ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিদেশি শাসকগোষ্ঠী খুব পরিকল্পিতভাবে উপনিবেশগুলোর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। শাসনের নামে শোষণ– এই নিগুঢ়, নির্মম কথাটির বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়েছিল তাদের বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। ঔপনিবেশিক দখলদারদের পা যেখানেই পড়েছে, সেখানেই স্থানীয় শিল্পকে ধ্বংস করে বিদেশিদের আনুগত্য মেনে নিতে বাধ্য করেছে তারা।
ভারতবর্ষের দিকেই আলোকপাত করা যাক। আমাদের গর্বের বস্ত্রশিল্পকে ইংরেজ বেনিয়ারা গলাটিপে হত্যা করেছে। মসলিন নিয়ে কাজ করা তাঁতিদের আঙুল কেটে নেওয়ার মতো পাশবিকতা সম্পর্কে সবাই কম-বেশি অবগত। আমাদের উর্বর ফসলি জমিগুলোতে জবরদস্তিমূলক নীলচাষ সম্পর্কে যেসব কাহিনী প্রচলিত আছে, সেগুলো উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের ঘৃণার মাত্রাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ লন্ডভন্ড হয়ে গেলে উপনিবেশগুলোতে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে জেগে ওঠা আন্দোলন চরম মাত্রা লাভ করে। যুদ্ধের কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় তাদের পক্ষে উপনিবেশগুলোর বিদ্রোহ দমনের মতো অবস্থা ছিল না। তাই তারা বাধ্য হয়ে তাদের উপনিবেশগুলোকে স্বাধীনতা দিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে একপ্রকার পালিয়ে যায়। সদ্যস্বাধীন দেশগুলোর নতুন করে নিজের পায়ে পথচলা শুরু হয়।
অভিশপ্ত ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভের পর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে টেকসই উন্নয়নের জন্য যে অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলা দরকার ছিল, তা করতে গিয়ে প্রতিটি সরকারকেই এক অভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে– দুর্নীতি। লুটেরা ভিনদেশি শাসকদের লুটপাটের পর যেটুকু জাতীয় সম্পদ অবশিষ্ট ছিল, সেটি কাজে লাগাতে গিয়েও সদ্যস্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর সরকারকে দুর্নীতির জন্য পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। সবচেয়ে ধ্রুপদী উদাহরণ হতে পারে উপনিবেশ-পরবর্তী ভারত। ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর দেশটির দুর্দমনীয় গতিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। জওহরলাল নেহরু দেশটিতে পশ্চিমা প্রভাব একেবারে কমিয়ে আনতে সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেন। অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, সরকারের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ, আয়ের তুলনায় উচ্চকর, সরকারি চাকরিজীবীদের তুলনামূলক কম বেতনের জন্য ভারতে প্রায় সকল স্তরে দুর্নীতির প্রসার বাড়তে থাকে। ফলাফল– পরবর্তী পাঁচ দশকে একেবারে ধীর গতির উন্নয়ন।
দুর্নীতির ক্ষেত্রে একটি বিষয় হচ্ছে, ভারতের দুর্নীতি উদ্ভব হয়নি এবং এটি ভারতের ইতিহাসে কোনো মৌলিক ঘটনাও নয়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও দুর্নীতির ঘটনা রয়েছে অনেক। আমেরিকায় গভর্নর থেকে শুরু করে একেবারে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কর্মকর্তা– অনেকেই দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা ভোগ করছেন। কিন্তু ভারতের দুর্নীতি সমস্যার সাথে আমেরিকার দুর্নীতি সমস্যার প্রধান পার্থক্য হচ্ছে– আমেরিকায় দুর্নীতির কারণে সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা খুব কমই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতে জন্মসনদ তৈরি, ট্রেনের টিকেট কেনা, জরুরি কাগজপত্র উত্তোলন– এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে সরকারি সেবা পেতে গেলে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয় না।
ভারতের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য স্বাধীনতার পর থেকে এমন একটি আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল, যা ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা পালন করবে। ১৯৬৩ সালে ভারতের আইন মন্ত্রণালয়ের বাজেট নির্ধারণের জন্য যখন পার্লামেন্টে আলোচনা চলছিল, তখন প্রথমবারের মতো একটি ‘লোকপাল’ পদ সৃষ্টির ধারণা আসে ভারতের সংসদ সদস্যদের মাঝে। কিন্তু সে-ধরনের সাংবিধানিক পরিবর্তন আনার জন্য তেমন চেষ্টা করা হয়নি। ১৯৬৬ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে কেন্দ্র ও রাজ্য– দুই পর্যায়ে দুটো স্বাধীন কমিটি গঠনের কথা বলা হয়, যে কমিটিগুলোর উপর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসবে, সেগুলো তদারকের দায়িত্ব থাকবে। ১৯৬৮ থেকে ২০১১– প্রায় পাঁচ দশক ধরে মোট আটবার পার্লামেন্টে লোকপাল বিল উত্থাপন করা হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে কখনও তা পাশ হয়নি।
