আমি ভাগ্যবানদের একজন ছিলাম এবং আমি নিশ্চিত, এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কেউই যেতে চাইবে না।
করোনাভাইরাসের সাথে লড়াই করার অভিজ্ঞতা সারাজীবন আমার মস্তিষ্কে গেঁথে থাকবে। আমার সাথে যা হয়েছিল, তা একটি মাইল্ড কেইস বলা যায়। কিন্তু এর দুর্বলতম স্বরূপেও ভাইরাসটি অনেক বেশি নিষ্ঠুর। এখন যখন আমি সেরে উঠেছি, আমি আমার গল্প সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাইছি; কারণ আমি চাই, লোকে এই পরিস্থিতিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিক। সবার ভাগ্য হয়তো করোনাভাইরাসের মুখোমুখি হবার ক্ষেত্রে এতটা সহায় না-ও হতে পারে এবং টিকে থাকার এ লড়াইয়ে সবাই জয়ী না-ও হতে পারে। সবার প্রথমে, আমাদেরকে বাসায় থাকতে হবে। এই লড়াইটা আমাদের সবাইকে একসাথে লড়তে হবে এবং আমাদেরকে জিততে হবে।
যেভাবে শুরুটা হলো
আমার বন্ধু এবং আমি, আমাদের শুরুর ঘটনাটা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছি; ঠিক কোন পদক্ষেপ থেকে আমরা করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছিলাম, তা ভেবে বের করতে চেষ্টা করেছি। মনে হয়, এটা মার্চের শুরুর দিকের সেই রাত ছিল, যখন আমরা ওর এক আত্মীয়ার ৪০তম জন্মদিন পালন করতে গিয়েছিলাম। সেদিন শুক্রবার রাতে আমরা লং আইল্যান্ডের একটা মেক্সিকান রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম। অনেক খোশগল্প আর খাওয়াদাওয়াও হয়েছিল। মেগা মার্গারিটায় চুমুক দিতে দিতে আমরা ভালো সময় কাটাচ্ছিলাম।
তখন আমরা এসব নিয়ে কিছুই ভাবিনি। আমেরিকায় সেসময় কোভিড-১৯ এর ছড়িয়ে পড়ার কথা জানা গিয়েছিল শুধু, তাই এসব আমার মাথায় খুব একটা ছিলও না। আমি তখনো আমার জীবন কাটাচ্ছিলাম, যেভাবে এতদিন কাটিয়ে এসেছি- প্রতিদিন ট্রেনে করে কাজে যাওয়া, সারাদিন কাজ করা, বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সাথে বাইরে যাওয়া এবং হ্যাঁ, মার্গারিটা ভাগ করে নেওয়া! তবে খাবার কিংবা পানীয় ভাগ করে নেওয়া ১৩টি এমন দৈনন্দিন অভ্যাসের মধ্যে একটি, যা করোনাভাইরাসের পরবর্তী সময়ে অবশ্যই বদলানো উচিত।
এখন যখন ভাবি, মনে হয়, ওটাই ছিল এই সবকিছুর শুরু। আমার বন্ধু লুইসের ক্ষেত্রে সোমবারেই উপসর্গ দেখা দেয়া শুরু করে। ও মূলত বাসায় থেকেই কাজ করে, তাই আমরা ভেবেছিলাম এটা সেরে যাবে, নিছক ঠাণ্ডা ছাড়া আর কিছুই ভাবিনি। ওর সারা গায়ে ব্যথা, পাঁচদিন ধরে কিছুটা জ্বর ছিল। কিন্তু এটি যে খুব বড় বিষয়, তা মনে হয়নি। কিন্তু তারপরেই আমার ক্ষেত্রেও উপসর্গ দেখা দিতে লাগল।
ভিড়ের মধ্যে কাজ করা
আমি সেসময় একটি হোম-টেক্সটাইল কোম্পানিতে কাজ করতাম, এবং করোনাভাইরাসের সংবাদ আমাদের চারদিকে ছড়িয়ে গেলেও, আমরা স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন চীন থেকে প্রতি সপ্তাহে দু’বার করে ডেলিভারি আসত, যেহেতু ওদের কারখানাগুলো ইতোমধ্যে আবারো কাজ করা শুরু করে দিয়েছিল। অফিসের বেশ কিছু লোকেরও হালকা ঠাণ্ডা লেগেছিল, যা আমাদের কাছে সাধারণ ভাইরাস মনে হয়েছে, কিন্তু তাদের বেশিরভাগই এরপরও কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।
