প্রফেসর ইউভাল নোয়াহ হারারি বর্তমান বিশ্বের একজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ, ঐতিহাসিক এবং বুদ্ধিজীবী।আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক বিক্রিত বই ‘স্যাপিয়েন্স: অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অফ হিউম্যানকাইন্ড’,‘হোমো ডেয়াস: অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টুমরো’, ‘টোয়েন্টি ওয়ান লেসন্স অফ দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি‘র মতো বইয়ের রচয়িতা তিনি।প্রফেসর হারারি বিভিন্ন সময়ে নব্য স্বৈরাচারের উদ্ভব,তথ্য কেন্দ্রীভবনের হুমকি,মানবসভ্যতা ও রাজনীতির সম্ভাব্য দিকদর্শন বিষয়ে বিভিন্ন ফোরামে বক্তব্য রেখে আসছেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে ২০১৮ সালে করা তার টেড টকটি রোর বাংলার পাঠকদের জন্য বাংলায় তুলে ধরা হলো।
একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক। আপনি কি ফ্যাসিস্ট? ভাবুন তো একটু। আমি জানি, এর উত্তর দেওয়া আসলেই কঠিন। আমরা অনেকটা ভুলেই গেছি ফ্যাসিবাদ আসলে কী। ইদানিং মানুষ ‘ফ্যাসিবাদ’, ‘ফ্যাসিস্ট’ এই শব্দগুলো ব্যবহার করে গড়পড়তাভাবে; মূলত নিন্দার্থে, এমনকি অনেক ছোটক্ষেত্রেও। অথবা তারা গুলিয়ে ফেলে- কোনটা ফ্যাসিবাদ আর কোনটা জাতীয়তাবাদ। ফ্যাসিবাদ আসলে কী, জাতীয়তাবাদের সাথে এর তফাতটা কোথায় সেই বিষয়ে আমার চিন্তাটা আপনাদের বলছি।
জাতীয়তাবাদ বলতে আমরা মোটামুটি সকলেই আবছা-আবছাভাবে যা বুঝি, তা কোনো নতুন চিন্তাদর্শ নয়। এর ক্ষুদ্রতর সংস্করণ মানবসমাজের ক্রমবিবর্তনের প্রতিটা ধাপেই আমরা দেখেছি। মানুষ গল্পবলিয়ে জীব; সে গল্প বলতে ভালোবাসে, আরো ভালোবাসে গল্প শুনতে। একটা সুন্দর গল্প, শক্তিশালী মিথ হাজার হাজার মানুষকে এনে দাঁড়া করাতে পারে এক ভিত্তিতে। সমাজ, দেশ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলতে আমরা যা বুঝি, তার কোনোটাই তো ঐ অর্থে বস্তুগত নয়- এদের সৃজন, উন্মেষ, ধ্বংস সবই আমাদের চিন্তায় আর মননে।
একটা ভালো গল্প সামাজিক বন্ধন তৈরি করে দেয়, সেই গল্পে যখন বিশ্বাস স্থাপন করে লাখো মানুষ, তখন ঐ লাখো মানুষের মনে একত্রে জন্ম নেয় এক কাল্পনিক বাস্তবতা, যার মূর্ত রূপ আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো- মানে গোত্র, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সেই অর্থে কোটি মানুষের এক মহা মিলনক্ষেত্র, যারা পরস্পর পরস্পরের কাছে আগন্তুক- কিন্তু তাদের বিশ্বাস অভিন্ন মিথে।
আমার দেশ ইসরায়েলের জনসংখ্যা মোটামুটি আশি লক্ষ, যারা সকলে আমার মতো ইসরায়েলি নাগরিকত্ব সনদ ধারণ করেন। আমি কিন্তু তাদের সবাইকে চিনি না, জানি না; তবুও জাতীয়তাবোধের সুবাদে আমরা নিজেদের এক চিন্তা করি, একসাথে কাজ করি, পরস্পর সহাবস্থান করি। এটা নিঃসন্দেহে একটা সুন্দর দিক। জন লেননের মতো কিছু মানুষ অবশ্য মনে করেন ‘জাতীয়তাবাদ’ প্রত্যয়টা না থাকলেই পৃথিবীটা শান্তিস্বর্গ হতো। কেন তারা এরকম বলেন, সেই কথায় আমরা পরে আসবো। কিন্তু এটা তো সত্য, এই জাতীয়তাবোধটুকু না থাকলে মানুষ এখনো আদিম জীবনেই থাকতো, বাস করতো গোষ্ঠীগত বিশৃঙ্খলার মধ্যে!
