সুইজারল্যান্ডের মোট চারটি দাপ্তরিক ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে এমন একটি রহস্যময় ভাষা রয়েছে, যা দেশটির মাত্র ০.৫ শতাংশ মানুষ ব্যবহার করে। ভাষাটির নাম ‘রোমানস’। ১৯৩৮ সালে রোমানস সুইজারল্যান্ডের অন্যতম জাতীয় ও দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সারা বিশ্বে মাত্র ৬০,০০০ মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। জনসংখ্যার বিচারে কম হলেও রোমানস সুইজারল্যান্ডের স্বদেশী ভাষা। সুইজারল্যান্ডের সর্ববৃহৎ প্রদেশের নাম ‘গ্রাবুনডেন’। দেশটির দক্ষিণ-পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত এই প্রদেশের অধিবাসীরা প্রাচীনকাল থেকেই রোমানস ভাষায় কথা বলে আসছে। কিন্তু গত এক শতকে ভাষাটি ব্যবহারকারীদের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছে।
পর্যটকগণ এখনো গ্রাবুনডেনে গেলে রাস্তার রাস্তায় রোমানস ভাষায় লিখিত সড়ক নির্দেশক দেখতে পান। তারা যখন কোনো হোটেলে খাবার খেতে প্রবেশ করেন, তখন তাদেরকে ‘অ্যালেগ্রা’ বলে অভিবাদন জানানো হয়। অ্যালেগ্রা শব্দের অর্থ ‘আমাদের এখানে আপনাদের স্বাগতম’।
কিন্তু ভালো চাকরির আশায় এখানকার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। তাদের গন্তব্যস্থল হিসেবে জুরিখ শহর খুব পরিচিত। সমস্যা হচ্ছে, এরা যখন অন্য এলাকায় চলে যায়, তখন আর রোমানস ভাষা ব্যবহার করে না। আপনি গ্রাবুনডেন প্রদেশের বাইরে অন্য কোনো এলাকায় এই ভাষা শুনতে পাবেন না।
এমনিতেই সুইজারল্যান্ড ছোট্ট একটি দেশ। তার মধ্যে আবার খুব কম সংখ্যক লোক এই ভাষায় কথা বলে। তাহলে কি এই ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে?
গ্রাবুনডেন প্রদেশের অধিবাসীরা বিশ্বাস করে, প্রায় ১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সৈন্যরা রেইথিয়া দখল করে নেয়। সেই রেইথিয়া অঞ্চলই বর্তমান গ্রাবুনডেন প্রদেশ। রোমানরা দখল করে নেয়ার সাথে সাথে অত্র অঞ্চলের আদিবাসীদের ভাষার সাথে রোমান সৈন্যদের ভাষার সংমিশ্রণ ঘটতে থাকে। তখন রোমানদের ভাষা ছিল ‘ভালগার ল্যাটিন’ (প্রাচীন রোমের সাধারণ মানুষ যে ল্যাটিন উপভাষায় কথা বলতেন) এবং স্থানীয় আদিবাসীদের ভাষা ছিল রেইথিয়া (জায়গা ও ভাষার নাম একই ছিল)। এই দুই ভাষার সংমিশ্রণে উৎপত্তি ঘটে রোমানস ভাষার। সেই থেকে দীর্ঘকাল অত্র অঞ্চলের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতো রোমানস ভাষা। ১৫ শতক পর্যন্ত রোমানস ভাষার একক আধিপত্য বজায় ছিল।
কিন্তু ১৫ শতকে এসে যখন সুইসরা কনফেডারেশন গঠন করে, তখন থেকে রোমানস ভাষার আধিপত্য হ্রাস পেতে শুরু করে। উল্লেখ্য, পঞ্চদশ শতকের দিকে সুইসরা কনফেডারেশন পদ্ধতিতে সাম্রাজ্য গঠন করে। কনফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি স্বাধীন অঞ্চলকে বলা হতো ‘ক্যান্টন’। প্রত্যেক ক্যান্টনের নিজস্ব সীমানা, সৈন্য, জনসংখ্যা; সর্বোপরি সার্বভৌমত্ব বজায় ছিল। এসময় রেইথিয়াও একটি ক্যান্টনের মর্যাদা লাভ করে।