আমার উপসর্গ প্রথম দেখা দেয় ১৬ই মার্চ, সোমবারে। লুইসের অসুস্থ হবার এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছিল । শুরুতে কিছুটা জ্বর ছিল আমার, ৯৯ থেকে ১০০ ডিগ্রি হবে। খুব দুর্বল লাগছিল, কিন্তু তবু কাজ চালিয়ে গিয়েছি। দিনশেষে বসকে বললাম যে, আমার ছুটি লাগবে। এই সময়টাতে করোনাভাইরাস পুরো নিউইয়র্ক জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছে। তাই আমাকে বাসায় থেকেই কাজ করতে বলা হলো। মঙ্গলবারে শুরু হলো মাথাব্যথা। এত বেশি ব্যথা হচ্ছিল যে পুরোটা সময় আমাকে শুয়ে থাকতে হচ্ছিল- মাথা তুলে রাখতে পারছিলাম না। ব্যথাটা মূলত আমার চোখের পেছন দিকটায় হচ্ছিল, তীব্র সাইনাসের ব্যথার মতো।
অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে
সপ্তাহান্তে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। মনে হচ্ছিল, এটা খুব সাধারণ অসুখ নয়। শরীরের সবটা জুড়ে ব্যথা ছিল। অগোছালো মনে হচ্ছিল সবকিছু, ব্যথা ক্রমশ বেড়েই চলছিল। লুইস এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এবারে আমাদের মেডিক্যাল হেল্প নেওয়া দরকার। আমার জ্বর শুধু ১০০.৬ ডিগ্রি হলেও, মনে হচ্ছিল শরীরের চামড়া টানটান হয়ে আছে। তখন খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার হাঁটু, হাত এমনকি আমার কানেও যেন ব্যথা হচ্ছিল। আমার সমস্ত শরীর যেন ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ছিল।
আমরা পার্শ্ববর্তী একটা জরুরি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাই, যেখানে প্রথমে কাগজপত্রের কাজ সেরে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা করলাম। আমাকে পরীক্ষা করার পরে চিকিৎসক বললেন যে তিনি নিশ্চিত, আমার করোনাভাইরাস পজিটিভ আসবে। কিন্তু তিনি আমার নিশ্চয়তার জন্য আমাকে পরীক্ষা করাবার কথা বললেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে আমি লুইসের দ্বারাই সংক্রমিত হয়েছি। আমি পরীক্ষা করতে রাজি হই, কিন্তু এক সপ্তাহ পর্যন্ত কোনো ফলাফল আসেনি।
পরে আমি জানতে পারি, শুধু হাসপাতালগুলোতেই পরীক্ষার ফলাফল দ্রুত পাওয়া সম্ভব। করোনার পরীক্ষায় চিকিৎসক একটা লম্বা তুলোর শলাকা আমার নাকের যত ভেতরে নেওয়া সম্ভব, ততদূর প্রবেশ করান; মনে হচ্ছিল, সেটি যেন আমার কপাল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। পরীক্ষাশেষে তিনি আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দেন এবং টাইলেনল নিতে পরামর্শ দেন। তবে তিনি এও বলেন যে, তার পক্ষে এরচেয়ে বেশি কিছুই করা সম্ভব নয়। কোনোভাবেই যাতে পানিশূন্যতা না হয়, তাই তিনি ঘন ঘন জলপানের পরামর্শ দেন।
বাসায় ফেরার পথে আমরা দোকান থেকে সেসময় যে ধরনের টাইলেনল পাওয়া যাচ্ছিল, সেটিই নিয়ে আসি। এই সময়টাতে অন্য সব জরুরি জিনিসের মতো ওষুধপত্র পাওয়াটাও কষ্টসাধ্য। এর ফলে প্রয়োজনের সময় বিষয়গুলো আরো কঠিন হয়ে ওঠে।