আজকের দিনে পৃথিবীর সমৃদ্ধিশালী, শান্তিপূর্ণ দেশগুলো, যেমন- সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, জাপান- এদের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো তাদের জাতীয়তাবোধ অত্যন্ত দৃঢ়। আবার যাদের তা নেই, যেমন- সোমালিয়া, কঙ্গো বা আফগানিস্তান- এরা অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এবং নৈরাজ্যপূর্ণ। তাহলে ফ্যাসিবাদ আসলে কী? কীভাবে এটা জাতীয়তাবাদ থেকে স্বতন্ত্র হলো?
জাতীয়তাবাদ আমাকে বলে আমার দেশটা অনন্য এবং এর প্রতি আমার কিছু বিশেষ কর্তব্য আছে। ফ্যাসিবাদ আমাকে বলে আমার দেশ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং এর প্রতি আমার কর্তব্য প্রশ্নহীন, নির্বিকল্প। আমার দেশ, আমার জাতির বাইরে আর কোনোকিছুকে গ্রাহ্য করার প্রয়োজন নেই। ভেবে দেখুন, একজন মানুষের তো কেবল একটি সত্তা নয়- তার সত্তা অনেকগুলো, বিভিন্ন সম্পর্ক, বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতি তার আনুগত্যের নিরিখে যা নির্ধারিত হয়। সেই বিচারে তার কর্তব্যও বহুমুখী। যেমন- আমি আমার রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত। আমি একজন দেশপ্রেমিক। আবার একই সময়ে আমি আমার পরিবারের প্রতি, পাড়া-প্রতিবেশীর প্রতি, আমার পেশা- এমনকি দার্শনিক বিচারে সত্য, শুভ, সুন্দর ও বিশ্বমানবতার প্রতিও আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে।
মানবসত্তার এই বহুত্ব, দায়িত্বের বৈচিত্র্য জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জন্ম দেয় মানসিক দ্বন্দ্ব ও জটিলতার। একবার চিন্তা করুন, এই দ্বন্দ্ব আর জটিলতাই কি প্রাকৃতিক নয়? দ্বান্দ্বিকতাই কি জীবনের বড় সত্য নয়? সমাজজীবনের শুরু থেকেই এই দ্বন্দ্ব অস্তিত্বশীল এবং প্রতিটি মানুষ নিজের মতো করেই এই দ্বন্দ্বের সমাধা করে এসেছে।
ফ্যাসিবাদের উদ্ভব তখনই ঘটে, যখন মানুষ এই জটিলতাকে পুরোদস্তুর উপেক্ষা করতে চায়। ফ্যাসিবাদে কেবল আমার জাতিসত্তাকেই পরম এবং চরম জ্ঞান করে, বাকি সব পরিচয়কে অনায়াসে নাকচ করে দেয়। দেশের কাজ করাই আমার এক ও অদ্বিতীয় কর্তব্য। দেশের প্রয়োজনে যদি আমাকে আমার পরিবার ত্যাগ করতে হয়, তাহলে আমাকে আমার পরিবার ত্যাগ করতে হবে। দেশ যদি চায় আমাকে হাজারো মানুষকে হত্যা করতে হবে, তাহলে আমাকে তা-ই করতে হবে। দেশ যদি আমাকে এমন কিছু করতে বলে, যা স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনায় মানবতা পরিপন্থী, তাহলে আমাকে সত্য ও সুন্দরের সাথে প্রবঞ্চনা করে তা-ই করতে হবে।
