Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অটো ওয়ার্মবিয়ার: উত্তর কোরিয়ায় গ্রেপ্তার এক দুর্ভাগা আমেরিকান । পর্ব ৩

(পর্ব ২-এর পর থেকে) 

৪.

২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি। ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজে যাওয়ার সময় রবার্ট কিং প্রত্যাশা করছিলেন আর দশটা দিনের মতোই বিরক্তিকর আরেকটি দিন অপেক্ষা করছে। ছুটির দিনগুলো জমে থাকা ইমেইলগুলো দেখতে দেখতেই দিন যাবে। কিন্তু গিয়ে দেখলেন বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। কিংয়ের মনে প্রথমেই চলে আসে, “ওহ না! আরেকজন আমেরিকান!

উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে সাত বছর কাজ করার সময় কিং এক ডজনেরও বেশি গ্রেপ্তার হওয়া আমেরিকানকে মুক্ত করে এনেছেন। তাই এখানে আসলে কী হতে চলছে, সেই সম্পর্কে তার ভালোই ধারণা ছিল। প্রথমেই অটোকে বাধ্য করা হবে উত্তর কোরিয়ার শাসকদের অবমূল্যায়নের দায় স্বীকার করতে। এরপর তার এই বক্তব্যের ভিডিও অভ্যন্তরীণ প্রোপাগান্ডা হিসাবে ব্যবহার করা হবে, যার মাধ্যমে উত্তর কোরীয় জনগণকে দেখানো হবে আমেরিকা তাদেরকে ধ্বংস করে দিতে যায়। এরপর অটোকে কারাদণ্ড দেওয়া হবে এবং তার মুক্তি পাওয়ার ব্যাপারটা আমেরিকার সাথে পরমাণু কর্মসূচি বা অবরোধ বিষয়ে দর কষাকষির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হবে।  

রবার্ট কিং; Image Source: AP

ওয়ার্মবিয়ার পরিবারের সাথে দেখা করার সময় কিং তাদেরকে সতর্ক করে বলেন, এই সমস্যার সমাধান হতে অনেক সময় লাগতে পারে। তিনি তাদেরকে শান্ত থাকতে বলেন যেন উত্তর কোরিয়ার আনপ্রেডিক্টেবল রেজিম বিপজ্জনক কিছু করে না ফেলে। তিনি তাদের খুব একটা ভরসা দিতে পারেননি। কারণ উত্তর কোরিয়ার অভ্যন্তরে আমেরিকার গোয়েন্দা কার্যক্রম খুব বেশি না থাকায় অটো আসলে ওই মুহূর্তে কোথায় ছিলেন বা তার কী হয়েছিল, সেই সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ হয়েও অবিলম্বে সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখানোতে ওয়ার্মবিয়ার পরিবার হতাশ হয়ে পড়েন।

কিন্তু পিয়ংইয়ং প্রসঙ্গে কিংয়ের তেমন কিছু করার ছিল না। এমনকি তিনি উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তাদের সাথে সরাসরি আলোচনাতেও যেতে পারছিলেন না। কারণ দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। দুই দেশের হয়ে মধ্যস্থতা করার কাজ করছিলেন সুইডিশ রাষ্ট্রদূত। কিংয়ের কাছে তখন সুইডিশদের ইমেইল আর ফোনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

তবে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের ব্যবস্থা বন্ধ থাকলেও অনানুষ্ঠানিক বা ‘ব্যাক চ্যানেল’ ঠিকই চালু ছিল। অটোর গ্রেপ্তারের পরপরই ওয়াইয়োর গভর্নর জন কাইসিচ ওয়ার্মবিয়ারদের সাথে বিল রিচার্ডসনের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন। বিল রিচার্ডসন ছিলেন নিউ মেক্সিকোর সাবেক গভর্নর। তিনি তখন জাতিসংঘের দূত হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি ‘ফ্রিঞ্জ ডিপ্লোম্যাসি’ নিয়ে কাজ করছিলেন, যেখানে শত্রুভাবাপন্ন শাসক বা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো থেকে জিম্মিদের উদ্ধারে কাজ করা হয়। রিচার্ডসন এর আগে উত্তর কোরিয়া থেকে কয়েকজন আমেরিকানকে উদ্ধারে কাজ করেছিলেন। তার সাথে ম্যানহাটনে থাকা জাতিসংঘের সদর দপ্তরে কাজ করা উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধি দলের সাথে ভালোই সম্পর্ক ছিল। এদেরকে প্রায়ই ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ংয়ের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এদের ডাকা হয় ‘নিউ ইয়র্ক চ্যানেল’।

