Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর আদ্যপান্ত

পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশের নিজস্ব সেনাবাহিনী রয়েছে। দেশের নিরাপত্তা রক্ষার্থে যারা দিনরাত নিজের জীবন বাজি রেখে কাজ করে যায় অবিরাম। অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা থাকে যে, সেনাবাহিনী শুধু দেশেরই থাকতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী বলে সম্পূর্ণ আলাদা এক সৈন্যদল রয়েছে, যারা কোনো দেশের হয়ে কাজ করে না। 

ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী মূলত অর্থের জন্য কোনো ব্যক্তি, দল, সংগঠনের জন্য কাজ করে থাকে। পৃথিবীতে এই ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীগুলোর কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা কারো কাছে বাধ্য না। যে বেশি অর্থ দেবে তার জন্যই জীবন বাজি রাখবে এই সৈন্যরা! বিশ্বে ধনতন্ত্রবাদ বাড়ার সাথে সাথে ব্যক্তিগত সৈন্যবাহিনীও বেড়ে যাচ্ছে। 

পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তিগত সৈন্যদলের প্রতিষ্ঠান ছিলো ওয়াচগার্ড। এই প্রতিষ্ঠানটি কর্নেল ডেভিড স্টার্লিং প্রতিষ্ঠা করেন ষাটের দশকে। কর্নেল ডেভিডকে ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর জনক বলা হয়ে থাকে। স্কটিশ এই মানুষটি দক্ষ সেনাকর্মকর্তা ছিলেন। ওয়াচগার্ড প্রতিষ্ঠার আগেই এসএএস নামে একটি দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি, বর্তমানে যেটিকে পৃথিবীতে সবচেয়ে সেরা সামরিক শক্তি হিসেবে মানা হয়। 

কর্নেল ডেভিড স্টার্লিং; Image Source: nam.ac.uk

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্টার্লিং আফ্রিকায় গিয়ে ক্যাপ্রিক্রন আফ্রিকা নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিলো বর্ণবাদ দূরীকরণে কাজ করা। তারপর বিভিন্ন আরব এবং আফ্রিকান দেশের জন্য সৈন্যদল প্রশিক্ষণ দিতে দিতে ওয়াচগার্ড করার চিন্তা তার মাথায় আসে।

ডিসকাউন্ট সৈন্যদল!

ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকেই আসতে পারে। এই সেনাবাহিনীগুলোর মধ্যে বিখ্যাত একটি কোম্পানি ডিফিয়ন ইন্টারন্যাশনাল যেমন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু থেকে এসেছে। পেরুতে দীর্ঘ কুড়ি বছরের গৃহযুদ্ধ শেষ হয় ২০০১ সালের দিকে, এখনো যার রেশ দেশটিতে রয়ে গেছে। 

গৃহযুদ্ধের ছাপ পেরুতে আজও বর্তমান; Image Source: The New York Times

দেশটির একটি প্রজন্ম বড়ই হয়েছে চলতে থাকা দ্বন্দ্বের মধ্যে। এই তরুণেরা বর্তমানে নিজেদের পরিবারের ভার বহন করতে পারছে না দেশটির দুর্বল অর্থনীতির জন্য। ডিফিয়ন ইন্টারন্যাশনাল সেই তরুণদের মাথাপিছু মাসে মাত্র ১০০ ডলার দিয়েই নিজেদের দলে ভেড়ায়! 

পেরুতে কোনোভাবে ভালো একটি কাজ পেলেই মাসে এরকমই বেতন পাওয়া যায়। সেই হিসেবে তরুণদের কাছে এই অর্থ ভালো বেতন!

ডিফিয়ন মধ্যপ্রাচ্যে বিপদজনক নিরাপত্তা বিষয়ক কাজ করে থাকে। অবশ্য তাদের চিকিৎসাসেবা, ইংরেজি শিক্ষা এবং জীবনবীমার মতো সাধারণ কিছু কাজও রয়েছ।

এই কোম্পানি থেকে সৈন্য ভাড়া করে ইরাকে পাঠানোর নজির রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। কম মজুরি পাওয়া এই পেরুবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও যুদ্ধ করেছে। এরা আরো বড় একটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যক্তিগত সেনাবিহিনী ‘ট্রিপল ক্যানোপি’তেও কাজ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা

ডিফিয়ন ইন্টারন্যাশনালের মতো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরেকটি ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর কোম্পানি ট্রিপল ক্যানোপি। তারাও কম মজুরিতে সৈন্য নিয়োগ দেয় দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন কিছু সৈন্যের প্রতিষ্ঠা করা এই কোম্পানিতে দক্ষিণ আমেরিকার সৈন্য ছাড়াও আরও অনেকে কাজ করে।

Image Source: Navy.com

প্রাক্তন নেভি সিল, রেঞ্জার্স, পুলিশ অফিসার এবং আর্মিও রয়েছে তাদের দলে। এই সৈন্যদল নিরাপত্তা এসকর্টের জন্য বিখ্যাত হলেও ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন মিশনগুলো এরা সম্পূর্ণ করেছে।সাদ্দাম হোসেইনের মৃত্যুর পর ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিয়োগ দেয়। তাদের কাজ ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের ইরাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়া। এই কোম্পানি দেশটির সেনাবাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ফলে অনেকে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় সেনাবাহিনী বলে উপাধি দেয়।

জার্মান ব্যক্তিগত সৈন্যদলের উত্থান 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই জার্মানি সংঘর্ষবিহীন জীবনযাপন করছিলো, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক শীতলই রয়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পুরো বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর কার্যকলাপে জার্মানি উদ্বেগ প্রকাশ করে।

