পূর্বের পটভূমি
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক বরাবরই অনমনীয় ও উত্তেজনাপূর্ণ। পাশাপাশি ইরান-সৌদি আরবও বিপরীত পক্ষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে নিজ দেশের জন্য হুমকি মনে করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি জোট বনাম ইরানের দ্বন্দ্ব অনেকদিন যাবতই এশীয়-মার্কিন ভূরাজনীতির পরিচিত দৃশ্য।
তবে দেশগুলোর মধ্যে সম্প্রতি চলমান উত্তেজনার সূত্রপাতও সাম্প্রতিকই। গত বছর ‘ইরান পারমাণবিক চুক্তি’ থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসন কর্তৃক সাক্ষরিত এ চুক্তি নিয়ে ট্রাম্প অবশ্য শুরু থেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিলেন। সেই অসন্তোষ থেকেই এলো সরে আসার ঘোষণা। ইরানের জন্য কড়া একটি বার্তাও রেখে গেলেন ট্রাম্প- “যুক্তরাষ্ট্র কেবলই ফাঁকা হুমকি ছাড়বে না!”
চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের পাশাপাশি ইরানের ওপর পূর্বের নিষেধাজ্ঞাগুলোও পুনরায় বহালের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। সেই মোতাবেক ইরানের ওপর সম্প্রতি বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা জারিও করে যুক্তরাষ্ট্র। ওদিকে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে তোয়াক্কা না করে নিজেরা পারমাণবিক চুক্তি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দও ট্রাম্পকে তার সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য আহ্বান জানায়।
চুক্তি প্রত্যাহারের পর ইরানের তেল বিক্রির ওপর বৈশ্বিক অবরোধ আরোপের ডাক দেন ট্রাম্প। তার দাবি ছিল, নভেম্বরের ৪ তারিখের মধ্যে ইরান থেকে সব দেশ যাতে তেল কেনা বন্ধ করে দেয়।
ওদিকে ইরানও শক্তভাবেই পাল্টা জবাব দেয়। হরমুজ জলপ্রণালী (Strait of Hormuz) -তে তেল আনা-নেওয়ায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টির প্রচ্ছন্ন হুমকি দেন ইরানের রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি। তিনি আরো বলেন, “আমেরিকানরা দাবি করছে, তারা ইরানের তেল রপ্তানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে চায়। তারা এই দাবির অর্থ বুঝতে পারছে না, কারণ এই অঞ্চলের তেল রপ্তানি চালু থাকবে, আর ইরানেরটা বন্ধ থাকবে, এর কোনো মানে হয় না।” রুহানি প্রশাসনের সাফ কথা, হয় সবাই এই প্রণালীটি ব্যবহার করতে পারবে, আর নয়তো কেউ পারবে না!