বিল রিচার্ডসন; Image Source: Thet Htoo/Associated Press

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত রিচার্ডসন এবং তার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মিকি বার্গম্যান কয়েকবার ম্যানহাটনে ভ্রমণ করেন নিউ ইয়র্ক চ্যানেলের সাথে আলোচনা করার জন্য। জাতিসংঘের নিকটবর্তী রেস্টুরেন্ট, হোটেল লবি আর কফি শপগুলোতে উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধিদের সাথে তারা ভদ্রভাবে আপস-আলোচনা করতেন। কিন্তু অটোর দণ্ডাদেশ দেওয়ার কিছুদিন পরই রিচার্ডসন টের পান, এতদিনে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে কিম জং উনের ঘনিষ্ঠ একগুঁয়ে কর্মকর্তাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। রিচার্ডসনরা পরবর্তীতে অনুমান করেন, অটোর আঘাতের ঘটনা হয়তো তখনই ঘটেছিল। রিচার্ডসন বলেন,

তারা (প্রতিনিধিরা) আমাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, তারা শুধু আমাদের বক্তব্য পিয়ংইয়ংয়ে পাঠাতে পারবে। তারা নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।

প্রকৃত উত্তর পেতে হলে কাউকে না কাউকে পিয়ংইয়ংয়ে গিয়ে কথা বলতে হবে। তাই ওবামা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে রিচার্ডসন আর বার্গম্যান উত্তর কোরিয়ায় ভ্রমণ নিয়ে আলোচনা করেন। তারা উত্তর কোরিয়ার বন্যা দুর্গতদের সাহায্য করার বিনিময়ে অটোর মুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। রিচার্ডসন গেলে মিডিয়ায় বেশি আলোচনা হওয়ার আশংকায় সাবেক ইসরায়েলি প্যারাট্রুপার বার্গম্যানকে পাঠানো হয়।

সেপ্টেম্বরে বার্গম্যানের সাথে উত্তর কোরিয়ার উপরমহলের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা হয়, যা ছিল প্রায় দুই বছররের মধ্যে পিয়ংইয়ংয়ে আমেরিকা ও উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধিদের প্রথম মুখোমুখি আলোচনা। অন্যান্য দেশের সাথে কূটনৈতিক আলোচনাগুলো হয় ওক কাঠের টেবিলে বসে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারটা ছিল আলাদা। বার্গম্যানকে অটোর মতোই চার দিন ধরে ইউএসএস পুয়েবলো  থেকে রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত প্রায় একই জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে হয়। কিন্তু তিনি তার গাইডের সাথে কথা বলে জানতে পারেন, তার প্রস্তাবনাগুলো উপরের মহলে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বার্গম্যান সফরের শেষ দিনে যখন এক উপমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন, তখন ধরেই নিয়েছিলেন যে অটোকে মুক্ত করে আনতে পেরেছেন। কিন্তু বার্গম্যানকে জানানো হয়, মুক্ত করা তো দূরের কথা, অটোকে দেখতেই পারবেন না তিনি। বার্গম্যানকে তিনি বলেন, “একটা গাছকে উপড়ে ফেলতে ১০০ বার কুঠারের আঘাত করতে হয়।”

বার্গম্যান জানান, তিনি আশা করছেন তাকে পিয়ংইয়ংয়ে আরো ৯৯ বার আসতে হবে না।

বার্গম্যান ফিরে আসার সময় দেখে আসেন উত্তর কোরীয়রা অটোকে মুক্তি দেওয়ার বিভিন্ন উপায় বিবেচনা করছে। তবে এর আগে তারা ২০১৬ সালের নাটকীয়তায় ভরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের ফলাফল দেখতে চায়।

মিকি বার্গম্যান; Image Source: Concordia

যখন ট্রাম্প জিতে গেলেন, বার্গম্যান ও রিচার্ডসন এটাকে দেখলেন অটোকে মুক্ত করে আনার সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে। তারা রোনাল্ড রিগ্যানের অভিষেকের সময় ইরানের জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তারা চাইছিলেন ট্রাম্পের শপথ নেওয়ার আগেই অটোকে মুক্তির ব্যাপারে অগ্রীম আলোচনা করে রাখতে যাতে নতুন প্রেসিডেন্টের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়তে না হয়। উত্তর কোরিয়াও এ ব্যাপারে নেতিবাচক কিছু বলেনি, যাকে পূর্ব অভিজ্ঞতায় তারা ইতিবাচক ইঙ্গিত হিসাবেই ধরেছিলেন। বার্গম্যান বলেন,

সমস্যা হলো আমরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেখাই পাচ্ছিলাম না। আমরা গিউলিয়ানি (ট্রাম্পের আইনজীবী), পেন্স (ভাইস প্রেসিডেন্ট), ইভাঙ্কার (ট্রাম্পের মেয়ে) সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু ক্ষমতা পালাবদলের সময়ে কারো সাথেই দেখা করতে পারছিলাম না। আমার কাছে মনে হয়, তারা তখন অনেক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ছিল। আমার কাছে মনে হয় না প্রস্তাবনাটা কখনো ট্রাম্পের ডেস্কে পৌঁছেছে। কারণ আমি মনে করি তিনি প্রকৃতপক্ষে এই আইডিয়া পছন্দই করতেন।

৫.

