Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাইবার অস্ত্র নিয়ে বিশ্বনেতাদের লড়াই | পর্ব ২

(পর্ব ১-এর পর থেকে) 

গত নভেম্বরে (২০২১) যুক্তরাষ্ট্র এনএসও গ্রুপকে কালো তালিকাভুক্ত করে। এই তালিকা মূলত তৈরি করা হয়েছিল প্রাণঘাতী অস্ত্র তৈরির ব্যবসা করে এমন জাতি বা সংস্থাগুলোর কাছে আমেরিকান কোম্পানিগুলো যেন কিছু বিক্রি করতে না পারে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এই তালিকায় বিভিন্ন সাইবার অস্ত্র নির্মাণকারী কোম্পানি যুক্ত হয়েছে। এনএসও আমেরিকান কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আর তাদের প্রয়োজনীয় কোনো কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারবে না।

বিভিন্নভাবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা খাতের মধ্যমণি হয়ে থাকা কোম্পানিটির জন্য এটা ছিল প্রকাশ্যে চরম তিরস্কার। এতে আমেরিকান প্রযুক্তি ব্যবহারে তাদের অনুমতি না থাকায় ডেল কম্পিউটার কিংবা অ্যামাজন ক্লাউড সার্ভার পরিচালনা করার কাজগুলো তাদের নিজেদের করতে হচ্ছিল। এতে কোম্পানির পুরো কার্যকারিতাই হুমকির মুখে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র এই সংবাদ প্রকাশ করার আধ ঘণ্টারও কম সময় আগে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রেরণ করে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

ইসরায়েলের জাতীয় সাইবার অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ইগাল উন্না; Image Source: Reuters

মিডিয়াতে শিরোনাম আসতে থাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানিটি নিয়ে, যা ইসরায়েল ভিত্তিক হলেও বড় অংশের বিনিয়োগ এসেছে বাইরে থেকে বা অফশোর ফান্ডের মাধ্যমে। কিন্তু ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় যেন এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ওপরই আঘাত করা হয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ইসরায়েলের জাতীয় সাইবার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থাকা ইগাল উন্না বলেন,

এনএসও’র দিকে যারা তীর ছুঁড়ে মারছে, তারা আসলে এর পেছনে ঝুলে থাকা নীল আর সাদা রঙের পতাকাকে লক্ষ্য করেই ছুঁড়ছে।

ইসরায়েলের রাগের একটা কারণ ছিল আমেরিকার কপটতা নিয়ে। আমেরিকা বছরের পর বছর ধরে এনএসওর পণ্য গোপনীয়তার সাথে নিজ ভূখণ্ডে পরীক্ষা করার পর অন্তত একটি দেশ জিবুতির হাতে সরবরাহ করেছে, যাদের কিনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। তারপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল। এছাড়া এখানে ইসরায়েলের নিজের স্বার্থও জড়িত আছে। ইসরায়েলের আভ্যন্তরীণ রপ্তানি লাইসেন্স প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এনএসও কাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারবে, তার চূড়ান্ত রায় দেওয়ার এখতিয়ার কেবল রাষ্ট্রের। এর মাধ্যমে ইসরায়েল এনএসওকে এর জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের কেন্দ্রীয় অংশ হিসেবে বছরের পর বছর ব্যবহার করে আসছে। একইসাথে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে কোম্পানিকে।

বছর জুড়ে চলা নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এনএসওর সাইবার-অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া বা না দেওয়া কীভাবে ইসরায়েলের কূটনীতিতে ভূমিকা রাখছে। অনুসন্ধানের মধ্যে রয়েছে ডজন খানেক সরকারি কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতা, বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার কর্মীদের সাক্ষাৎকার। মেক্সিকো ও পানামার মতো দেশগুলো পেগাসাস ব্যবহারের ক্ষমতা পেয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভোটে ইসরায়েলপন্থী হয়ে ওঠেছে। টাইমসের প্রতিবেদনে এটাও উঠে আসে ইরানের বিপক্ষে ইসরায়েলের অবস্থানের পেছনে আরব দেশগুলোর সমর্থনে পেগাসাসের অদৃশ্য অথচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল কতটা। এমনকি ২০২০ সালে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল ও এর দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ বেশ কয়েকটি আরব দেশের যে কূটনৈতিক সমঝোতা হয়, তার পেছনেও পেগাসাসের ভূমিকা ছিল।

এনএসও গ্রুপকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র; Image Source: Reuters

ইসরায়েলের প্রভাবশালী হয়ে উঠার আকাঙ্ক্ষা আর এনএসওর মুনাফা তুলে আনার প্রয়াসে শক্তিশালী স্পাইয়িং যন্ত্রগুলো গিয়ে বিশ্বব্যাপী নতুন প্রজন্মের জাতীয়তাবাদী নেতাদের হাতে গিয়ে পড়ছে। ইসরায়েল সরকারের তদারকি করার উদ্দেশ্য ছিল স্পাইওয়্যারগুলো যেন এমন কোনো জায়গায় বিক্রি না হয়, যেখানে জনগণের ওপর দমনমূলক কার্যক্রম চলতে পারে। কিন্তু পেগাসাস বিক্রি করা হয়েছে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ভারতের মতো দেশগুলোতে। এই দেশগুলো মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে কোম্পানিটিকে নিষিদ্ধ করলেও গোপনীয়তার সাথে এর প্রযুক্তিগুলো নিয়ে পরীক্ষা করেছে আর বিস্তৃত করেছে। এনএসও নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলের বর্তমান অবস্থান নির্দেশ করে তাদের সরকাররা একসময় মিলিটারি ফাইটার জেটগুলোর মতোই সাইবার অস্ত্রকে বিবেচনা করছে। এটা শুধু জাতীয় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হচ্ছে না, বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করার লাইসেন্স কেনার কারেন্সি হিসেবেও কাজ করছে।