হরমুজ জলপ্রণালীটি হচ্ছে পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরের মধ্যকার একটি প্রণালী। পৃথিবীর ৪০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল হরমুজ জলপ্রণালীর ওপর দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যায়। এটি পারস্য উপসাগর থেকে মুক্ত সাগরে যাওয়ার একমাত্র সাগরপথ। ফলে কৌশলগত কারণেও এই সংকীর্ণ পথটির রাজনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক।
শুধু ইরানই নয়, ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোও তাদের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির জন্য এই জলপ্রণালীটির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ফলে এই পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা এলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যেরই তেল রপ্তানি তথা বৈশ্বিক পরিবহন স্থবির হয়ে যাবে।
ওদিকে তেল পরিবহন কমলে বেড়ে যাবে দাম। এতে করে ঝামেলায় পড়বে চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশিয়ার বড় বড় তেল আমদানিকারক দেশ। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক সংকট জটিল হয়ে ক্রমেই বৈশ্বিক রূপ ধারণ করবে।
মূল ঘটনার সূত্রপাত
মে মাসের ১২ তারিখ ওমান উপসাগরের ফুজাইরাহ উপকূলে ৪টি বাণিজ্যিক জাহাজ হামলার শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেগুলোর মধ্যে সৌদি আরবের ২টি, নরওয়ের ১টি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ১টি তেলের ট্যাংকার রয়েছে।
হুতি বিদ্রোহী ও ইয়েমেন ইস্যু নিয়ে ইরানের সাথে আগে থেকেই সৌদি আরবের মতবিরোধ চলছিল। এই ঘটনার পর সৌদি আরব দাবি করছে যে, এটি ইরানের মদদে চালানো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডেরই একটি নমুনা। আর এটি নিয়েই দুই দেশের বিরোধ চরমে। ঘটনাটির আগে যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, ইরানের বিরুদ্ধে তাদের কিছু তথ্য আছে। সে তথ্য অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র ধারণা করছিল, মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত মার্কিন বাহিনীর উপর আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছে ইরান।
ইরানের এরূপ অনির্দিষ্ট হুমকির বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে যুক্তরাষ্ট্র সে অঞ্চলে শক্তিবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। সেজন্য মে মাসের ১০ তারিখ পারস্য উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ইউএসএস আব্রাহাম লিংকন বিমান বাহক স্ট্রাইক গ্রুপ, বি-৫২ বোম্বার, এবং একটি আন্টিমিসাইল ব্যাটারি পাঠায়।
১২ তারিখের হামলার ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব উভয়েই ইরানকে দোষ দিচ্ছে। তবে ইরান এই হামলার নিন্দা জানিয়ে কোনো সম্পৃক্ততার অভিযোগ নাকচ করেছে এবং একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে।
চারটি জাহাজের ধ্বংসাবশেষের রাসায়নিক বিশ্লেষণ ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে পাওয়া গেছে বিশেষ একটি তথ্য। জাহাজগুলোতে আটকানো শামুক আকৃতির বিস্ফোরক (Limpet mine)-এর কারণেই ঘটেছে বিস্ফোরণ।
এই হামলা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও নরওয়ের দাবি এমনটিই। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, আক্রমণটির সাথে জড়িত আছে ‘স্টেট অ্যাক্টর’। হামলার বিষয়ে ইরানকে সন্দেহ করা হলেও, এই তদন্তে দোষী হিসেবে দায়ী করে ইরানের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
বর্তমান অবস্থা
এই হামলার ঠিক এক মাস পর আবারও ওমান উপসাগরে একই ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটে। জুনের ১৩ তারিখ হরমুজ জলপ্রণালীর কাছে জাপান ও নরওয়ের দুটি তেলের ট্যাংকার হামলার শিকার হয়। জাহাজে থাকা নাবিকদের আমেরিকান ও ইরানের সামরিক বাহিনী উদ্ধার করে। জাহাজ দুটিতে যে ক্ষতিসাধন হয়েছে তা যাচাই করে দেখা গেছে যে, এই ক্ষেত্রেও মে মাসের হামলায় ব্যবহৃত অনুরূপ বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়েছে।