নির্বাচনের পর রবার্ট কিং অবসরে চলে যান। তার জায়গা নেন উত্তর কোরিয়া নীতিমালায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বিশেষ প্রতিনিধি জোসেফ ইয়ুন। ইয়ুন যখন দায়িত্বে আসেন, পিয়ংইয়ং তখনো ওবামা প্রশাসনের সাথে আলোচনায় আগ্রহী ছিল না। কিন্তু ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানের পর তাদের ইস্পাতদৃঢ় সাবেক রাষ্ট্রদূত অটোর মুক্তির ব্যাপারে নিউ ইয়র্ক চ্যানেলের সাথে যোগাযোগ করেন। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তর কোরিয়ার এক প্রতিনিধিদলের যুক্তরাষ্ট্রে সফরের কথা ছিল। কিন্তু তখন কিম জং উন তার সৎ ভাইকে এক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটালে আমেরিকা এর নিন্দা জানায়। ফলে ওই সংলাপও বাতিল হয়ে যায়।

তবে এপ্রিলের দিকে সম্পর্কের বরফ গলতে থাকে। ইয়ুন তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনকে রাজি করাতে সক্ষম হন অটোর ব্যাপারে উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তাদের সাথে মুখোমুখি আলোচনা করতে। ইয়ুন তখন নরওয়েতে গিয়ে উত্তর কোরিয়ার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করেন। সেখানে তারা সাবেক কূটনীতিকদের সাথে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে গোপন বৈঠক করেন। এর পাশাপাশি অটোর ব্যাপারে আলোচনা হয়। ইয়ুন ও উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধিরা একমত হন, সুইডিশ রাষ্ট্রদূত উত্তর কোরিয়ায় বন্দী থাকা অটো ও আরো তিনজন আমেরিকানের সাথে দেখা করতে পারবেন। শেষপর্যন্ত কেবল একজন বন্দীর সাথেই দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়, কিন্তু সেটা অটো ছিলেন না।

জোসেফ ইয়ুন; Image Source: Beyond Parallel- CSIS

ইয়ুন অটোর খোঁজ দেওয়ার দাবি চলমান রাখেন। জুনের শুরুর দিকে একদিন ইয়ুন একটা ফোন পেয়ে অবাক হয়ে যান। তাকে অনুরোধ জানানো হয় জরুরি ভিত্তিতে নিউ ইয়র্ক চ্যানেলের সাথে যোগাযোগ করতে। ম্যানহাটনে উত্তর কোরীয়রা তাকে জানান, অটো অচেতন হয়ে পড়ে আছেন। ইয়ুন তখন বিস্মিত হয়ে যান। তিনি জানান, অটোকে শীঘ্রই পিয়ংইয়ংয়ের মুক্তি দিতে হবে। তিনি বলেন,

আমি তখন অবিলম্বে ফিরে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনের সাথে কথা বলি। আমরা তখন সংকল্পবদ্ধ হয়ে যাই যে, অটো ও অন্যান্য বন্দীদের যত দ্রুত সম্ভব মুক্ত করে আনতে হবে, এবং পিয়ংইয়ংয়ের সাথে আমার দ্রুত যোগাযোগ করতে হবে।  

ট্রাম্প যখন অটোর অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারেন, তিনি ইয়ুনকে নির্দেশ দেন পিয়ংইয়ংয়ের ওপর আরো দ্বিগুণ চাপ দিতে এবং অটোকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে। উত্তর কোরিয়াকে জানানো হয় একটা আমেরিকান বিমান দ্রুত পিয়ংইয়ংয়ে অবতরণ করবে এবং এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক আর চিকিৎসকরা আসবেন। অটোকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কাজ করা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান,

প্রেসিডেন্ট অটোকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে খুবই সক্রিয় ছিলেন। তার কথা শুনে আমার কাছে মনে হয়েছিল, অটোর ব্যাপারে তার মাঝে অনেকটা পিতৃস্নেহের ছোঁয়া দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু আমরা খুবই ভীত ছিলাম।

উত্তর কোরিয়া জানিয়েছিল, তারা আমেরিকান বিমান অবতরণ করতে দেবে। কিন্তু আমেরিকানরা সেখানে নেমে কেমন প্রতিক্রিয়া পাবে, সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত ছিল না। ইয়ুন ব্যাখ্যা করেন, উত্তর কোরীয়রা জানিয়েছিল- আমেরিকা সেখানে একটা প্রতিনিধি দল পাঠাতে পারবে অটোকে দেখার জন্য। কিন্তু তাকে মুক্ত করে আনার ব্যাপারে কিছু শর্ত নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ইয়ুন তখন অটোকে রক্ষার জন্য এক কূটনৈতিক ও মেডিকেল টিম তৈরি করেন।

Related Articles