আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন কিছু দিন থাকে, যে দিনগুলো আমাদের গোটা জীবনের গতিপথই বদলে দেয়, আর আমরা বাকি জীবনভর সেই দিনগুলোর কথা মনে রাখি। ট্যাবাথা বুন্ডেসেনের জীবনে সেরকম একটি দিন হলো ২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, যেদিন তার খুব কাছের দুজন ‘ব্যক্তি’র হাত ধরে তার ২৯ বছরের জীবনে ঘটে গিয়েছিল এক অভাবনীয় পরিবর্তন। সেই দুই ব্যক্তির একজন হলেন তার ভাই ব্রায়ান, অন্যজন তার পোষা বিড়াল টারডার সস।
সে সময় রেড লবস্টারে ওয়েট্রেসের কাজ করতেন ট্যাবাথা। তো একদিন অ্যারিজোনায় তার বাড়িতে বেড়াতে আসলেন ভাই ব্রায়ান। তখন উঠানে খেলছিল টারডার। টারডারের মধ্যে এক আজব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলেন ব্রায়ান। বিড়ালটির মুখ গোমড়া, মনে হয় যেন কোনো কারণে ক্রুদ্ধ ও রাগান্বিত হয়ে আছে সে। বিষয়টিতে চমৎকৃত হলেন ব্রায়ান। কেননা মানুষ যেমন তাদের মৌখিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে মনের বিভিন্ন অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারে, অন্যান্য জীবজন্তুর পক্ষে তো তা সম্ভব না। তাহলে এই বিড়ালটি কীভাবে এমন মুখ গোমড়া করে আছে!
ব্রায়ান ঠিক করলেন, টারডারের ছবি ইন্টারনেটে আপলোড করবেন। তাই সেটির গোমড়া মুখের ছবি তুললেন তিনি, এবং ছেড়ে দিলেন রেডিটে। এরপর যা ঘটল, তা বোধহয় ট্যাবাথা বা ব্রায়ান ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেননি। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে আজব মুখভঙ্গির টারডারের ছবি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠল। সেটির বিভিন্ন ফটোশপ করা সংস্করণ অনলাইন দুনিয়ায় ভেসে বেড়াতে থাকল, একের পর এক মিম তৈরি হতে লাগল। অপরদিকে মাত্র ৪৮ ঘন্টার মাঝেই ছবিটির ইমেজার পেজের ভিউ সংখ্যা ১০,৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেল।
এদিকে বুন্ডেসেন পরিবার ওই একই দিনে টারডারের বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপ ইউটিউবে আপলোড করলেন। সেগুলোও মিলিয়ন ভিউ পেলো। এ প্রসঙ্গে বুন্ডেসেনদের ভাষ্য, “অনেকেই মনে করেছিল আসল ছবিটি নাকি ফটোশপ করা। তাই আমরা ইউটিউবে কিছু ভিডিও আপলোড করেছিলাম।”
এভাবেই যখন ইন্টারনেটবাসীরা জানতে পারল যে গোমড়ামুখো বিড়ালটির ছবি ফটোশপ করা নয়, বরং বাস্তবিকই এমন একটি বিড়ালের অস্তিত্ব রয়েছে, তখন তারা সেটির একটি নতুন নামও ঠিক করে ফেলল। আর টারডার সস বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয়ে উঠল গ্রাম্পি ক্যাট নামে। এই নামটি জনপ্রিয় করার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রাখল বাজফিড ও সিএনবিসির মতো গণমাধ্যমগুলো।
এখন প্রশ্ন হলো, টারডার সস কিংবা গ্রাম্পি ক্যাট এমন গোমড়ামুখো ছিল কীভাবে? মূলত বিড়ালটি ফিলাইন ডোয়ার্ফিজম বা বিড়ালদের বামনত্ব রোগে আক্রান্ত ছিল। মনে করা হয়ে থাকে, সম্ভবত এই রোগের প্রভাবেই সে অমন গোমড়ামুখো হয়ে গিয়েছিল, আর আকৃতিতেও সে বেশ ছোটখাট ছিল।
