সাইবার অস্ত্র নিয়ে বিশ্বনেতাদের লড়াই | পর্ব ৪

(পর্ব ৩-এর পর থেকে) 

পানামার কাছে আমেরিকানদের গোয়েন্দা তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছা থাকা এনএসও ও ইসরায়েলের জন্য আরো সুযোগ সৃষ্টি করে। উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের আগস্টে পানামার সদ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া রিকার্ডো মার্টিনেলি আমেরিকান কূটনীতিকদের অনুরোধ করেছিলেন তাকে যেন নজরদারি করার প্রযুক্তি দেওয়া হয়। তিনি চাইছিলেন দেশটির নিরাপত্তার জন্য হুমকি ব্যক্তি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ওপর নজরদারি করতে। সেখানে মিশনে থাকা ডেপুটি চিফ উত্তর দেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নজরদারি করার ব্যাপারে জড়িত হতে চায় না।

মার্টিনেলি তখন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। ২০০৮-০৯ এ গাজাতে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে গোল্ডস্টোন কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ২০১০ সালের শুরুর দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক এজেন্ডা হিসেবে একে রাখার ব্যাপারে ভোটাভুটি হয়। সেখানে মাত্র ছয়টি দেশ ইসরায়েলকে সমর্থন করে এজেন্ডার বিরুদ্ধে ভোট দেয়। এই ছয়টি দেশের একটি ছিল পানামা।

ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাথে ২০১৪ সালের একটি ছবিতে পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট রিকার্ডো মার্টিনেলি; Image Source: Kobi Gideon/GPO/Flash90

ভোটের এক সপ্তাহ পর মার্টিনেলি ইসরায়েল সফর করেন, যা ছিল ল্যাটিন আমেরিকার বাইরে তার প্রথম সফর। তিনি তখন ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজকে বলেন, পানামা সবসময়ই ইসরায়েলের পাশে থাকবে। তিনি আরো বলেন, তিনি ও তার সাথে থাকা মন্ত্রীবর্গ, ব্যবসায়ী আর ইহুদি নেতারা ইসরায়েলের কাছ থেকে শেখার জন্য এসেছেন। তিনি বলেন, “আমরা অনেক দূর থেকে আসলেও পানামার ইহুদি সম্প্রীতি আমাদের দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে।”

পর্দার আড়ালে মার্টিনেলি তার এই সফরকে ব্যবহার করছিলেন নজরদারি পণ্য কেনা নিয়ে দর কষাকষিতে। নেতানিয়াহুর সাথে একান্ত বৈঠকে তারা দুজন আলোচনা করেন ইসরায়েলি কোম্পানিদের কাছ থেকে সামরিক ও গোয়েন্দা যন্ত্রপাতি কেনার ব্যাপারে। ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকা এক ব্যক্তি জানান, মার্টিনেলি বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন ব্ল্যাকবেরির বিবিএম টেক্সট সার্ভিস হ্যাক করা প্রযুক্তির ব্যাপারে। এটা ওই সময় পানামায় খুব জনপ্রিয় ছিল।

দুই বছরের মধ্যেই ইসরায়েল পানামাকে সবচেয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিক্রির প্রস্তাব দিতে সক্ষম হয়। ২০১২ সালে পানামা সিটিতে এনএসওর প্রযুক্তি স্থাপনের পর মার্টিনেলি সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলের সমর্থনে বিভিন্ন সময় ভোট দিয়ে এসেছে।

পানামার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বিশ্লেষক ইসমায়েল পিত্তির এক হলফনামা অনুযায়ী পেগাসাসের প্রযুক্তির মাধ্যমে পানামীয় ও অ-পানামীয় ব্যক্তিদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হয়েছে কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া। এদের মধ্যে ছিলেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ম্যাজিস্ট্রেট, ইউনিয়ন নেতারা ও ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিরা। প্রসিকিউটররা পরবর্তীতে বলেন, মার্টিনেলি পেগাসাস পরিচালনা করা টিমকে তার মিস্ট্রেসের ফোন হ্যাক করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে মার্টিনেলির জায়গায় ক্ষমতায় আসেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জোয়ান কার্লোস ভারেলা, যিনি নিজেও দাবি করেন মার্টিনেলির গুপ্তচরবৃত্তির শিকার হয়েছিলেন। মার্টিনেলির অধীনস্থ কর্মীরা তখন নজরদারি করার যন্ত্রগুলো ভেঙে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। সাবেক প্রেসিডেন্ট তখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। গত নভেম্বরে তিনি পানামার আদালত থেকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ থেকে খালাস পান।

পেগাসাসের অন্যতম সফলতা ছিল ব্ল্যাকবেরির মেসেজিং সার্ভিস হ্যাক করতে পারা; Image Source: Business Insider

