
“Big brother is watching you.” জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত সামাজিক-রাজনৈতিক ফিকশন ‘1984’ এর কালজয়ী উক্তি। এটি এমন এক কল্পনগরী যেখানে এর বাসিন্দাদের কোনো কিছুই গোপন থাকে না; তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ নজরদারি করা হয় ‘বিগ ব্রাদার’রুপী পার্টি মেম্বারদের দ্বারা। এই কল্পনগরীর বাসিন্দাদের নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী কিছু করার স্বাধীনতা নেই; এমনকি নেই চিন্তার স্বাধীনতাও!

এমন ইউটোপিয়ান গল্প এতদিন শুধুমাত্র উপন্যাসে দেখা গেলেও অনেকের অভিযোগ, সাম্প্রতিক সময়ে চীন দেশটির বাসিন্দাদের স্বাধীনতায় চূড়ান্ত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সেই কল্পনগরীকে বাস্তবে রূপ দান করেছে। আর এই কাজে প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে একদলীয় কমিউনিস্ট শাসিত চীন সরকার সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম নামে এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
অনেকেই ‘ব্যাংক ক্রেডিট স্কোর’ সম্পর্কে জানি যার মাধ্যমে গ্রাহকের বছরব্যাপী কাজের তথ্য বিশ্লেষণ করে তার বিশ্বাসযোগ্যতা পরিমাপ করা হয় এবং তার ভিত্তিতে রেটিং প্রকাশ করা হয়। যার মাধ্যমে ঋণদাতা ব্যাংক নির্দিষ্ট গ্রাহককে দেয়া ঋণের ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা লাভ করে এবং ঋণ পরিশোধে তার প্রবণতা সম্পর্কে যাচাই-বাছাই করতে পারে। উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে চীন অনেকটা একইভাবে দেশটির জনগণের দৈনন্দিন কাজকর্ম, আচার-আচরণ এবং বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার সূচি প্রকাশ করছে যা সোশ্যাল ক্রেডিট স্কোরিং সিস্টেম নামে পরিচিত।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির কাছ থেকে সংগ্রহ করা চীনা নাগরিকদের প্রতিদিনকার প্রায় সব ধরনের তথ্য এবং দেশজুড়ে স্থাপন করা ২০ কোটি সার্ভেইলেন্স ক্যামেরার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে চীনা সরকার ২০১৪ সাল থেকে এই সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম পরিচালনা করছে। সংগ্রহ করা এই বৃহৎ তথ্য ভান্ডারে বাদ যাচ্ছে না প্রায় কোনো কিছুই; যেমন- ব্যক্তির অর্থনৈতিক তথ্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্রিয়াকলাপ, ঋণ সম্পর্কিত তথ্য; এমনকি ব্যক্তি কোথায় যায়, কী করে, কার সাথে মিশে তা-ও চেহারা চিহ্নিতকারক সফটওয়্যার ব্যবহার করে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি করা হচ্ছে।

মূলত ২০১০ সালে এক পাইলট প্রকল্পের আওতায় চীন সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম হাতে নেয় এবং ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশব্যাপী এর কার্যক্রম শুরু করে। সরকারি তথ্যমতে এই প্রকল্পের (২০১৪ – ২০) আওতায় ২০২০ সালের মধ্যে চীন তার প্রায় ১৪০ কোটি নাগরিকের সোশ্যাল ক্রেডিট স্কোর জনসম্মুখে প্রকাশ করতে পারবে। এবং ওই সময় নাগাদ সেখানে প্রত্যেক নাগরিকের নামে তাদের প্রাপ্ত সোশ্যাল ক্রেডিট স্কোরের জন্য বিবেচিত বিষয়সমূহের পূর্ণ বিবরণসহ একটি করে অনুসন্ধানকারী নথি থাকবে যার মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা লাভ করা যাবে।

চীন সরকারের ভাষ্যমতে, দেশে আইন অমান্যকারীদের শাস্তি বিধান এবং সততা ও ন্যায়-নীতিবোধ সম্পন্ন মানুষকে ভালো কাজে আরো উৎসাহিত করা এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে আরও বেশি স্বচ্ছতা বিধান, সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই এর প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আশা এই সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম সৎ ও বিশ্বস্ত নাগরিককে দেশে চলাচলের ক্ষেত্রে স্বর্গসুখ দেবে, অথচ দুর্বৃত্তের জন্য এক পা ফেলাকেও করে তুলবে দুরূহ। কর্মকর্তারা বলছেন, এই সিস্টেমে উচ্চ ক্রেডিট স্কোর-সম্পন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে যার মধ্যে বিদ্যুৎ বিলে ছাড়, ডেটিং ওয়েবসাইটে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা, এমনকি পাবে স্বল্পমূল্যের আকর্ষণীয় ভ্রমণ প্যাকেজও! এছাড়াও ইতোমধ্যে চীনের হাসপাতালগুলোও এই ক্রেডিট স্কোর ব্যবহার করা শুরু করেছে। ৬৫০ এর বেশি স্কোর করা যেকোনো নাগরিক হাসপাতলে ডাক্তারি ফি ছাড়াই চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারবে।
অপরদিকে কম ক্রেডিট স্কোর সম্পন্ন ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। তারা নতুন বাড়ি অথবা ভালো পণ্য ক্রয় করতে পারবে না, অনেককে ডেটিং ওয়েবসাইট থেকে বের করে দেয়া হবে, এমনকি কেউ কেউ তাদের বাচ্চাদেরকে নিজেদের পছন্দমতো স্কুলে পর্যন্ত ভর্তি করাতে পারবে না!

সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী বিভিন্ন কাজের জন্য ক্রেডিট স্কোর কমতে বা বাড়তে পারে। যেমন- কেউ যদি শিশুদের জন্য ডায়পার ক্রয় করে তবে তার রেটিং বেড়ে যাবে, যেহেতু এর মাধ্যমে দায়িত্বশীল আচরণের প্রমাণ মেলে। অন্যদিকে, কেউ অ্যালকোহল জাতীয় দ্রব্য ক্রয় করলে তার রেটিং কমে যাবে। কেউ যদি ভিডিও গেম খেলতে পছন্দ করে এবং খেলার সময় কারো সাথে প্রতারণা না করে তাহলে তার রেটিং বাড়তে পারে। কিন্তু আবার দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি গেম খেললে তার পয়েন্ট কমে যেতে পারে (যেহেতু এতে সে দৈনন্দিন কাজে পিছিয়ে পড়বে বলে ধারণা হয়)। কেউ রাস্তায় অথবা এয়ারপোর্টে কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ করলে তার রেটিং কমে যাবে, অথচ কেউ যদি মানবিক কাজে অর্থ ব্যয় করে তাহলে তার পয়েন্ট বাড়বে!
তবে শুনতে চমৎকার শোনালেও এই সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম নিয়ে আছে অনেক আশংকাও। যদিও পূর্ব থেকেই অত্যধিক সরকারি নজরদারিতে অভ্যস্ত অনেক চীনা নাগরিক বিশেষ করে যাদের ক্রেডিট স্কোর বেশি এবং এর মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন তারা এই প্রযুক্তিগত নজরদারির সমর্থন করেছেন। তাদের মতে, এর মাধ্যমে সমাজে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার আরও উন্নতি ঘটবে এবং নাগরিকের নিরাপত্তাও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু অনেকের মতে, এর মাধ্যমে জনসাধারণের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং এর স্বল্পতম অপব্যবহারই জনজীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এছাড়াও অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন কমিউনিস্ট শাসিত চীনা সরকার বিরোধী মত দমনে এই কেন্দ্রীয় নজরদারি ব্যবস্থার সুবিধা নিতে পারে। এরই মধ্যে এসব অভিযোগের কোনো কোনোটির সত্যতাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে যার প্রধান ভুক্তভোগী দেশটির জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসকরি সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমরা।

সম্প্রতি ফিলিস্তিন ও রোহিঙ্গাদের পরেই জাতিগত নিধনের হুমকির মুখে থাকা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে উইঘুর মুসলিমদের নাম উঠে এসেছে। চীনে বসবাসকারী মুসলিমদের অধিকাংশই জিনজিয়াং প্রদেশে বাস করে এবং দেশটিতে সংখ্যালঘু মুসলিমরা স্বায়ত্তশাসিত এই অঞ্চলের প্রায় ৪৬ ভাগ জনসংখ্যা নিয়ে সংখ্যাগুরু। কিন্তু চীনের বিরুদ্ধে উইঘুর মুসলিমদের জোরপূর্বক আটক রেখে নির্যাতন ও ধর্মান্তরিত করার অভিযোগ উঠেছে এবং এই কাজেও তারা সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এমনকি সেখানে এর আওতা এতই বৃদ্ধি করে হয়েছে যে উইঘুরদের ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হচ্ছে! যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আরও অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে জিনজিয়াং প্রদেশে পর্যায়ক্রমিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। তবে চীন বরাবরের মতোই সকল অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেছে জননিরাপত্তার স্বার্থেই সেখানে এসব করা হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেমের নামে খুব সহজেই তারা সেখানে ভিন্নমত দমন এবং নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ আরোপের সুযোগ পাচ্ছে।
উচ্চ প্রযুক্তির এই যুগে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সুবিধা লাভের বিনিময় মূল্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী মানুষ হারাচ্ছে তাদের গোপনীয়তার অধিকার। ঠিক সেই সময় চীন সরকারের সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম অন্তত একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে; প্রযুক্তির উৎকর্ষতাকে যেমন সমাজের উন্নতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মডেল হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব, তেমনি সম্ভব জনজীবনকে নরকে পরিণত করাও।
বিশ্বের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/