কূটনৈতিক মাধ্যমে অস্ত্র বিক্রি করা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই চর্চা হয়ে আসছে। ২০১০ সালে উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, বাইরের দেশগুলোতে থাকা আমেরিকান অ্যাম্বেসির কর্মকর্তারা বছরের পর বছর ধরে অস্ত্র নির্মাণকারী কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে আসছেন, যেন সেসব রাষ্ট্র আমেরিকান কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে পারে। আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা যখন কোনো মিত্র দেশে সমপর্যায়ের মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যেতেন, তখন দেখা যেত তাদের আলোচনার ফলাফল গিয়ে দাঁড়াত নতুন কোনো অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তিতে। এতে লকহিড মার্টিন কিংবা রেথিওনের মতো অস্ত্র নির্মাণকারী কোম্পানিগুলো লাভবান হতো।

পারমাণবিক বোমার আবির্ভাবের পর থেকে অন্য যেকোনো প্রযুক্তিগত উন্নয়নের চেয়ে সাইবার অস্ত্র আন্তর্জাতিক রাজনীতির সম্পর্কের ক্ষেত্রে গভীরভাবে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা গভীরভাবে অস্থিতিশীল করে তুলছে। সাইবার অস্ত্র তুলনামূলক সস্তা, সহজে বিলি করা যায় এবং একে এমনভাবে বিস্তৃত করা যায় যেন আক্রমণকারীকে কোনো কর্মফল ভোগ করতে না হয়। সাইবার অস্ত্রের বিস্তার আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কগুলোতে পরিবর্তন নিয়ে আসছে। ইসরায়েল অনেক আগেই এটা আবিষ্কার করতে পেরেছে। এখন অন্য রাষ্ট্রগুলোও উপলব্ধি করতে পারছে।

পারমাণবিক বোমার পর সাইবার অস্ত্র আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে; Image Source: Panda Security 

ইসরায়েলের জন্য অস্ত্র বাণিজ্য সবসময়ই দেশটির টিকে থাকার কেন্দ্রীয় অবলম্বন ছিল। এটা দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটা গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি ছিল, যা থেকে সামরিক গবেষণার পেছনেও ব্যয় করা যেত। কিন্তু একইসাথে এটা তাদের বৈরি প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে মিত্র জোট গঠনেও ভূমিকা রাখে। পঞ্চাশের দশকে দেশটি যখন তরুণ আর ক্ষমতাহীন ছিল, তখন তাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন ইসরায়েলকে ঘিরে রাখা প্রতিকূল আরব দেশগুলোর বাইরের দেশগুলোতে গোপন সংযোগ স্থাপন করেন। তিনি এই পন্থার নাম দেন ‘পেরিফেরি ডকট্রিন’। ইসরায়েলের সীমানার বাইরের কাজ করা তার গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে গোপন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে। এগুলোর বেশ কয়েকটি দেশ প্রকাশ্যে আরবদের পক্ষে ছিল। এসব দেশকে অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করার মাধ্যমে এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল।

ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন; Image Source: Wikimedia Commons

আশির দশকের মধ্যভাগে ইসরায়েল বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশগুলোর তালিকায় চলে আসে। দেশটির প্রতি দশ জনে এক জন কর্মী কোনো না কোনোভাবে অস্ত্র নির্মাণ শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। এর ফলে নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বনেতাদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠে ইসরায়েল। তারা নিজেদের অস্ত্র ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ইসরায়েলের সরবরাহ করা অস্ত্রগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছিলেন। বিনিময়ে এসব দেশগুলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ পরিষদ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ইসরায়েলকে সমর্থন দিত। তারা আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করার জন্য মোসাদ ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নিজ দেশে সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারেরও অনুমতি দেয়।

সামরিক পরিকল্পনাকারীদের কাছে ফাইটার জেটের চেয়ে সাইবার অস্ত্র বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠায় ইসরায়েলে এক ভিন্ন ধরনের ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠেছে। ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির সমতুল্য ইসরায়েলের ইউনিট ৮২০০-এর ঝানু কর্মীরা বেসরকারি খাতে মাল্টিবিলিয়ন ডলারের সাইবার সিকিউরিটি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেছে। প্রচলিত অস্ত্র বিক্রেতাদের মতো সাইবার অস্ত্র নির্মাণকারী কোম্পানিদেরও বিদেশে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এতে সরকার অস্ত্র নির্মাণকারী কোম্পানি ও কিছু ক্ষেত্রে ক্রেতা দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পায়। 

(পরবর্তী অংশ পর্ব ৩-এ)

Related Articles