এই কনফেডারেশন তাদের সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য জার্মান ভাষাকে তাদের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। কেননা তখন রেইথিয়া আদিবাসীরা প্রায় ১৫০টি বিচ্ছিন্ন পর্বত উপত্যকায় বসবাস করতো। তাছাড়া তাদের মধ্য রোমানস ভাষার কমপক্ষে ৫টি উপভাষা চালু ছিল। প্রত্যেক উপভাষার আবার আলাদা আলাদা লিখিত রূপ ছিল। ফলে কনফেডারেশনের পক্ষে রোমানস ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা জটিল হয়ে পড়েছিল। এর ফলে জার্মান ও ফ্রেঞ্চ ভাষার কাছে রোমানস ভাষা আধিপত্য হারায়। পাশাপাশি এ সময় প্রচুর জার্মান ভাষাভাষী গ্রাবুনডেনে আসতে শুরু করে। অন্যদিকে ১৯ শতকে এসে স্থানীয়রা ব্যাপক হারে জার্মান ভাষা শিখতে শুরু করে। সব মিলিয়ে বর্তমানে গ্রাবুনডেনে জার্মান ভাষা অন্যতম প্রভাবশালী ভাষায় পরিণত হয়েছে।
উপরের আলাপ-আলোচনা দেখে আপনার মনে হতে পারে, তাহলে বুঝি রোমানস ভাষার বিলুপ্তি অত্যাসন্ন! কিন্তু ব্যাপারটি ঠিক তেমন নয়, কেননা সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীরা এখন এই ভাষাকে নিয়ে গর্ব করে। এই ভাষাকে তাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যের অংশ মনে করে। এমনকি ১৯৩৮ সালে এই ভাষাকে কেন্দ্র করে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেই ভোটে ৯০ শতাংশের বেশি সুইস নাগরিক রোমানস ভাষার পক্ষে ভোট দেয়। এ কারণেই রোমানস ভাষা তখন আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় ভাষার মর্যাদা লাভ করে। বর্তমানে সুইজারল্যান্ড সরকার প্রতিবছর ৭.৬ মিলিয়ন সুইস ফ্রাংক এই ভাষার প্রসার ও সংরক্ষণের জন্য ব্যয় করে থাকে।
একটি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে রোমানস ভাষার পাঁচটি উপভাষা থাকা, এর অর্থনৈতিক বিবেচনা ও কার্যকারিতার দিক থেকে বেশ অসুবিধাজনক। এজন্য ১৯৮২ সালে উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে এর একটি কৃত্রিম ও সমন্বিত ভার্সন তৈরি করা হয়। এই ভার্সনটি তৈরি করেন ইউনিভার্সিটি অফ জুরিখের বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী হেনরিখ শ্মিড। রোমানস ভাষার এই কৃত্রিম ভার্সনটির নাম দেয়া হয়েছে রুম্যানটস গ্রিসান। পাশাপাশি লিয়া রুম্যানটস নামক একটি অলাভজনক সংস্থা এই ভার্সনটির প্রচার প্রসার ও সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছে। ১৯৯৬ সাল থেকে এই রুম্যানটস গ্রিসানই সুইজারল্যান্ডের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু এই কৃত্রিম ভার্সন ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্থানীয়রা অনীহা প্রকাশ করে আসছে, কেননা এতে তাদের ব্যবহৃত নিজস্ব উপভাষা ত্যাগ করতে হচ্ছে। ফলে এ নিয়ে কিছুটা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।
লিয়া রুম্যানটসের লিংগুয়া বিভাগের প্রধান ডেনিয়েল টেলি বলেন,
