প্রাগ বসন্তের কথা চিন্তা করেন। সেখানে আলেকজান্দার দুবচেকের সমাজতন্ত্রের সংস্কার আন্দোলন দমন করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসক লিওনিদ ব্রেজনেভ ওয়ারশ প্যাক্টের ট্যাঙ্ক পাঠান। ব্রেজনেভ দুবচেককে বলতে থাকেন আন্দোলন থামানোর জন্য। এরকম করো না, তুমি সমাজতন্ত্রকে কলুষিত করছ। আর যদি তুমি না থামো, আমরা আসব আক্রমণ করতে।
ব্রেজনেভ ঠিকই আক্রমণে চলে আসলেন। দুবচেক ও অন্যান্য নেতাদের চেকোস্লোভাকিয়া থেকে মস্কোতে নেওয়া হলো। তাদের কোনো পুতুল সরকার ছিল না বসানোর মতো। ট্যাঙ্ক পাঠিয়ে দুবচেককে ধরে আনার পর ক্রেমলিনে ব্রেজনেভ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তারা এখন কী করবেন? এটা দেখতে খুবই হাস্যকর ছিল, এবং এটা হাস্যকর ব্যাপারই ছিল। এটা ছিল ভুল হিসাবনিকাশ এবং ভুল বোঝাবুঝির ফলাফল। প্রাগ বসন্ত দমন করার জন্য ট্যাঙ্ক পাঠিয়ে তারা দুবচেককে চেকোস্লোভাকিয়ায় ফেরত পাঠিয়ে দেন, এবং তিনি ক্ষমতায় থাকেন (১৯৬৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত)।
আরেকটা উদাহরণ হচ্ছে ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের ঘটনাটা। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে আক্রমণ করেনি। তারা আফগানিস্তানে একটা অভ্যুত্থান পরিচালনা করে। তারা রাজধানী কাবুলে একটা স্পেশাল ফোর্স পাঠিয়েছিল। তারা আফগান নেতাদের হত্যা করে এক পুতুল নেতা বাবরাক কারমালকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, যিনি চেকোস্লোভাকিয়াতে নির্বাসনে ছিলেন। এটা তাদের একটা সফলতা ছিল, কারণ সোভিয়েত স্পেশাল ফোর্স আসলেই খুব দক্ষ ছিল। কিন্তু তারা মনে করল আফগানিস্তানে নতুন প্রশাসনের জন্য তাদের নিরাপত্তা দেওয়া প্রয়োজন। তাই তারা সব ধরনের আর্মি রেজিমেন্ট পাঠানো শুরু করল নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। এতে বিদ্রোহ ফুঁসে উঠল, যা রূপ নেয় দশ বছরের যুদ্ধে। এই যুদ্ধে সোভিয়েতদের পরাজয় ঘটে।
ইউক্রেন নিয়ে আমাদের অনুমান ছিল এটা আফগানিস্তানের সফল সংস্করণ হবে। কিন্তু এটা তা হয়নি। দেখা গেল ইউক্রেনীয় জনগণরা প্রতিরোধ গড়ে তুলল, এবং দেশের জন্য প্রাণ দিতেও পিছ পা হলো না। স্পষ্টতই পুতিন এটা বিশ্বাস করেননি। কিন্তু দেখা গেল যুদ্ধের আগে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করতে না পারা ‘টেলিভিশন প্রেসিডেন্ট’ জেলেনস্কির জনসমর্থন যেখানে ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ, বর্তমানে সেটা ৯১ শতাংশতে গিয়ে পৌঁছেছে। তিনি অবিশ্বাস্য সাহসিকতা দেখিয়েছেন। শান্তিকালীন পরিস্থিতিতে কোনো টেলিভিশন প্রোডাকশন কোম্পানির দেশ পরিচালনা করা যৌক্তিক না হলেও এরকম যুদ্ধের সময়ে, যখন আপনার লক্ষ্য তথ্য যুদ্ধেও জয়ী হওয়া, তখন এটা দারুণ ব্যাপার হয়ে ওঠে।
পুতিনের জন্য সবচেয়ে বড় চমক ছিল অবশ্যই পশ্চিমা বিশ্ব। পশ্চিমা বিশ্ব পতনের দিকে যাচ্ছে, পশ্চিমের স্বর্ণযুগ শেষ, বর্তমানে কীভাবে বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা দাঁড়াচ্ছে, চীনের উত্থান হচ্ছে- পশ্চিমা বিশ্ব সম্পর্কে যত ছাইপাঁশ ধারণা প্রচলিত ছিল সব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ইউক্রেনীয়দের সাহসিকতা, ইউক্রেন সরকার আর তাদের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির কৌশলী পদক্ষেপ পশ্চিমা বিশ্বকে মনে করিয়ে দিয়েছে তাদের অবস্থান। আর এটাই পুতিনকে চমকে দিয়েছে! এটাই ছিল তার ভুল ধারণা।
আপনি ‘পশ্চিমা বিশ্ব’ বলতে কী বুঝে থাকেন?
কটকিন: পশ্চিমা বিশ্ব হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর মূল্যবোধের একটা ধারা। পশ্চিমা বিশ্ব কোনো ভৌগলিক স্থান নয়। রাশিয়া ইউরোপীয়, কিন্তু পশ্চিমা নয়। আবার জাপান ইউরোপীয় নয়, কিন্তু তারা পশ্চিমা। পশ্চিমা ধারণার মানে হচ্ছে আইনের শাসন, গণতন্ত্র, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, মুক্ত বাজার, ব্যক্তির প্রতি সম্মানবোধ, বৈচিত্র্য, মতামতের ভিন্নতা থাকা, এবং আরো বিভিন্ন ব্যক্তি স্বাধীনতা, যা আমরা ভোগ করে থাকি। আমরা অনেক সময় ভুলে যাই এগুল কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু এটাই পশ্চিমা বিশ্ব। এই পশ্চিমা বিশ্বই নব্বই দশকে ন্যাটো আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে বর্তমানে এটা পুনর্জীবিত হচ্ছে। এটা পুতিনকে এমনভাবে থমকে দিয়েছে, যা তিনি কিংবা শি জিনপিং কেউই ধারণা করেননি।
আপনি যদি ভেবে থাকেন আফগানিস্তান থেকে পালানোর কারণেই পশ্চিমা বিশ্বের দিন শেষ হয়ে যাচ্ছিল; যদি ভেবে থাকেন ইউক্রেনীয়রা আলাদা কোনো জাতি নয়; যদি ভেবে থাকেন জেলেনস্কি কেবলই একজন টিভি অভিনেতা, কমেডিয়ান, রুশভাষী পূর্ব ইউক্রেনীয় ইহুদি- আপনার অনুমান যদি এরকম হয়, তাহলে আপনি হয়তো ধারণা করেছিলেন দুই থেকে চার দিনেই কিয়েভের পতন হবে। কিন্তু সব অনুমানই ভুল ছিল। (এরপর দেখুন ২য় পর্বে)