২০১১ সাল ভারতের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় বছর হয়ে থাকবে। ২০১০ সালের দিকে ভারতের বেশ কিছু বড় ধরনের দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হওয়ায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতির ঘটনাগুলো (টু-জি স্পেকট্রাম স্ক্যান্ডাল, কমনওয়েলথ গেমস স্ক্যাম) জনসমক্ষে আসে। পুরো ভারতজুড়ে প্রতিবাদ-আন্দোলন শুরু হয়। জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয় আন্না হাজারে নামের একজন সাবেক দুর্নীতিবিরোধী কর্মীর অনশনের ঘটনা। তিনি দুর্নীতির প্রতিবাদে আমরণ অনশন করার সিদ্ধান্ত নেন। তার অনশনের ঘটনায় পুরো ভারতজুড়ে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে। আন্না হাজারের অনশনের পর থেকে গণমাধ্যমে আরও বেশি করে দুর্নীতির খবরগুলো আসতে থাকে।
আন্না হাজারের সাথে অসংখ্য নাগরিকে ‘ইন্ডিয়া অ্যাগেইনস্ট করাপশন’ (India Against Corruption or UAC) আন্দোলন শুরু করেন, যাদের মূল দাবি ছিল দীর্ঘদিনের প্রস্তাবিত জন লোকপাল বিলকে আইনে পরিণত করা। অনশনের চার দিনের মাথায় তৎকালীন ইউএপি সরকার আন্না হাজারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়, তিনি বিজয় ঘোষণা করেন। আইনের খসড়া প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়, যেখানে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা সদস্যদের পাশাপাশি বেসরকারি মানুষদেরও প্রতিনিধি রাখা হয়। বেসরকারি প্রতিনিধিরা তাদের প্রস্তাবিত বিলের মূলনীতিগুলো নিয়েছিলেন ‘ইউনাইটেড ন্যাশন্স কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট করাপশন’ (United Nations Convention Against Corruption) থেকে, যেখানে প্রতিটি দেশকে এমন কিছু দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান গঠন করতে নির্দেশ দেয়া হয়, যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা, স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত থেকে সরকারের যেকোনো কর্মচারীর দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখার ক্ষমতা রাখবে।
যৌথ খসড়া প্রণয়ন কমিটির নয়টি মিটিংয়ের পর সরকার বেসামরিক প্রতিনিধিদের মতামত ও পরামর্শকে পাত্তা না দিয়ে জন লোকপাল বিলের খসড়া প্রণয়ন করে এবং তা পার্লামেন্টে উত্থাপন করে। বেসামরিক প্রতিনিধিরা যে ধরনের লোকপাল কমিটির কথা বলেছিলেন, তার কিছু নীতি অবশ্য অনুসরণ করা হয়েছিল, কিন্তু বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ নীতিই অনুসরণ করা হয়নি। যেমন- কমিটির সদস্য নিয়োগ দেয়ার দায়িত্ব সরকারের উপর ন্যস্ত করা হয়, এমনকি লোকপাল কমিটির কোনো সদস্যকে বরখাস্তের ক্ষমতাও সরকারের হাতে দেয়া হয়। এছাড়া বেশিরভাগ সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে এই ধরনের কমিটির এখতিয়ারের বাইরে রাখা হয়। মূল কথা, আন্না হাজারে ও ভারতের সাধারণ মানুষেরা যে ধরনের স্বাধীন, প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ লোকপাল কমিটির স্বপ্ন দেখেছিলেন, ইউএপি সরকারের প্রস্তাবিত বিলে সে ধরনের নীতিগুলোকে বাদ দিয়ে একটি সরকার নিয়ন্ত্রিত লোকপাল কমিটি গঠনের কথা বলা হয়।
সরকার ও রাজনীতিবিদদের দ্বিচারিতায় অসন্তুষ্ট হয়ে আন্না হাজারে দ্বিতীয়বারের মতো অনশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু দিল্লি পুলিশ তাকে অনশনের জায়গা বরাদ্দ দিতে রাজি হচ্ছিল না। উপরন্তু, তাকে অনশনের আগে গ্রেফতার করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ জনগণ আরও বেশি করে রাস্তায় নেমে আসে, ভারতজুড়ে তীব্র দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ইউপিএ সরকার এতে করে আরও বেকায়দায় পড়ে যায়। পার্লামেন্টে একটি জরুরি সেশন ডেকে আন্না হাজারের তিনটি মৌলিক দাবি মেনে নেয়া হয়। পরবর্তীতে তা ভারতীয় পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটির নিকট পাঠানো হয়। শেষমেশ ২০১৩ সালে সেই আইন পাশ হয়।
তবে যে জন লোকপাল বিলকে আইনে পরিণত করার জন্য আন্না হাজারে ও লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিকের এত আন্দোলন-অনশন-সংগ্রাম, সেই সম্পর্কে না জানলে কিন্তু একেবারে মূল বিষয়গুলো জানা যাবে না। দুর্নীতি প্রতিরোধের সাথে এই আইনের সম্পর্ক কী, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কীভাবে এই আইন কার্যকর হবে– তা নিয়ে একটু ধারণা নেয়া যাক।
জন লোকপাল বিল অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে লোকপাল গঠন করতে হবে, রাজ্য পর্যায়ে গঠন করতে হবে লোকযুক্ত (Lokayukta), এগুলো হবে কমিটি আকারে। লোকপাল কমিটি বা লোকযুক্ত কমিটিকে কোনো মন্ত্রী কিংবা উচ্চপদস্থ আমলা তদন্তের ক্ষেত্রে প্রভাবিত করতে পারবে না। দুর্নীতির অভিযোগে কোনো মামলা বছরের পর বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। বিল অনুযায়ী, এক বছরের মধ্যে তদন্তের কাজ শেষ করে আরও এক বছরের মধ্যে বিচারকার্য শেষ করতে হবে। অর্থাৎ একজন দোষী ব্যক্তিকে অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার দুই বছরের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
দেখা যেত একজন দুর্নীতিবাজ কর্মচারী বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি সম্পদের বিশাল অংশ নিজের পকেটে ভরেছেন। কিন্তু এই আইনে এমন বিধান রাখা হয়েছিল যে, কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে যদি সরকারি সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়ে যায়, তাহলে সেই কর্মচারীকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ আবার সরকারের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে।