প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন পরাশক্তি দেশগুলোর কাছে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ বরাবরই ভৌগোলিকভাবে একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জ প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। প্রায় ৩০,৪০৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ওশেনিয়া মহাদেশের মেলানেশিয়া অঞ্চলে অনেকগুলো দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। এই দ্বীপপুঞ্জ ১৯৭৮ সালের ৭ই জুলাই যুক্তরাজ্যের নিকট থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে।
বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীনের ক্রমাগত হুমকি উপেক্ষা করে ১৯৮৩ সাল থেকে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সাথে তাইওয়ানের কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা হয়। এই কূটনৈতিক সম্পর্ক চালুর প্রায় ৩৬ বছর পর ২০১৯ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর সলোমন দ্বীপপুঞ্জের পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত এক ভোটাভুটিতে দেশটি তাইওয়ানের পরিবর্তে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এরপর ২০১৯ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর সলোমন দ্বীপপুঞ্জ তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে চীনের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু করেছে।
২০১৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রচণ্ড চীনবিরোধী হিসেবে পরিচিত তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত সাতটি রাষ্ট্র তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। সর্বশেষ, গত ১০ই ডিসেম্বর মধ্য আমেরিকার রাষ্ট্র নিকারাগুয়া তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের মাত্র ১৪টি রাষ্ট্রের সাথে তাইওয়ানের আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু রয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন তাইওয়ানের সাথে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত করতে চীনের বিরুদ্ধে অন্যায্য অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের অভিযোগ তুলেছেন।
চীনের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালুর কারণ হিসেবে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাবের বিষয়কে বিবেচনা করা হচ্ছে। চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মেনাসেহ সোগেভার সলোমন দ্বীপপুঞ্জের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এবং দেশটির অন্যান্য খাতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজনে চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। অন্যদিকে, দেশটির বৃহত্তম প্রদেশ মালাইটার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ড্যানিয়েল সুইদানি সরকারের চীনঘেঁষা নীতির কট্টর সমালোচনা করেছেন। এমনকি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মালাইটা প্রদেশের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ড্যানিয়েল সুইদানি এই বছরের ২৬শে মে তাইওয়ান এর রাজধানী তাইপে যান এবং সেখানে অবস্থিত একটি হাসপাতালে তার মস্তিষ্কের টিউমারের চিকিৎসা করান। এই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ দেশটিতে ‘চীনের আধিপত্যবাদী নীতি’র বিরুদ্ধে অবস্থান বজায় রেখেছেন।
কোনো দেশে প্রচুর অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং আর্থিক সহযোগিতার বিনিময়ে একটি দেশের রাজনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব বিস্তারের কৌশলকে ‘ডলার ডিপ্লোম্যাসি’ হিসেবে অবহিত করা হয়। সম্প্রতি, অন্য দেশে প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে চীনের এই কূটনীতি প্রয়োগের কয়েকটি ঘটনা বেশ লক্ষ্যণীয়। সলোমন দ্বীপপুঞ্জে ক্রমবর্ধমান চীনের প্রভাব বিস্তারের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট উদ্বেগ এর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি সলোমন দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী হোনিয়ারায় দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মেনাসেহ সোগেভারের সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বিক্ষোভ একপর্যায়ে সহিংসতায় রূপ নেয়। এইসময় রাজধানী হোনিয়ারায় একটি চীনা অধ্যুষিত এলাকায় অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটে। প্রতিবাদকারীরা সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং চীনের সাথে অযাচিত ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলেছিল। এদিকে, অস্ট্রেলিয়া সরকার সেই বিক্ষোভ মোকাবিলা করতে সলোমন দ্বীপপুঞ্জে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করে। চীনের সাথে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন ইস্যুতে ক্রমবর্ধমান বিরোধ থাকলেও সলোমন দ্বীপপুঞ্জের চীনপন্থী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মেনাসেহ সোগেভারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দমনে অস্ট্রেলিয়ার সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ করা হয়।
এই সহিংস বিক্ষোভের পর দেশটির পার্লামেন্টের বিরোধী দলসমূহ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মেনাসেহ সোগেভারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তোলে। তবে, গত ৬ই ডিসেম্বর পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত ভোটে সেই অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়নি। ৩২ জন পার্লামেন্ট সদস্য অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন; অন্যদিকে, ১৫ জন বিরোধী দলীয় সদস্য সেই প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন দেন এবং ভোটাভুটিতে দুজন পার্লামেন্ট সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন। এই অনাস্থা ভোটে উতরে গিয়ে মেনাসেহ সোগেভার এক ভাষণে ‘তাইওয়ানের অনুচরদের কাছে মাথা নত না করা’র ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সুরক্ষার জন্য এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব রুখে দিতে যুক্তরাষ্ট্র সমসময়ই তৎপর। তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের চীনের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু করার ঘটনা এই অঞ্চলে কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে চীনের এক বড় অর্জন। সলোমন দ্বীপপুঞ্জে কোনো মার্কিন দূতাবাস নেই; ওশেনিয়া মহাদেশের মেলানেশিয়া অঞ্চলে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র মূলত অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত দেশটির কূটনৈতিক মিশনের সহযোগিতা গ্রহণ করে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে, সলোমন দ্বীপপুঞ্জের অর্থনৈতিক দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে চীনের ‘ডলার ডিপ্লোম্যাসি’র পদক্ষেপ বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে কতটা প্রভাব ধরে রাখতে পারবে, সেটা সময়ই নির্ধারণ করতে পারবে।