তবে মূল কারণ যা-ই হোক না কেন, যেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো গ্রাম্পি ক্যাটের আকাশচুম্বি খ্যাতি। সে যেভাবে খ্যাতির চূড়ায় আরোহণ করে, তা এমনকি মানুষের জন্যও চরম ঈর্ষণীয় একটি ব্যাপার। ইন্টারনেট জগতে সবার প্রিয় পোষ্য জীবে পরিণত হয় সে। ইনস্টাগ্রামে ২.৪ মিলিয়ন আর টুইটারে ১.৪ মিলিয়ন ফলোয়ারও জুটে যায় তার।
গ্রাম্পি ক্যাটকে নিয়ে মানুষের মধ্যে উন্মাদনা এতটাই বেড়ে যায় যে, তা সামাল দিতে গিয়ে চাকরি ছাড়তে হয় তার মালকিন ট্যাবাথাকে। গণমাধ্যমে গ্রাম্পি ক্যাট প্রথম মুখ দেখানোর কয়েকদিনের মাথায়ই ওয়েট্রেসের চাকরিকে বিদায় বলে ট্যাবাথা শুরু করেন ‘গ্রাম্পি ক্যাট লিমিটেড’, যেটির কাজ ছিল গ্রাম্পির সকল ভবিষ্যৎ অ্যাপয়েন্টমেন্টের দেখভাল করা এবং গ্রাম্পির পক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার ব্যাপারে চুক্তি করা।
দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তারকাখ্যাতি লাভের পর মাত্র দুই বছরেই গ্রাম্পি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদান, বইয়ের চুক্তি এবং মডেলিংয়ের বিনিময়ে ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় করে ফেলে। ২০১৪ সালে লাইফটাইমে ‘গ্রাম্পি ক্যাট’স ওর্স্ট ক্রিসমাস এভার’ নামের একটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করে সে। এছাড়া নিজের নাম ও ছবি সম্বলিত মার্চেন্ডাইজ থেকেও মিলিয়ন ডলার আয় ছিল তার।
২০১৮ সালে গ্রাম্পি নতুন করে শিরোনাম হয় গ্রেনেড বেভারেজের সাথে আইনি লড়াইয়ে জড়ানোর মাধ্যমে। গ্রেনেড বাজারে তাদের নতুন বেভারেজ গ্রাম্পি ক্যাট গ্রাম্পুচিনোর বোতলে বিনা অনুমতিতে গ্রাম্পির ছবি ব্যবহার করলে, গ্রাম্পি ক্যাট লিমিটেড আদালতে যায়, এবং সেই মামলা থেকে ৭,১০,০০১ ডলার ক্ষতিপূরণ পায় তারা।
২০১৫ সালে নতুন এক ইতিহাসও গড়েছিল গ্রাম্পি। মাদাম তুসো জাদুঘরে প্রথম বিড়াল হিসেবে তার মোমের মূর্তি উন্মোচন করা হয়েছিল সে বছর। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল তাকে নিয়ে প্রতিবেদন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রথম পাতায়ও জায়গা হয়েছিল তার। এমনকি ফোর্বস ম্যাগাজিনের অফিস থেকেও ঘুরে এসেছিল সে।
সব মিলিয়ে ঘটনাবহুল ও সাফল্যমন্ডিত এক জীবনই ছিল গ্রাম্পির। দিনে ঘন্টাদুয়েক কাজ করত সে। বাকি সময় খাওয়া, ঘুম আর খেলাধুলা। সপ্তাহে একবার থাকত ফটোসেশনের শিডিউল। বিড়ালের খাদ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি ফ্রিস্কিসের অফিশিয়াল ‘স্পোকসক্যাট’ ছিল সে। প্রায়ই তাকে দেখা যেত টুডে, গুড মর্নিং আমেরিকার মতো টেলিভিশন শোতে। আর এসবের বাইরে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেজগুলোতেও তো তার ছিল সার্বক্ষণিক বিচরণ।