আলাদা আলাদা উপভাষাগুলোকে একত্রীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিরোধিতা আসছে স্থানীয় ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে। তারা তাদের নিজস্ব উপভাষা ত্যাগ করতে চাইছেন না। তারা এই সমন্বিত পদ্ধতিকে স্রেফ ‘কৃত্রিম ভাষা’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। তারা দীর্ঘদিন যাবত যে উপভাষা ব্যবহার করে আসছেন, তা তাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে।
বিপন্ন ভাষা নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘লিভিং টোনস’ এর পরিচালক ডক্টর গ্রেগরি অ্যান্ডারসন বলেন,
ভাষা মানুষের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে এবং তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিয়ে যায়। ফলে সমগ্র দুনিয়ার উপভাষাসমূহ সংরক্ষণ আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যখন প্রতি দুই সপ্তাহে পৃথিবী থেকে একটি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা সবাই যৌথভাবে একেকটি অতীত প্রজন্ম সম্পর্কে জ্ঞান হারাচ্ছি। ভাষা একটি নীরব অথচ গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাহন। ভাষা হারিয়ে ফেললে আপনি সংস্কৃতির বহু গুরুত্বপূর্ণ দিক হারিয়ে ফেলবেন।
ডেনিয়েল টেলি বলেন,
রোমানস ভাষা যদি বেঁচে না থাকতো, তাহলে ‘চ্যালেনদামারজ’এর মতো প্রাচীন উৎসব বেঁচে থাকতো না। যা এখনো প্রতিবছর মার্চ মাসের ১ তারিখ ‘ইংগাডাইন’ উপত্যকায় অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। অথবা ‘কাপুনস’এর মতো স্থানীয় খাবারের রেসিপিও বেঁচে থাকতো না, যা সবুজ পাতায় মুড়িয়ে তৈরি করা হয়; আমরা এসব কিছুই ভুলে যেতাম।
রোমানস ভাষা তার নিজস্ব গতিতে বহুভাষার দেশ সুইজারল্যান্ডকে অনেক কিছু দিয়ে যাচ্ছে এবং দেশকে ইতিমধ্যেই একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। একটি ভাষার মৃত্যু হয়ে গেলে তখন বোঝা যায় যে, সেটি বিশ্বের বুক থেকে কত অনুপম নিদর্শন সাথে নিয়ে হারিয়ে গেছে।
এত কিছুর পরও, গ্রাবুনডেনের অধিবাসীদের মধ্যে রোমানস ভাষা ব্যবহারের পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমে আসছে। কারণ, মূল ধারার ভাষা হিসেবে রোমানস ভাষার মূল্যায়ন এখনো অনেক কম। গ্রাবুনডেনের অনেক স্কুলের প্রধান ভাষা জার্মান, হাতেগোনা কয়েকটি গ্রামের অধিবাসীরা তাদের সন্তানদের সুনির্দিষ্টভাবে তাদের উপভাষা ও সমন্বিত রোমানস ভাষা শিখিয়ে থাকেন। যদিও প্রায় সকল স্কুলে রোমানস ভাষার উপর একটি পাঠ রয়েছে, তবে তা শেখা বাধ্যতামূলক নয়।
বাস্তব পরিস্থিতি বোঝার জন্য মাজা গার্টম্যান নামের একজন স্থানীয় জনসংযোগ কর্মকর্তার কথা বলা যায়, যিনি বর্তমানে ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান ও ইংরেজি ভাষা শিখছেন, কেননা এসব ভাষা জানলে বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিবেচনায় তিনি অধিক ভালো কাজের সুযোগ পাবেন।
