আজ যে ঘটনাটি আপনাদের জানানো হবে, অনেকের কাছেই তা হয়তো গল্প মনে হতে পারে, হওয়াটা স্বাভাবিকও বটে। কিন্তু যত অবিশ্বাস্যই মনে হোক না কেন, এটি গল্প নয়, বাস্তব। ভাগ্য মানুষকে যে কতটা বিচিত্র পথে নিয়ে যেতে পারে তারই জলজ্যান্ত উদাহরণ এ ঘটনাটি।
যেভাবে হলো শুরু
আমাদের এই ঘটনার নায়ক মেহরান কারিমি নাসেরি। তার জন্ম ইরানে, সেখানকার স্থানীয় এক ডাক্তারের ঘরে। নাসেরির ভাষ্যমতে, জন্মসূত্রে তার মা ছিলেন একজন ব্রিটিশ নার্স, যিনি তার বাবার সাথেই কাজ করতেন, যিনি পরে ইরান ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তবে এ তথ্যকে নিশ্চিত করার মতো কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তিনি ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেছিলেন কিছু সময়ের জন্য। নাসেরি ছাত্র হিসেবে ছিলেন বেশ রাজনীতি সচেতন। তিনি যখন ছাত্র, তখন ইরানের ২,৫০০ বছরের পুরনো রাজতন্ত্র হুমকির মুখে, তরুণ প্রজন্ম তখন একটি বিপ্লবের জন্ম দিচ্ছে ধীরে ধীরে। নাসেরিও সেই বিপ্লবে অংশ নিতে গিয়ে রাজতন্ত্রের কর্তাব্যক্তিদের নজরে এসে গেলেন। তারা নাসেরিকে লঘু পাপে বেশ গুরু দণ্ড দিয়ে দিল, বহিস্কার করে দিল দেশ থেকে, কেড়ে নিলো তার পাসপোর্ট। তবে এই সবকিছুই, নাসেরির ভাষ্যমতে, শতভাগ সত্যতা প্রমাণ হয়নি এগুলোর কোনোটিরই।
বহিস্কৃত হবার পর নাসেরি ইউরোপ জুড়ে আশ্রয় খুঁজে বেড়াতে লাগলেন ‘রাজনৈতিক শরণার্থী’ হিসেবে। কিন্তু সব দেশই তার আবেদন নাকচ করে দিতে থাকলো। এভাবে চার বছর কেটে যাবার পর প্রথম তার ডাকে সাড়া দিলো বেলজিয়াম। বেলজিয়ামে আশ্রয় পাবার পর তিনি সেখানে থাকলেন ছয় বছর। তারপর একসময় ভাবলেন, তিনি ইংল্যান্ডে পাড়ি দেবেন। খুঁজে বের করবেন তার মায়ের পরিবারকে। তার নিজের দেশ তাকে ত্যাগ করেছে, তার মায়ের দেশই তো এখন তার আত্মপরিচয়! নাসেরি রওনা হলেন, বেলজিয়াম আর ইংল্যান্ডের মাঝে পড়লো প্যারিস।
ঝামেলার শুরুটা হলো এখানেই। প্যারিসে একটি ট্রেনে ভ্রমণ করবার সময় তার ব্রিফকেস চুরি হয়ে গেল, আর সেখানেই ছিলো তার আশ্রয় পাবার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। নিরুপায় হয়ে কাগজপত্র ছাড়াই তিনি ইংল্যান্ডে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্যারিসের চার্লস দে গল এয়ারপোর্ট থেকে তিনি রওনা দিলেন লন্ডনের উদ্দেশ্যে। ঠিকঠাক কাগজপত্রের অভাব থাকা সত্ত্বেও ফ্রান্স তাকে আটকালো না।
কিন্তু লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টে এসে ঠিক যেটা হবার কথা সেটাই হলো। পাসপোর্ট কন্ট্রোলটা পর্যন্ত তাকে অতিক্রম করতে দেয়া হলো না, ফিরতি প্লেনেই তাকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হলো ফ্রান্সে।