একজন ফ্যাসিস্ট এভাবেই তার চতুর্পার্শ্বকে মূল্যায়ন করে। একটা শিল্প, বই কিংবা চলচ্চিত্র তার কাছে তখনই ভালো- যখন তা দেশের স্বার্থসাধন করে। তখন সেটা ভালো, সেটা গ্রহণীয়- অন্যথায় কঠোরভাবে বর্জনীয়। এভাবে ফ্যাসিস্টের মনোবৃত্তি থেকে সত্য, ন্যায়, মূল্যবোধ এই মাপকাঠিগুলো মুছে যেতে থাকে। সেই স্থান নেয় অন্ধ আনুগত্য, একদেশদর্শিতা এবং হীন বিদ্বেষ। দুই বিশ্বযুদ্ধে বিপুল হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাত, খুনোখুনির ইতিহাস আমাদেরকে এই ভ্রমাত্মক মতাদর্শের ভয়াবহ পরিণতির কথা মনে করিয়ে দেয়।
ফ্যাসিবাদের আলোচনায় আমরা একে অতি ভীষণ দানবের সাথে সহজেই তুলনা করতে পারি বটে, কিন্তু যে জায়গায় অধিকাংশই পৌঁছতে পারেন না, সেটা হলো এই দানবের চুম্বকশক্তি। বাস্তবে এই দানবের চেহারা মোটেই উৎকট নয়, উল্টো দারুণ সম্মোহিনী। ধর্মীয় পুরাণগুলোতে আমরা দেখতে পাই শয়তান সবসময় প্রলুব্ধকর চেহারা, আচার ধারণ করে মানুষকে খারাপ কাজের প্ররোচনা দিয়ে এসেছে। সেই একই ব্যাপার ঘটছে ফ্যাসিবাদের ক্ষেত্রেও। ফ্যাসিবাদ মানুষকে এই অনুভূতি দেয় যে, সে যে দেশটিতে বাস করছে, সেটিই তাবৎ জগতের একমাত্র সুন্দর- একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঠিক এখানে এসেই মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। সে জেনে এসেছে যে ফ্যাসিবাদ ভয়ঙ্কর জিনিস, কিন্তু ফ্যাসিবাদের দর্পণে সে যখন তাকায়, সে দেখে সম্পূর্ণ উল্টো ছবি- সর্বোত্তমের ছবি, সর্বোৎকৃষ্টের ছবি। তার মনে হয়, এই ছবি নিশ্চয়ই মন্দ হতে পারে না!
পারে; এটাই ফ্যাসিবাদের সম্মোহনী শক্তি, যা সেই আদিকাল থেকেই একে শক্তিশালী করে তুলেছে, জনসমর্থন জুগিয়েছে। ফ্যাসিবাদের আয়নায় তাকালে আপনি নিজেকে, নিজের দেশকে, নিজের জাতিকে সবচেয়ে সুন্দর, সবার সেরা হিসেবে দেখতে পান। ১৯৩০-এ জার্মানরা যখন হিটলার-গুয়ারিঙের বানানো ফ্যাসিস্ট আয়নায় নিজেদের দেখেছিল, তারা ঠিক এটাই দেখেছিল। শুধু জার্মানিই বা কেন- মুসোলিনির ইতালি, ফ্রাঙ্কোর স্পেন, সালাজারের পর্তুগাল, হোর্থের হাঙ্গেরি কিংবা হালের রাশিয়া, চীন এমনকি ইসরায়েলও যদি সেই ক্রুর আয়নায় তাকায়, তাহলে তা-ই দেখতে পাবে।
ইতালীয় দার্শনিক, নন্দনতাত্বিক উমবার্তো একো যথার্থই বলেছিলেন, ফ্যাসিবাদ নতুন নতুন ছদ্মবেশ নিয়ে ফিরে আসে। বিশ শতকের শেষ থেকে এখনও, যেমন- বিশেষত ডানপন্থী সরকারগুলো ‘উন্নয়ন মডেলে’র ভেতর দিয়ে জনগণকে নিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে থাকছে উগ্র জাতীয়তাবাদ, ইতিহাসের গৌরব এবং সংস্কৃতি ও কথিত প্রগতির বড়াই।একুশ শতকে এসে আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে, এ যুগের বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত বাস্তবতায় কীরূপে ফ্যাসিবাদ- একনায়কতন্ত্র আবার ফিরে আসতে পারে!