তবে বর্তমানে একটি আশার দিগন্ত উন্মোচিত হতে শুরু করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, রোমানস ভাষা শেখার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে আগ্রহ কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এই ভাষাকে পুনরুজ্জীবন দান করতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বায়ন পেছন থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। মাজা গার্টম্যান এ বিষয়ে বলেন,
মাত্র কয়েক বছর আগেও রোমানস ভাষাকে কেউ সুইজারল্যান্ডের ঐতিহ্য হিসেবে শিখতে চাইতো না। কিন্তু এখন সবাই সবকিছুর মধ্যে এই ভাষা ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। তারা এখন তাদের মূলে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে; নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে; তারা রোমানস ভাষায় কথা বলা গর্বের মনে করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এটি আলাদা ও দুর্লভ ভাষা, যার ব্যবহার তাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখে। কেননা, যা কিছু দুর্লভ ও এক্সক্লুসিভ, তার প্রতি মানুষের আগ্রহ আজকাল বেশি।
বর্তমানে রোমানস ভাষায় একটি টেলিভিশন, একটি রেডিও স্টেশন ও একটি পত্রিকা রয়েছে। এর সবগুলোই স্থানীয় উপভাষা ও রুম্যানটস গ্রিসান ভাষার সংমিশ্রণে পরিচালিত হয়। পাশাপাশি বইয়ের দোকানগুলো প্রচুর পরিমাণে রোমানস ভাষার বই সংগ্রহে রাখে। সেখানে কিছু হিপ-হপ গ্রুপও আছে, যারা রোমানস ভাষায় র্যাপ গান করে থাকে। লিরিকাস অ্যানালস নামের একটি গানের দলের সদস্য জোহানেস জাস্ট বলেন,
আমাদের ব্র্যান্ডের প্রত্যেকেই গ্রাবুনডেন ক্যান্টনে বেড়ে উঠেছে। আমাদের র্যাপ গানের অন্যতম ভাষা রোমানস। কেউ যদি তার মাতৃভাষায় র্যাপ গাইতে না চায় তবে তাকে তিরস্কৃত করা হয়। তারা এই ভাষার ব্যবহার করে স্বাধীনভাবে সুর ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে। আমরা জানি, আমাদের গানের মাধ্যমে এই ভাষার তেমন কোনো প্রচার প্রসার হবে না। তবুও এটা আমরা আমাদের কাজের অংশ হিসেবে করে যাচ্ছি। আর যদি কোনো প্রভাব সৃষ্টি করে, তবে তো আমাদের সবার জন্যই আনন্দের।
রোমানস ভাষার বিস্তারে প্রযুক্তিকেও কাজে লাগানো হচ্ছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ব্লগে এই ভাষাকে জীবন্ত করে তোলা হচ্ছে। ‘মেমরাইস’ এর মতো অনলাইন অ্যাপ রোমানস ভাষা শিখাতে সহায়তা করছে। অ্যান্ড্রয়েডে ‘রোমানস ইংলিশ ট্রান্সলেটর’ এর মতো অনলাইন অনুবাদক ব্যবহার করা যাচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইতিমধ্যেই রোমানস ভাষায় তাদের সাথে যুক্ত থাকার সুযোগ প্রদান করেছে, বিশেষত ছোটদের মাঝে এসব সুবিধা বেশি প্রভাব বিস্তার করছে। প্রযুক্তি জায়ান্ট গুগলের ‘বিপন্ন ভাষা সংরক্ষণ প্রকল্প’ ইতিমধ্যেই বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ ভাষাসমূহের তালিকায় রোমানস ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে।
পরিশেষে ১৯ শতকের বিশিষ্ট সুইস কবি গাইচেন ক্যাসফার মউথের ‘আল পাইভেল রোমোনটস’ বা ‘রোমানস জনগণের প্রতি’ কবিতার একটি লাইন দিয়ে আজকের লেখা সমাপ্ত করা যায়-
‘দাঁড়াও! জেগে ওঠো! হে রোমানস, তুমি তোমার প্রাচীন ভাষাকে রক্ষা করো।