২০০৭ সালে জার্মানি উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো আরেকটি খবর পায়। তাদের নিজেদেরই এক সেনাবাহিনী অফিসার এক ব্যক্তিগত সৈন্যদল গঠন করেছেন।

আবদিনুর আহমদ দারমান; Image Source: Sunatimes.com

 

থমাস নামে সেই কর্মকর্তার গঠন করা ‘অ্যাসগার্ড জার্মান’ নামে সেই কোম্পানির কার্যকলাপ জার্মান রাজনীতিবিদদের কপালে ভাঁজ বাড়িয়ে তোলে, যার মধ্যে একটি বড় কারণ হলো এই সৈন্যদল সোমালিয়ার রাষ্ট্রপতি আবদিনুর আহমদ দারমানের নিরাপত্তা প্রদান করা।

সোমালিয়াতে দারমান স্বনিযুক্ত রাষ্ট্রপতি। তিনি আগে সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধে সেনাপতি ছিলেন। আহমদ দারমান পৃথিবীর অল্প কিছু রাষ্ট্রপতির মধ্যে একজন, যিনি জাতিসংঘের কর্তৃত্ব মানেন না।

বৃহত্তর সেনাবাহিনী

যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্যান্য দেশও আস্তে আস্তে ব্যক্তিগত সেনাদলের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য আশানুরূপ লোকবল না পাওয়াই এর মূল কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সামনের কয়েক বছরেই যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে ৫০ হাজার সৈন্য কম পড়বে, নেভীতে ২০ হাজার। এই কারণগুলোই ব্যক্তিগত সৈন্যদলের বাণিজ্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিছুদিন আগেই ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব সেনাবাহিনীকে সরিয়ে ৫ হাজারের মতো ব্যক্তিগত সৈন্য জায়গা নিয়েছে। ইরাকের মতো অন্যান্য জায়গায় আরো সৈন্য নিয়োগ করা হয়েছে।

Image Source: History.com

 

ইউনিটি নামে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক একটি ব্যক্তিগত সৈন্যদলেরও বড় একটি অংশ ইরাকের মতো মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে থাকে। এই দলের মূল কাজ হলো বাগদাদে অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসে সরকারি কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা প্রদান করা। ইরাকের বাইরে লেবাননের সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বাহরাইনের গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত অনেক জায়গাতেই ইউনিটির সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। 

পুরো মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ১,২০০ সৈন্য মোতায়েন করা আছে শুধু এই প্রতিষ্ঠানেরই।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রদেশ ভার্জিনিয়াভিত্তিক পৃথিবীর অন্যতম বড় ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর দল ডাইনকর্প ইন্টারন্যাশনাল প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আনে দেশের জন্য। বর্তমানে এই দলটির দশ হাজার সৈন্য মোতায়েন রয়েছে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং ইউরোপের একাংশে। ডাইনকর্প খ্যাতি পায় ২০০০ সালে কলম্বিয়াতে বিদ্রোহ করা দলগুলোকে দমন করে। এই সৈন্যদের মাদকবিরোধী মিশনে পাঠানো হয়েছিলো পেরু, সোমালিয়া এবং সুদানের মতো দেশগুলোতে। 

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে- এত বড় বড় সৈন্যদল প্রশিক্ষণ পায় কোথা থেকে! তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যও আলাদা প্রতিষ্ঠান থাকে। অবশ্য বড় বড় কোম্পানিগুলো নিজেদের সৈন্যদের নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত প্রশিক্ষণের জায়গা আছে ‘একাডেমি’ নামে এক প্রতিষ্ঠানের। উত্তর ক্যারোলাইনাতে একাডেমির সাত হাজার একর জায়গা আছে শুধুমাত্র সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য।

২০০৭ সালে পাওয়া তথ্যমতে, এই একাডেমি থেকে ২০ হাজার সৈন্য, ২০টি যুদ্ধবিমান, অনেকগুলো সাঁজোয়াযান এবং বহু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর বের হয়েছে। 

নেতিবাচক দিক

ব্যক্তিগত সৈন্যদলের অনেক উপকারিতা থাকলেও সরাসরি কোনো নিয়মকানুন না থাকায় তাদের অনেক নেতিবাচক দিক রয়েছে। যুগে যুগে গণধর্ষণ, অকারণে মানুষ খুন করার মতো ঘৃণ্য অপরাধের আঙুল উঠেছে অনেকবারই এসব ব্যক্তিগত সৈন্যদলের দিকে।

Image Source: The New Yorker

 

২০০৭ সালে ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর কোম্পানি ‘কেবিআর’ এর কর্মচারী জেইমি লেই জোনস কোম্পানির বিপক্ষে মামলা করে বসেন। জেইমির দাবী অনুযায়ী, তার সাথের কিছু সৈন্য মিলে তাকে গণধর্ষণ করে ঘটনা ধামাচাপা দেবার জন্য জেইমিকে একটি শিপিং কন্টেইনারে বন্দি করে রাখে ২৪ ঘন্টা! পরবর্তীতে যথাযথ প্রমাণের অভাবে কেসে হেরে যান জেইমি।

২০০৫ সালে একটি ভিডিও প্রকাশ হয়, যাতে দেখা যায় একটি ব্যক্তিগত সৈন্যদলের কিছু সদস্য রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অকারণে কিছু সাধারণ মানুষের উপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে! এসব ছাড়াও মানব পাচারের মতো কাজেও কিছু ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর হাত আছে বলে জানা যায়। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, সামনের দিনগুলোতে পৃথিবীতে মানুষ আস্তে আস্তে ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর দিকে ঝুঁকে পড়বে। টাকা যার কাছে থাকবে তার কাছে থাকবে একটি সেনাবাহিনী!

Related Articles