গত শতাব্দীতে সম্পদের যে বৈশ্বিক ধারণা ছিল- কৃষি, খনিজ সম্পদ, শিল্প কিংবা বাণিজ্য- একুশ শতকে এসে তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন শতকের আলোয় আমরা আবিষ্কার করেছি, কৃষি-শিল্প কিংবা বাণিজ্য নয়, আজকের দিনে তথ্যই সারাবিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তথ্যকে যারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে জীবন ও মানবজাতির আগামীকে। একটা সময় ছিল, যখন মানুষ জমিজিরাতকেই অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ মনে করতো। রাজনীতির অর্থ তখন ছিল ভূমির সত্ত্ব নিয়ন্ত্রণ ও বণ্টন। অনেক বেশি জমি যখন একজন বা একটি পরিবারের হাতে পুঞ্জীভূত হতে শুরু করল, তখন জন্ম নিল সেযুগের একনায়কেরা- যাদেরকে আমরা বলি সামন্তপ্রভু কিংবা জমিদার।
সময় এগোলো, গত দুই শতকে ধীরে ধীরে জমির স্থান দখল করলো যন্ত্রপাতি। রাজনীতি তার রূপ বদলে হয়ে উঠলো যন্ত্রপাতির নিয়ন্ত্রক। সেই যুগে একনায়কের ধারণা বদলে গেলো- যন্ত্রপাতি, কলকব্জা যখন আটকে রইলো অল্প কয়েকজনের হাতে, তৈরি হলো বুর্জোয়াঁ এবং প্রোলেতারিয়েত শ্রেণীবিভাজন। এখন, এই শতাব্দীতে, তথ্য প্রতিস্থাপন করছে যন্ত্রপাতি এবং জমিজমা- দুটোকেই। রাজনীতি পরিণত হচ্ছে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ক্রিয়াপদ্ধতিতে এবং একুশ শতকের একনায়কতন্ত্র বলতে আমাদের বুঝতে হবে অনেক বেশি তথ্য কোনো সরকার বা কর্পোরেশনের হাতে চলে আসাকে!