যথারীতি যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনার জন্য আবারও ইরানকেই দায়ী করেছে। এমনকি জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেলও সুর তুলেছেন, ইরানের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে নাকি শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে ইরান আবারও সব অভিযোগ নাকচ করেছে এবং ভুল তথ্য দিয়ে অশান্তি তৈরি না করার জন্য কঠোর আহ্ববান জানিয়েছে।
এরপর তৈরি হলো আরেকটি নতুন ইস্যু। আক্রমণের এক সপ্তাহের মাথায় জুনের ২০ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুপ্তচর ড্রোন ভূপাতিত করে ইরান। কিন্তু কোন জায়গায় ড্রোনটিকে ভূপাতিত করা হয়েছে, তা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইরান ড্রোনটিকে ভূপাতিত করেছে। অন্যদিকে ইরানের দাবি, ড্রোনটি ইরানের আকাশসীমানায় প্রবেশ করেছিল এবং সেখানেই সেটিকে ভূপাতিত করা হয়েছে।
এই ঘটনার পরপরই ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের উপর সামরিক হামলা চালানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে পিছু হটেন। হামলার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর কেন বা কী কারণে হঠাৎ করে সিদ্ধান্তের পরিবর্তন, তা-ও সেই সময় পরিষ্কার জানা যায়নি।
মার্কিন-মিত্রবলয়ের সাথে ইরানের বিরোধ নতুন রূপ পায় জুলাই এর ৪ তারিখ, যেদিন জিব্রাল্টারে ব্রিটিশ মেরিন ও বন্দর কর্তৃপক্ষ ইরানের একটি সুপারট্যাংকার জব্দ করে। তাদের অভিযোগ, এই সুপারট্যাংকারটি অপরিশোধিত তেল নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশে যাচ্ছিল, যেটি কিনা সিরিয়ার ওপর আরোপিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন।
এসবের কিছুদিন পর, জুলাই মাসের ১১ তারিখ ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় যে, ইরান হরমুজ জলপ্রণালীতে একটি ব্রিটিশ ট্যাংকারের পথ অবরোধ করেছে। ইরান অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ওদিকে কিছুদিন আগে হরমুজ প্রণালীতে একটি তেলের ট্যাংকারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের তীর আবারও ইরানের দিকেই। কিন্তু ইরান বলছে, একটি জাহাজ থেকে পাওয়া জরুরি সাহায্যের আবেদনের মাধ্যমেই তারা জাহাজটির সন্ধান পায়। তাদের দাবি অনুযায়ী, তারা তেল পাচারকারী একটি ট্যাংকার জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও এটি নিখোঁজ হয়ে যাওয়া জাহাজটিই কিনা, সেই বিষয়ে কিছু নিশ্চিত করেনি ইরান কর্তৃপক্ষ।
অনেকে ধারণা করছে যে, জিব্রালটারে জব্দ হওয়া ট্যাংকারের জবাব হিসেবে ইরান এই জাহাজটি হরমুজ জলপ্রণালীতে জব্দ করেছে। এদিকে জুলাই এর ১৯ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে যে, তাদের একটি যুদ্ধজাহাজ ইরানের একটি ড্রোনকে সেই হরমুজেই ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে। অথচ ইরানের দাবি, তাদের ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার কোনো ঘটনাই ঘটেনি, বরং যুক্তরাষ্ট্র নিজেরাই নিজেদের ড্রোন ভূপাতিত করে ইরানের নামে প্রচার করছে!
সবকিছু মিলিয়ে সেই অঞ্চলটিতে বর্তমানে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। ওমান উপসাগরের আশেপাশের দেশগুলো বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা করছে। ট্রাম্প ইরানের উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু না হটলে পরিস্থিতির আরো তীব্র অবনতি ঘটতো বলেও অনেকে মনে করছেন। ওদিকে পুনরায় নানা রকম নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরান হুঁশিয়ার করছে, তাদের ওপর আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে না নিলে তারা পারমানবিক চুক্তির বিপরীতে গিয়ে পারমাণবিক শক্তি সঞ্চয়ে পিছপা হবে না।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়া বাকি দেশগুলো ইরানের সাথে কোনোরকম সংঘাতে যেতে চায় না। এই সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছে। এমনকি ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসার পেছনেও রয়েছে তাদের প্রভাব। তবে তেল বিষয়ক বাণিজ্যের কথা চিন্তা করলে ইরানের সাথে কোনোরকম দ্বন্দ-সংঘাত সামগ্রিক বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গত কয়েক মাসের ঘটনায় তার কিছুটা নজির সবাই দেখেছে। তবুও এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য বিভিন্ন পক্ষ নানা উপায়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর সমাধান কূটনীতিক ভাবেই সম্ভব বলে মনে করেন অনেকে। এখন দেখার বিষয় সামনে কী হতে চলেছে।