চূড়ান্ত ভোগান্তি
শনিবার সন্ধ্যায় অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়। জ্বর ১০১.৮ ডিগ্রিতে পৌঁছায়, এবং আমি আর ঘুমোতে পারছিলাম না। অনেক বেশি ঘামছিলাম এবং আমার হাঁটু, কোমর ও পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই একটা ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়ে এসেছি। একেবারেই নড়তে পারছিলাম না। মুখের স্বাদ এবং ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। এজন্য খাবারে অনেক বেশি মশলা দিয়ে দিচ্ছিলাম, যাতে একটু স্বাদ পাওয়া যায়। কিন্তু এতে কোনো কাজ হয়নি। এরপর শুরু হলো পেটে ব্যথা এবং ডায়রিয়া। অদ্ভুত বিষয় এই যে, শুকনো কাশির উপসর্গটি সবার শেষে এসেছিল। নভেল করোনাভাইরাসের উপসর্গ সম্পর্কে যতকিছু শুনেছি, সে অনুযায়ী আমার লক্ষণগগুলো যেন উল্টো পথে হাঁটছিল।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি একেকটি দিন টিকে থাকবার জন্য লড়ছিলাম, ভয় পাচ্ছিলাম, আমাকে যেন রোগীভর্তি কোনো হাসপাতালে গিয়ে না পড়তে হয়। ভয় পাচ্ছিলাম, আমার সাহায্য দরকার হলে সেখানে যথেষ্ট চিকিৎসক, নার্স, ভেন্টিলেটর- এমনকি বিছানাও থাকবে না। ভয় পাচ্ছিলাম, এ অসুখের কোনো প্রতিষেধক বা ভ্যাক্সিন নেই বলে। একা থাকার ভয়, এবং সম্ভবত হাসপাতালে একা মারা যাবার ভয় আমার মস্তিষ্ক জুড়ে আরো ভয় সৃষ্টি করছিল। আমি জানতাম না, অবস্থা আর কতটা খারাপ হবার বাকি ছিল এবং সবচেয়ে বেশি ভয় ছিল অনিশ্চয়তার।
শেষমেশ আমার জ্বর ছাড়ে বুধবারে। আমি সেরাতে বিছানায় যাই এবং পরদিন সকালে কাঁটায় কাঁটায় ৯৮.৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা নিয়ে ঘুম থেকে উঠি, যা আর বাড়েনি। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম সেদিন। দু’দিন পর, স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আমাকে ফোনে জানানো হয় যে আমি কোভিড-১৯ পজিটিভ। ততক্ষণে, আমি অনেকটাই সেরে উঠেছি, শুধু একটু শুকনো কাশি রয়ে গিয়েছিল।
যা আগে জানলে ভালো হতো
যখন ফিরে তাকাই, মনে হয়, মানুষ যদি এই ভাইরাসকে আরো একটু গুরুত্বের সাথে নিত! নিউইয়র্ক শহরে আমরা যেন একে অপরের ওপর বাস করি, এতটাই ভিড়; কাজে যাবার সময় ট্রেনেও সবাই অবমুক্ত। তাই মনে হয়, মানুষ যদি জানত, অবস্থা কতটা গুরুতর হতে পারে, যখন আমার মতো ‘মাইল্ড’ কেইসও হয়। আমি জানি, অনেক চিকিৎসক বলেছেন যে, এই ভাইরাসের সাথে সংস্পর্শে এসে বেঁচে যাবার পর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হয়। কিন্তু আমি এখনো জনপরিসরে চলাফেরা করার সময় মাস্ক পরি।
আমি জানি না, এটি আবার হতে পারে কিনা, তবে আমি আর এর সংস্পর্শে যেতে চাই না। আমি আর কোনো সুযোগ বাকি রাখতে চাই না। আমি জানি অনেকেই মনে করছেন যে গণমাধ্যমগুলো তিলকে তাল বানাচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে এটি একেবারেই সত্যি নয়। এই পুরো বিষয়টিই অনেক বেশি কষ্টের ছিল, আমাদের শুধু ভাগ্যটা ভালো ছিল।