এনএসওর বিক্রির পরিমাণ প্রতিবছরই দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বিনিয়োগকারীদেরও ভালো নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে কোম্পানিটি। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বৈশ্বিক বিনিয়োগকারী কোম্পানি ফ্রান্সিসকো পার্টনারস ১৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে এনএসওর ৭০ ভাগ মালিকানা কিনে নেয়। এরপর এর সাথে যুক্ত করে আরেক ইসরায়েলি সাইবার অস্ত্র নির্মাণকারী কোম্পানি সার্কেলসকে। সার্কেলসের উদ্যোক্তা এক সাবেক আমান (AMAN) কর্মকর্তা। সার্কেলসের পক্ষ থেকে ক্রেতাদের কাছে ডিভাইসগুলোর একটা দুর্বলতার সন্ধান দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো ফোনের অবস্থান জানা সম্ভব হয়। ইসরায়েলি গোয়েন্দারা এর ১০ বছর আগেই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছিলেন। দুই কোম্পানি একত্রিত হওয়ায় ক্রেতাদের আরো বেশি সেবা দিতে সক্ষম হয়েছে। 

বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তার স্ত্রীর সাথে পোল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিয়েতা জিদলো; Image Source: GPO

পেগাসাসের ধারাবাহিক চুক্তিগুলোর ফলে বিশ্ব জুড়ে নতুন প্রজন্মের ডানপন্থী নেতাদের উদ্ভব ঘটেছে। ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তার স্ত্রী সারা নেতানিয়াহু তাদের বাসভবনে পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বিয়েতা জিদলো ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াইটোল্ড ওয়াসজকোয়স্কিকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানান। এর কিছুদিন পরই পোল্যান্ডের কেন্দ্রীয় দুর্নীতি দমন ব্যুরোর জন্য পেগাসাসের সফটওয়্যার ক্রয়ের ব্যাপারে পোল্যান্ড ও এনএসওর এক চুক্তি হয়।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত সিটিজেন ল্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী পোলিশ সরকার বিরোধী অন্তত তিন জনের ফোন এই স্পাই মেশিনের আক্রমণের শিকার হয়। পোলিশ সরকার একটা আইন পাশ করে যেটাকে ইহুদি সম্প্রদায় ও ইসরায়েল হলোকাস্ট অস্বীকার করা হিসেবে দেখে। কিন্তু তখন বিতর্কের ঝড় উঠলেও নেতানিয়াহু পোল্যান্ডে পেগাসাস সিস্টেমের কার্যক্রম বন্ধ করেননি।

২০১৭ সালের জুলাইয়ে নরেন্দ্র মোদি প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরায়েল সফর করেন। তিনি আবার নির্বাচনে জিতে আসছেন হিন্দু জাতীয়তাবাদকে অবলম্বন করে। এর আগের দশকগুলোতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ছিল ফিলিস্তিনের পক্ষে। ইসরায়েলের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল হিমশীতল। মোদির ইসরায়েল সফরটা ছিল লক্ষনীয়ভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ। তারা খালি পায়ে স্থানীয় এক সমুদ্র সৈকতে একত্রে হাঁটাহাঁটিও করেন। অবশ্যই সেটা ছিল পুরোটাই সাজানো।

সমুদ্র সৈকতে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও নরেন্দ্র মোদি; Image Source: Times of Israel

তাদের এমন ফুরফুরে মেজাজে থাকার কারণও ছিল। দুই দেশের মধ্যে প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অত্যাধুনিক অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি হয়। এর কেন্দ্রে ছিল পেগাসাস ও একটা মিসাইল সিস্টেম। কয়েক মাস পর নেতানিয়াহু ভারত সফরে আসেন। ২০১৯ সালে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে এক ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংস্থার পর্যবেক্ষক মর্যাদা পাওয়ার ব্যাপারে ভারত ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ওই সংস্থার বিপক্ষে ভোট দেয়। ভারত এই প্রথম ইসরায়েলের পক্ষে ভোট দেয় জাতিসংঘে।

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে দমনমূলক কর্মকাণ্ড চালালেও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেগাসাস বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। ওরবান হ্যাকিং প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারির ব্যবস্থা করেছেন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ওপর, সমাজকর্মীদের ওপর, যেসব সাংবাদিক তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান প্রতিবেদন করেছেন তাদের ওপর এবং তার সাবেক ব্যবসায়িক পার্টনারদের পরিবারের ওপর যারা এখন শত্রুতে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে ওরবান ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইসরায়েলের নিবেদিত সমর্থক ছিলেন।

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান ও বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু; Image Source: Debbie Hill/Pool Photo via Associated Press

২০২০ সালে যখন ইসরায়েলের দ্বারা ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর দখল করা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে, তখন হাঙ্গেরি ছিল অল্প কয়েকটা দেশের একটা যারা এটা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি। সে বছরের মে মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সর্বসম্মতি জ্ঞাপন করেন ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে। তারা গাজায় ত্রাণ সরবরাহের উদ্যোগও নেন। হাঙ্গেরি এক্ষেত্রে অন্য ২৬টি দেশের সাথে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানায়।     

(পরবর্তী অংশ পর্ব ৫-এ) 

Related Articles

Exit mobile version