বিগত ৫০০ বছরের সাথে বর্তমান সময়ের তুলনা করলে দেখা যাবে যে গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে পৃথিবীর মানুষের। কারণ আজকের দিনে শিশু মৃত্যুর হার কম, মহামারী কিংবা যুদ্ধ বিগ্রহে মারা পড়ছে না কোটি কোটি মানুষ। চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত, বহু জটিল রোগ থেকে মুক্তি মেলে সহজেই।
দুশো বছর পেছনে ফিরলেও দেখা যায়, জন্মের পর একটি শিশুকে শৈশব-কৈশোরে বিভিন্ন রোগজীবাণুর সাথে একরকম যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হতো। আর যারা বেঁচে যেতেন, তাদের অনেকেই আয়ুস্মান হতেন; বাঁচতেন ৯০-১০০ বছর।
ওয়ার্ল্ড ব্যংকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের মানুষের বর্তমানে গড় আয়ু ৭০-৭২ বছর। আজকাল ১০০ বছরের উপর বেঁচে থাকা মানুষের সংখ্যা কম হলেও এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। পৃথিবীতে এমন এক গোত্র এখনও আছে, যাদের গড় আয়ু ১০০ বছরেরও বেশি। এমনকি সেই গোত্রের কেউ কেউ ১২০ বছরও বেঁচে থাকেন!
বলা হচ্ছে পাকিস্তানের ‘ব্রুশো’ আদিবাসীদের কথা। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের এই বাসিন্দারা আধুনিক নগরসভ্যতা থেকে বেশ দূরে থাকলেও বৈচিত্র্যময় জীবন আর দীর্ঘায়ুর কারণে তারা বেশ পরিচিত। তাদের আবাসস্থল হুনযা উপত্যকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গোটা বিশ্বের মাঝেই অন্যতম।
হুনযা উপত্যকা
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এক অঞ্চল কাশ্মীর। ভারত-পাকিস্তানের বিরোধপূর্ণ এই অঞ্চলকে বলা হয় পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ। কিন্তু কাশ্মীরের পাশেই এমন আরও একটি জায়গা আছে, যা হয়তো অনেকেরই অজানা। আফগানিস্তান-চীন সীমান্তে অবস্থিত পাকিস্তানের সেই অঞ্চল ‘গিলগিট বালটিস্তান’ যার নৈসর্গিক সৌন্দর্য কাশ্মীরের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়।
গিলগিটের এক জেলা হুনযা। পৃথিবীর বিখ্যাত চার পর্বতমালা হিমালয়, কারাকোরাম, পামির আর হিন্দুকুশের কুলঘেঁষা এই পাহাড়ি উপত্যকা যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক জীবন্ত প্রতিনিধি।
হুনযা উপত্যকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেমন ঐশ্বর্যশালী, তেমনি রয়েছে এর সমৃদ্ধ ইতিহাস। ‘মহাভারত’ অনুযায়ী এই অঞ্চল ছিল গান্ধার রাজ্যের অংশ। যদিও ইতিহাসে, খ্রিস্টপূর্ব সময়ের কোনো তথ্য পাওয়া যায় না হুনযা ভ্যালি সম্পর্কে। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ৭ম শতাব্দীতে এ অঞ্চলে বৌদ্ধদের আগমন ঘটে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা হানা দেওয়ার আগপর্যন্ত হুনযা ছিল স্বাধীন রাজ্য। শাসনক্ষমতায় ছিলেন ‘থাম’ শাসকরা। বলে রাখা ভালো, মুসলমানরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করলে হুনযায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায়। আর ‘থাম’রা ইসলাম গ্রহণ করে হয়ে যায় ‘মীর’।
১৮৯০ সালে ব্রিটিশরা এক সেনা অভিযানের মাধ্যমে তৎকালীন শাসক মীর শাফদার আলী খানকে পরাজিত করে। এর মাধ্যমে এক হাজার বছর ধরে স্বাধীন থাকা হুনযা উপত্যকা চলে আসে জম্মু-কাশ্মীরের মহারাজার অধীনে। পরে ১৯৩৫ সালে মহারাজার সাথে চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশরা হুনযার নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং গিলগিট এজেন্সির সাথে জুড়ে দেয়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় কাশ্মীরের মহারাজা চুক্তি বাতিল করেন ব্রিটিশদের সাথে। তিনি হুনযা উপত্যকায় পুনরায় নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান। কিন্তু হুনযার বাসিন্দারা বিদ্রোহ করে এবং পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়।
পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হলেও দীর্ঘদিন হুনযা ভ্যালি ছিল একটি স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। ১৯৭৪ সালে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এই সমস্যার সমাধান করেন। বর্তমানে এটি গিলগিট বালটিস্তানের একটি জেলা।