বিশ শতকের রাজনীতির বড় সময় জুড়ে আমরা দেখেছি পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দ্বন্দ্ব।পুঁজিবাদ তার রাজনীতিরূপে ব্যবহার করেছে গণতন্ত্রকে এবং সমাজতন্ত্রের প্রতিভূ হয়ে উঠেছিল একনায়কতন্ত্র। সে সময়ের বাস্তবতায় রাজনৈতিক-কূটনীতিতে গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রকে পেছনে ফেলেছিল। গণতন্ত্রের সাফল্য ছিলো এটাই যে, এই ব্যবস্থা তথ্যকে অবাধে ছড়িয়ে দিতে এবং তা নিয়ে কাজ করে কার্যকরী সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছিল। একনায়কতন্ত্র চেয়েছে তথ্যের প্রবাহকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে- সব তথ্য, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে তারা কেন্দ্রীভূত করেছে এক জায়গায়, এক ব্যক্তির হাতে কিংবা এক পরিবারের হাতে।
গণতন্ত্র তা করেনি, গণতন্ত্র বরং তথ্যকে কেন্দ্রীভূত হতে বাধা দিয়েছে- তথ্য ও তথ্য ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, অধিকারকে গণতন্ত্রীরা ছড়িয়ে দিয়েছে নাগরিক গোষ্ঠী এবং বহু প্রতিষ্ঠানের কাছে। বিশ শতকের সমাজ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সব মিলিয়ে যে সামগ্রিক পরিকাঠামো, তাতে তথ্যের এই বণ্টননীতি কেন্দ্রীভবন-নীতির তুলনায় বেশি মানুষকে নিজের দিকে টানতে পেরেছে এবং কাজও করেছে ভালো। এই কারণেই মূলত সেসময়ে ‘উদার গণতন্ত্র’ একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এবং পুঁজিতন্ত্র পেছনে ফেলতে পেরেছিল সমাজতন্ত্রকে। কিন্তু এটা বিবর্তন বা আপেক্ষিকতার মতো কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম নয় যে তথ্যের কেন্দ্রীভবন সবসময়ই অকার্যকর রয়ে যাবে।
‘বিশ শতকের পরিকাঠামো’ কথাটি বিশেষ গুরুত্ববহ, কারণ এই একুশ শতকে এসে আমরা যেসব প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটতে দেখছি একের পর এক- বিশেষত মেশিন লার্নিং এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, এরা সম্মিলিতভাবে উল্টে দিতে পারে পাশার দান; এ যুগে তথ্যের কেন্দ্রীভবন দেখা দিতে পারে তথ্যের গণতন্ত্রায়নের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ব্যবস্থারূপে। মেশিন লার্নিং মানুষকে দিয়েছে বিপুল পরিমাণ তথ্য অবিশ্বাস্য গতিতে, দারুণ সূক্ষ্মভাবে প্রক্রিয়া করার ক্ষমতা, তেমন বিপুল জনগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উত্থানের সম্ভাবনা আশা করি কারোরই অজানা নয়। তা-ই যদি সত্য হয়, তাহলে বিশ শতকে একনায়কতন্ত্রের যে মূল সমস্যা ছিল, এক স্থানে-একটি কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াকরণ, সিদ্ধান্ত-গ্রহণ ক্ষমতার পুঞ্জীভবন হয়ে উঠতে পারে এ যুগে তার সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সাথে এ শতকে জীবপ্রযুক্তিরও অসাধারণ উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, এবং এদের যুগপৎ ক্রিয়ায় এমন অ্যালগরিদম তৈরি হতে পারে, যা কি না আপনাকে আপনার থেকেও ভালো চিনবে, আপনার সবলতা-দুর্বলতা-আবেগ ভালো জানবে- এমনকি তাকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারবে! এরকম প্রযুক্তি কিন্তু নিছক কল্পনা নয়।
যখন কোনো কর্তৃপক্ষ, সে সরকারই হোক-বড় কর্পোরেশন কিংবা টেক জায়ান্টই হোক, এ রকম প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শুরু করবে, নিঃসন্দেহে তা গণতন্ত্রের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াবে! মানুষের কাছেই যখন এরকম অ্যালগরিদম থাকবে, যা কি না আপনাকে আপনার থেকেও ভালো জানে-ভালো চেনে, আপনার পছন্দ-অপছন্দ বুঝে ফেলে, আপনার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া অনুমান করে আপনার হয়ে সিদ্ধান্তও নিতে পারে- এই যখন অনাগত ভবিষ্যত, তখন আমরা যদি এর সামগ্রিক গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে যথেষ্ঠ সচেতন না হই, বিজ্ঞানের এই অসাধারণ বিপ্লবের সুফল হয়তো আমরা ঘরে তুলতে পারবো না; সেই বেহাত বিপ্লবের বীজ থেকে জন্ম নিতে পারে গণতন্ত্রোত্তর একুশ শতকের নব্য একনায়কতন্ত্র।
ঐ অ্যালগরিদম ব্যবহার করেই একনায়ক হয়তো আপনার মনে বিরোধী পক্ষের প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি করবে, আর তার প্রতি আনুগত্য। আপনি তার ছবি দেখে মনে মনেও গালি দিতে পারবেন না, আপনার পকেটে থাকা সেলফোনের সেন্সর হয়তো আপনার ব্রেইন সিগন্যাল থেকে আপনার মনোভাব বুঝে একনায়ককে জানিয়ে দেবে। আগামী দিনে গণতন্ত্র এভাবে পরিণত হতে পারে একটা পুতুল খেলায়! আধুনিক গণতন্ত্র যদি এর যথার্থ মোকাবেলা বা আত্তীকরণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এটা খুবই সম্ভব, গণতন্ত্রকে সরিয়ে বিশ্বের শাসনভার কাঁধে তুলে নেবে কোনো নতুন ‘বিগ ব্রাদার’!