চার্লস দে গল এয়ারপোর্টে ফেরত আসলেন তিনি কাগজহীন অবস্থায়। পুলিশ ভাবলো, তিনি অবৈধভাবে ফ্রান্সে ঢুকতে চাইছেন। এসব ক্ষেত্রে যে ধরা পড়ে তাকে আবার তার নিজের দেশে ফিরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পুলিশ দেখলো, এ মানুষটির কোনো দেশই নেই। পুলিশ এ সমস্যার কোনো সমাধান বের করতে না পেরে তাকে এয়ারপোর্টেই ফিরিয়ে দিয়ে গেল।
কোনো কাগজপত্র ছাড়া নাসেরির পক্ষে এখন আর কোথাও যাওয়াও সম্ভব নয়, আর এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার চেষ্টা করলেও তিনি নিশ্চিত গ্রেফতার হবেন অবৈধভাবে ফ্রান্সে প্রবেশের চেষ্টার জন্য। এই দোটানায় পড়ে তিনি নিরুপায় হয়ে পড়লেন। এদিক ওদিক ভাবতে গিয়ে তিনি দাঁড়ালেন চার্লস দে গল এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ওয়ানে, সেদিনের তারিখ ছিল ২৬ আগস্ট, ১৯৮৮। তখন হয়তো মেহরান কারিমি নাসেরির কল্পনায়ও ছিল না, তার সামনে কেমন জীবন অপেক্ষা করছে।
অন্তহীন বিড়ম্বনা
নাসেরি এরপর সেই টার্মিনাল ওয়ানেই একটি রেস্তোরাঁর সামনের লাল বেঞ্চে নিজের একটি অস্থায়ী বসতি গড়লেন। তারপর একজন আইনজীবী জোগাড় করলেন এই ভোগান্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য। ফরাসি কর্তৃপক্ষের সাথে সেই আইনজীবী অনেক লড়লেন একটি ট্রানজিট বা রেফিউজি ভিসার জন্য। কিন্তু আদালত রাজি হলো না কোনোটাতেই।
তারপর তিনি উপায় খুঁজতে খুঁজতে ভাবলেন বেলজিয়ামের কথা। বেলজিয়ামই তো তাকে প্রথম দিয়েছিল বৈধ রেফিউজি স্ট্যাটাস। তাদের দেয়া কাগজপত্রগুলো হারিয়েই তো এই বিড়ম্বনার শিকার হতে হলো নাসেরির। এখন যদি আবারও সেসব কাগজপত্রের ব্যবস্থা বেলজিয়াম তাকে করে দেয়, তিনি আবারও বৈধভাবে দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ করতে পারবেন। কিন্তু তিনি খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, কাগজপত্রগুলো তাকে আবার তখনই দেয়া হবে, যখন তিনি বেলজিয়ামে সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করবেন। তখনই তিনি দেখলেন, তিনি একটি বড়সড় প্যারাডক্সের মুখোমুখি হয়েছেন। বেলজিয়াম না গেলে তিনি কাগজপত্র পাবেন না, কিন্তু কাগজপত্র ছাড়া তিনি বেলজিয়ামও যেতে পারবেন না।
তারও কিছুদিন পর তার কাটা ঘায়ে নূনের ছিটে পড়লো। বেলজিয়ামের সরকার জানালো, ফ্রান্স যদি নাসেরিকে ছেড়েও দেয়, তা-ও তিনি বেলজিয়ামে আর ঢুকতে পারবেন না। কারণ হিসেবে ছিল বেলজিয়ামের একটি আইন, যেখানে বলা ছিল, বেলজিয়াম কাউকে রেফিউজি হিসেবে আশ্রয় দেবার পর যদি সে স্বেচ্ছায় বেলজিয়াম ছেড়ে চলে যায়, তবে সে আর বেলজিয়ামে প্রবেশ করতে পারবে না। তাই এতদিকে চেষ্টা করেও নাসেরি তার মুক্তির কোনো পথই বের করতে পারলেন না।
লাল বেঞ্চের জীবন
আমরা অনেকেই হয়তো ট্রেন স্টেশনে বা এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছি কোনো কারণে; হয়তো কখনো ট্রেন লেট করেছে, কখনো ফ্লাইট পিছিয়ে গেছে। কিন্তু ১৮ বছরের অপেক্ষা? সেটা কি কল্পনা করতে পারছেন?
নাসেরি এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার কোনো উপায় পেতে ব্যর্থ হবার পর ১৮ বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন সেই টার্মিনাল ওয়ানে। একটি লাল বেঞ্চ, একটি টেবিল আর একটি ট্রলি লাগেজ- এই মিলেই ছিল তার জীবন। শুরুতে একটু কষ্ট হতো তার, কিন্তু আস্তে আস্তে সেখানে মানিয়েও নিয়েছিলেন।
সবই ছিল তার জীবনে। খাবার, বাথরুম সবকিছুর ব্যবস্থা তো আছেই এয়ারপোর্টে, আর টার্মিনাল ওয়ানের কর্মচারীরা সবাই তার বন্ধু বনে গিয়েছিল। প্রচুর বই পড়তেন তিনি, অনেক সময়ই তাকে দেখা যেত বই হাতে। আর লিখতেনও, আত্মজীবনীও লিখে ফেলেছিলেন তিনি এয়ারপোর্টে বসে যেটা প্রকাশ পায় ২০০৪ সালে, নাম ‘দ্য টার্মিনাল ম্যান।’
তিনি সবাইকে তার নাম বলতেন ‘স্যার আলফ্রেড’, তিনি আসলে যে ইরান তাকে ত্যাগ করেছে সেই ইরানকে নিজের দেশ ভাবতে পছন্দ করতেন না, নিজেকে পরিচয় দিতেন ব্রিটিশ হিসেবে। সবসময় নিজেকে পরিপাটি রাখতেন। তার সাধাসিধে কিন্তু বিচিত্র বৈশিষ্ট্য সবাইকেই আকর্ষণ করতো, সবাই পছন্দও করতো তাকে। এয়ারপোর্টের ডাক্তার তাকে প্রতি সপ্তাহেই দেখতে আসতো।
কিন্তু তারপরও এরকম একটি বদ্ধ জায়গায় দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়া মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। এত ঝঞ্ঝাটে পূর্ণ জীবন কাটাবার পর তার মনস্তত্ত্বটাও কিছুটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। তার এসব দুর্বলতার ছায়া দেখা যায় তার পরবর্তী জীবনের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে।
সাত বছর এয়ারপোর্টে কাটিয়ে দেবার পর বেলজিয়াম তাকে জানালো, তিনি চাইলে তাদের দেশে এসে থাকতে পারেন কোনো সরকার অনুমোদিত সমাজকর্মীর তত্ত্বাবধানে। কিন্তু তিনি সেটা গ্রহণ করলেন না, কারণ তিনি লন্ডনে যেতে চেয়েছিলেন, বেলজিয়ামে নয়। ১৯৯৯ সালে ফ্রান্সও তাকে তাদের দেশে থাকার অনুমতি দেয়, কিন্তু তিনি সেটাও নাকচ করে দেন, কারণ কাগজপত্রে তাকে ইরানী হিসেবে দেখানো হয়েছে, কিন্তু তিনি তো ব্রিটিশ! এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো আসলে তার মানসিক অবস্থার অবনতির দিকেই ইঙ্গিত করে।
তবে তার মানসিক অবস্থা যেমনই থাকুক, নিজের সম্মানের প্রতি তিনি কখনো আপোষ করেননি। এয়ারপোর্টে থাকা অবস্থায় প্রায়ই মানুষ তাকে আর্থিক সাহায্য করতে চাইতো। কিন্তু তিনি কখনো সেগুলো গ্রহণ করেননি, ‘ধন্যবাদ’ বলে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
একটুখানি খ্যাতি
নাসেরির জীবন নিয়ে তিনি এয়ারপোর্টে থাকা অবস্থাতেই কিছু প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয়, একটি ফরাসি ছবিও তৈরি হয় তাকে নিয়ে, কিন্তু তাকে সবচেয়ে বেশি পরিচিত করে তোলে হলিউড।
কিংবদন্তী চিত্রপরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গ নাসেরির গল্প শুনে তার গল্পটি নিয়ে একটি সিনেমা বানানোর চিন্তা করেন। তিনি নাসেরিকে ২-৩ লাখ মার্কিন ডলার (সঠিক পরিমাণটি অজানা) দিয়ে তার জীবনের গল্পটির চলচ্চিত্র সত্ত্ব কিনে নেন। এ ঘটনায় নাসেরি রীতিমত ধনী বনে যান, কিন্তু সেই সম্পদের প্রতি কোনো আকর্ষণ তার মাঝে দেখা যায় না।
পরে এই গল্পের মতো একটি গল্প নিয়েই তৈরি হয় টম হ্যাংক্স অভিনিত ‘দ্য টার্মিনাল’ সিনেমাটি। ছবিটি বিশ্বব্যাপী খুবই খ্যাতি অর্জন করে, তবে নাসেরির গল্পের সাথে সিনেমাটির গল্পের পার্থক্যও কম ছিল না।
অবশেষে স্বাধীনতা
২০০৬ সালে নাসেরি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। অনেকদিন তিনি সেখানে থাকেন। বলা বাহুল্য, হাসপাতাল থেকে বের হবার পর তাকে নিশ্চয়ই আবার এয়ারপোর্টের আগের জীবনে ফিরে যেতে দেয়া হবে না। বর্তমানে তিনি ফ্রান্সেরই একটি আশ্রমে বসবাস করছেন।
তাই এরপর থেকে যখনই কোথায় ঘুরতে বের হবেন, চেষ্টা করবেন আপনার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো সবসময় নিরাপদ রাখতে। মনে রাখবেন, নির্দিষ্ট কাগজপত্র ছাড়া আপনি একজন পরিচয়হীন মানুষ, যার আসলে কোথাও স্থান নেই। তাই ভ্রমণ করুন সতর্কভাবে, নিরাপদে।