ভারতীয় উপমহাদেশের অঞ্চলগুলোতে সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী রাজত্ব করেছে। ফলে প্রায় সবগুলো অঞ্চলেই মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এদিক থেকে হুনযা ছিল ভিন্ন; টানা এক হাজার বছর তারা ছিল স্বাধীন, যার দরুন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তাদের ছুঁতে পারেনি। ব্রিটিশ যুগ পেরিয়ে বর্তমানে পাকিস্তানের অংশ হলেও হুনযার আদিবাসীরা আজও তাদের সেই পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে।
হুনযা আদিবাসী
হুনযা উপত্যকায় যে সমস্ত লোকেদের বাস তাদেরকে বলা হয় বুরুশো, ব্রুশো বা হুনযাকুট। এই আদিবাসীরা মোট ৩টি ভাষায় কথা বলে। একই জাতির মাঝে ভাষাগত পার্থক্যের কারণ হলো বসবাসের স্থান। যারা নিচু এলাকায় থাকে তাদের ভাষার নাম ‘শিনা’ (Shina)। পর্বত ও নিচু অঞ্চলের মধ্যবর্তী বাসিন্দারা কথা বলে ‘বুরুশাস্কি’ (Burushaski) ভাষায়। আর যাদের বাসস্থান একেবারে উঁচু ভূমিতে, স্থানীয়রা তাদের গোজাল (Gojal) বলে থাকে। গোজালরা মনের ভাব আদান-প্রদান করে ‘ওয়াখি’ (Wakhi) ভাষার মাধ্যমে।
পৃথক তিন অঞ্চলে বসবাস নিয়ে প্রচলিত আছে এক রোমাঞ্চকর কিংবদন্তি। ব্রুশোদের বিশ্বাস, হুনযা উপত্যকায় তাদের গোড়াপত্তন ঘটে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের সেনাবাহিনী ভারত আক্রমণের সময়। অভিযান শেষে গোটা সৈন্যদল ফিরে গেলেও থেকে যায় তিন সৈনিক, যাদের হাত ধরে এই দুর্গম পাহাড়ি পঞ্চলে গড়ে ওঠে ব্রুশোদের তিনটি বসতি।
গিলগিট বালটিস্তানের হুনযা জেলা আয়তনে খুব বেশি বড় নয়। অথচ এই অঞ্চলে একই জাতির তিনটি পৃথক ভাষা টিকে আছে হাজার বছর ধরে। এটি সম্ভব হয়েছে কেবল সেখানকার আদিবাসীদের মাঝে মিশ্র সংস্কৃতি গ্রহণের প্রবণতা কম থাকায়। তাই বলে এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই যে তারা এখনও সেই পুরনো যুগেই পড়ে আছে। বরং জেনে অবাক হবেন, এই দুর্গম পর্বতবাসীরা হলো পাকিস্তানের সর্বোচ্চ শিক্ষিত। তাদের স্বাক্ষরতার হার শতকরা ৯৭ ভাগ, যাদের অধিকাংশই আবার পেশাদার ডিগ্রিধারী।
পাকিস্তানে মুসলিম জনসংখ্যার অধিকাংশই সুন্নি। শিয়াদের সংখ্যা শতকরা ৬ ভাগ। অল্প সংখ্যক শিয়া মুসলিমের মাঝে অন্যতম এই ব্রুশো আদিবাসীরা, যারা ইসমাঈলি শিয়া দলের অন্তর্ভুক্ত। সেই হিসেবে এই জনগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা করিম আগা খান, যিনি ইসমাঈলি শিয়া মতবাদ অনুযায়ী বর্তমান ৪৯ তম ইমাম।
নিজেদের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের জন্য ব্রুশোরা যেমন এক বৈচিত্র্যময় জাতি, তেমনি ধর্মীয় বিশ্বাসে ইসমাঈলি শিয়া হওয়ায় অন্যান্য মুসলিমদের থেকেও ভিন্ন। ভিন্নতা রয়েছে এই তাদের আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্রেও। বলা হয়, গোটা পাকিস্তানে তাদের মতো অতিথিপরায়ণ আর কেউ নেই।
বর্তমান যুগে ৫০-৬০ বছর বেঁচে থাকার আশা করা যায় না। অথচ এত অল্প আয়ুকাল নিয়েও মানুষের কত কর্মব্যস্ততা, ক্যারিয়ার ভাবনা। কিন্তু ব্রুশোরা মোটেও এমন নয়। ৫০ বছর বয়স তাদের কাছে জীবনের অর্ধেক মাত্র। ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো বিশেষ চিন্তা নেই, যদিও শিক্ষা-দীক্ষায় ঐশ্বর্যশালী তারা। নগরের উন্নত জীবন কিংবা আধুনিক পৃথিবীর প্রতি মোহ নেই তাদের। একজন ব্রুশো আদিবাসীর কাছে পরিবার আর নিজের গ্রামই সব, যেমন ছিল হাজার বছর আগেও।
দীর্ঘায়ুর রহস্য
কথিত আছে, ১৯৮৪ সালে দেখতে-শুনতে অর্ধবয়স্ক এক লোক নিজের পাসপোর্ট দেখাতেই ইংল্যান্ডের হিথ্রো বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন অফিসে ঘটে যায় তুলকালাম ব্যাপার। নাম তার আবদুল মবুদ, থাকেন পাকিস্তানের গিলগিট বালটিস্তানের হুনযা জেলায়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, পাসপোর্টে তার বয়স উল্লেখ করা ১৬০ বছর, কিন্তু চেহারা বা শরীরের গড়ন দেখে তা বুঝবার উপায় নেই!
ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা বিশ্বাস করতে চাননি প্রথমে। তারা ভেবেছিলেন, নিশ্চয়ই কোথাও একটা গন্ডগোল আছে। কিন্তু আবদুল মবুদ জানান, সত্যি সত্যিই ১৬০ বছর বয়স তার। এই খবরটি হংকংয়ের এক পত্রিকায় প্রকাশ পেলে পুরো বিশ্বে সাড়া পড়ে যায়। খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, ১০০ বছরের উপর বেঁচে থাকা ব্রুশো’দের সংখ্যা অনেক।
এই ঘটনার আগেও ১৯৬৩ সালে হুনযা উপত্যকায় ফ্রান্সের একদল গবেষক এসেছিলেন। সেই সময় তাদের জরিপে উঠে এসেছিল ব্রুশোদের গড় আয়ু প্রায় ১২০ বছর।
ব্রুশো আদিবাসীদের দীর্ঘায়ু নিয়ে অনেক রকমের কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। তবে এই রহস্যের সমাধান বিজ্ঞান থেকেই পাওয়া যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের পরিবেশ, জলবায়ু আর খাদ্যাভ্যাসই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার আসল কারণ।
করোনাকালে মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে, পরিবেশকে একটু বিশ্রাম দিলে, কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারলে, একটু সচেতন হয়ে চলতে পারলে প্রকৃতি কতটা উদার হতে পারে। শুরুতেই বলা হয়েছে, হুনযা উপত্যকা দূষণ থেকে বেশ দূরে। তাই সেখানকার বাসিন্দারা প্রকৃতির শত্রুতা নয়, পেয়েছে বন্ধুত্ব।
হুনযার তিন অঞ্চলের বাসিন্দারাই কৃষিকাজের সাথে জড়িত। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত কোনো খাবার তারা খায় না। ফসল ফলানো ও নিজেদের পানের জন্য ব্যবহার করে হিমালয়ের ঠান্ডা পানি। অনেক গবেষকই মনে করেন, বিশুদ্ধ এই পানিই ব্রুশোদের দীর্ঘায়ুর মূল নিয়ামক। এমনকি বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশই হুনযা উপত্যকার সমমানের পানি সরবারাহের চেষ্টা চালাচ্ছে।
বছরে শুধু গ্রীষ্মকালীনই তারা চাষাবাদের জন্য পায়। বাকি সময় চলতে হয় মজুদ করা শষ্য দিয়ে। ঠিক এ কারণেই এমন ফলমূল চাষ করা হয় যেগুলো শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায় দীর্ঘদিন। এ তালিকায় এপ্রিকট (Apricot) নামের ফলটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, কপার ও লৌহ। এর জুস, তেল ও শুকিয়ে রাখা বীজ খাবারের যোগ্য।
এপ্রিকটের উপকারিতা আসলে বলে শেষ করা যাবে না। এটি যেমন রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, তেমনি চেহারায় আনে বিশেষ উজ্জ্বলতা। তাই কখনো যদি ৩০ বছর বয়সী কোন ব্রুশো রমণীর সাথে দেখা হয়, তাকে যে ষোড়শী ভেবে ভুল করবেন এ কথা হলফ করে বলা যায়।
হুনযা আদিবাসীরা আসলে কোনো অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাবলে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে না। আজকের যুগে ৫০ বছরের আগেই আমাদের যে রোগগুলো হয়, তাদের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। আর এর কারণও খুব পরিষ্কার। সেখানকার চমৎকার পরিবেশ-জলবায়ু ও বিশেষ কিছু খাবার, যা তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। সেই সাথে তারা থাকে একরকম সংরক্ষিত পরিবেশে যেখানে হুটহাট করেই কোনো রোগজীবাণু বাইরে থেকে এসে ছড়িয়ে পড়ে না।