তাহলে আমাদের এখন কী করার? আমাদের ভেবে দেখতে হবে তথ্যের লাগাম আজ কার হাতে। বর্তমানে টেক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সেবার বিনিময়ে আপনার আমার বিপুল তথ্যের অধিকার দখল করে আছে। তথ্যের এই পুঞ্জীভবনকে আমাদের আতশ কাচের নিচে দেখতে হবে, নাহলে গোটা পৃথিবী একসময় কয়েকটি দৈত্যাকৃতির সফটওয়্যার কোম্পানির হাতে নিয়ন্ত্রিত হবে। উদার গণতন্ত্রের অনাগত শত্রুরা চাইবে আমাদের আবেগ, অনুভূতি, প্রবণতাগুলোকে হ্যাক করতে। সিলিকন ভ্যালি পণ্যের বিক্রি বাড়ানোর জন্য ‘মার্কেট মেকানিজম’ হিসেবে এ রকম পদ্ধতি ব্যবহার করতে শুরু করেছিল, অনাগতকালে গণতন্ত্রের শত্রুরা সেই একই পদ্ধতিতে আমাদের বিক্রি করবে বিরোধীপক্ষ, বিরোধীগোষ্ঠী, বিরোধী দেশের প্রতি ভয়, ঘৃণা এবং আত্মম্ভরিতা।
আগামী দিনে হয়তো আমাদের নিজেদের অনুভূতিকেই সন্দেহ করে চলতে হবে, অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে আমাদের দুর্বলতা-আবেগানুভূতি নিয়ে, পাছে তারা আমাদের নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে কি না। এই সন্দেহপ্রবণতা, সচেতনতা আমাদের ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান থেকেও রক্ষা করতে পারে। ফ্যাসিবাদ একইভাবে আমাদের আবেগ নিয়ে খেলা করে, আমাদের দাম্ভিক সত্তাকে উস্কে দেয়- তাকে চালিত করে স্বার্থ হাসিলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। যেমনটা শুরুতেই বলেছি, ফ্যাসিবাদের মায়াজাল আপনাকে মহত্তম, চরমতম বলে মনে করায়। এটাই এর সম্মোহনশক্তি।
আমরা যদি যথেষ্ঠ সচেতন আর মানবিক থাকতে পারি, তাহলেই এই ফাঁদ থেকে বের হওয়া সম্ভব। এর পাশাপাশি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে কাজটা করা দরকার তা হলো ফ্যাসিবাদ ও একনায়কতন্ত্রের এই সম্ভাব্য আধুনিক রূপকে আরো বেশি আলোচনা-পর্যালোচনায় নিয়ে আসা এবং তাতে সর্বস্তরের পন্ডিতদের আহ্বান জানানো। এর সমাধানের ওপরেই হয়তো নির্ভর করবে আগামী পৃথিবী এবং মানবসভ্যতার ভবিষ্যত পথচলা। আমরা নিশ্চয়ই তাকে ব্যর্থ হতে দিতে পারি না!