তবে টুইটার বা ইনস্টাগ্রামে আর নতুন কোনো ছবি দেখা যাবে না গ্রাম্পির। কোনো পণ্যের মডেল হতে, টক শোর অতিথি হতে, কিংবা চলচ্চিত্রের অভিনেতা হিসেবেও দেখা মিলবে না তার। কারণ খুব অল্প বয়সেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে সে। গত শুক্রবার (১৭ মে) গ্রাম্পির টুইটার অ্যাকাউন্টে এসেছে তার মৃত্যুর মর্মান্তিক সংবাদ। সেখানে জানানো হয়েছে, ১৪ মে মৃত্যুবরণ করেছে গ্রাম্পি। এ বছর ৪ এপ্রিল ৭ বছর পূর্ণ হয়েছিল তার।
বিড়ালদের জন্যও ৭ বছর বয়স খুব বেশি নয়। তা মানুষের ৪৫ বছরের সমতুল্য। তাহলে হঠাৎ করে কেন জীবনাবসান ঘটল গ্রাম্পির? শীর্ষস্থানীয় পশু চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে ছিল সে। আদর-যত্নেরও কমতি ছিল না তার নিজের পরিবারে। তারপরও সাম্প্রতিক এক ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ধকল সহ্য করতে পারেনি তার ছোট্ট শরীর। ফলে অকালেই বিদায় নিতে হয়েছে তাকে। অবশ্য তার মালকিন ট্যাবাথা জানিয়েছেন, শান্তিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পেরেছে সে।
জানিয়ে রাখা ভালো, গ্রাম্পির একটি ভাইও ছিল পোকি নামে। সে অবশ্য গ্রাম্পির মতো গোমড়ামুখো ছিল না। আর দশটা সাধারণ বিড়ালের মতোই ছিল তার চেহারা। তাই তাকে নিয়ে কখনোই গণমাধ্যমে মাতামাতি হয়নি। তবে এখনো সে বেঁচে আছে কি না, তা নিশ্চিত নয়। যদি সে বেঁচেও থাকে, গ্রাম্পির রেখে যাওয়া অঢেল সম্পদ যে সে পাবে না, সে কথা বলাই বাহুল্য। গ্রাম্পির আয়কৃত যাবতীয় সম্পদের মালিকানা যে তার মালকিন ট্যাবাথারই।
গ্রাম্পির মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। “একবারই আমি মজা করেছিলাম, সেটা জঘন্য ছিল”, “পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে, দুই দলকেই আমি অপছন্দ করি” ইত্যাদি সাড়া জাগানো মিম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে গ্রাম্পির ছবি। ফলে মিমপ্রেমীদের কাছে আলাদা একটি আবেদন রয়েছে তার। তার এই আকস্মিক মৃত্যু তাই মিমারদেরকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে। তারা কিছুতেই মানতে পারছে না যে গ্রাম্পি আর নেই।
নিজে গোমড়ামুখো হয়েও এতদিন বিশ্বের অগণিত মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে এসেছে গ্রাম্পি। প্রথমবারের মতো সে তার ভক্ত-অনুরাগীদের মুখে হাসি ফোটানোর বদলে তাদের মন খারাপের কারণে পরিণত হলো। তবে একটি বিড়ালের মৃত্যুতে যে বিশ্বব্যাপী এত এত মানুষ শোক পালন করবে, তা কে-ই বা ভাবতে পেরেছিল। সুতরাং গ্রাম্পির বিড়ালজীবন যে সার্থক, সে ব্যাপারে আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না। ইতিহাসের পাতায় সে অমর হয়ে থাকবে সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সম্পদশালী পোষ্য জীবগুলোর একটি হিসেবে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/