ছোটবেলায় পুকুর-নদীতে সাঁতার কেটেছেন এমন অনেকেই আছেন। ডুব দিয়ে কে কত গভীরে এবং কতক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে রাখতে পারা যায়- এমন চ্যালেঞ্জিং প্রতিযোগিতাও অনেকে করেছেন। পানির নিচের রোমাঞ্চকর দুনিয়া সম্পর্কে মানুষ সেই আদিকাল থেকেই জানতে চেয়েছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ ধীরে ধীরে নিজের সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে আবিষ্কার করছে সাগরের গভীরের রহস্য। বর্তমানে সমুদ্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যটক সংশ্লিষ্ট স্থানে স্কুবা ডাইভিং তথা পানির নিচে সাঁতার কাটার ব্যবস্থা করে হয়েছে। বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও স্কুবা ডাইভিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্কুবা ডাইভিং পানির নিচে ডাইভ করাকে বোঝানো হয়, যেখানে স্কুবা ডাইভার Self-contained underwater breathing apparatus (SCUBA) ব্যবহার করেন শ্বাস নেওয়ার জন্য। ডাইভিংয়ের অন্য পদ্ধতিগুলো হলো শ্বাস বন্ধ করে ধরে রাখা অথবা নলের সাহায্যে স্থলভাগ থেকে অক্সিজেন নেওয়া (একে স্নরকেলিং বলে)। কিন্তু স্কুবা ডাইভিং একেবারে ভিন্ন, এখানে ডাইভার নিজের সঙ্গে শ্বাস নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস এবং বিশুদ্ধ বাতাস রাখে। ফলে সে ইচ্ছামতো সাগরের নিচে ভেসে বেড়াতে পারে। এই স্বাধীনতার জন্যই স্কুবা জনপ্রিয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- মানুষের পক্ষে পানির সর্বোচ্চ কত গভীরে যাওয়া সক্ষম? দুভাবে পানির নিচে যাওয়া সম্ভব- মানুষ নিজে সরাসরি যাবে অথবা সাবমেরিনের ভেতরে করে যাবে।
প্রথমে সরাসরি মানুষের যাওয়া নিয়ে কথা বলা যাক।
আমরা জানি, পানির যতই নিচে যাওয়া যাবে ততই চাপের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। মানবদেহ যে পরিমাণ চাপ সহ্য করতে সক্ষম তার ১০ ভাগের ১ ভাগ চাপ সহ্য করতে পারে আমাদের
কানের পর্দা, অক্ষি গোলক ও সাইনাসের মতো স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো। তাই একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কোনোপ্রকার গিয়ার ছাড়া শুধু অক্সিজেন ট্যাংক নিয়ে বা ছাড়াই একবারে ২০ ফুট এবং সর্বোচ্চ ১৩০ ফুট পানির নিচে যেতে সক্ষম। গিনেজ বুকের রেকর্ড অনুযায়ী মিশরের স্কুবা ডাইভিং ইন্সট্রাক্টর আহমেদ গাব্র কোনো প্রকার প্রেশার নিউট্রিলাইজার স্যুট ছাড়া ১,০৯০ ফুট পানির নিচে গিয়েছিলেন। এজন্য তার সময় লেগেছিল ১২ মিনিট। তবে তিনি উপরে উঠে আসতে Decompression stop হিসেবে ১৪ ঘন্টা সময় ব্যয় করেন। এজন্য সব মিলিয়ে ৯টি অক্সিজেন সিলিন্ডার তিনি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এটাই কোনো প্রকার প্রেশার নিউট্রিলাইজার স্যুট ছাড়া সর্বোচ্চ গভীরে ডাইভ দেয়ার রেকর্ড। এর আগের রেকর্ডটি ১০৪৪ ফুটের।
‘ডিকমপ্রেশন স্টপ’ কী? যদি হাই স্কুলে বিজ্ঞান ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে না থাকেন, তবে আপনি জানেন- বায়ুমন্ডলে আমরা যে বাতাস গ্রহণ করি সেই বাতাসের প্রায় ৭৮%-ই নাইট্রোজেন। বাকি প্রায় ২১% অক্সিজেন, এবং বাকিটা হিলিয়াম, নিয়নসহ অন্যান্য গ্যাস। এই বিপুল পরিমাণ নাইট্রোজেন আমরা গ্রহণ করি ঠিকই, কিন্তু ব্যবহার করি না। আমাদের ফুসফুস শুধুমাত্র অক্সিজেনকে আলাদা করে রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে মিশিয়ে দেয়। কিন্তু এই বেশি মাত্রায় নাইট্রোজেন সংযুক্তি ফুসফুসের এলভিওলাই কোষকে অক্সিজেন সংশ্লেষণ করতে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে।
বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন নিয়ে অভ্যস্ত প্রাণী মানুষ যখন পানির নিচে যায় তখন যে সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয় সেটাতেও নাইট্রোজেন মেশানো হয়। একে Nitrox সিলিন্ডার বলে।সাধারণত একটি Nitrox সিলিন্ডারের ২২%-৪০% গ্যাস অক্সিজেন, বাকিটা নাইট্রোজেন হয়। এ ধরনের সিলিন্ডারে উপরে সাদা-কালো ব্যান্ড থাকে। মেডিকেল অক্সিজেন সিলিন্ডার শুধুই লিকুইড হাই প্রেশারাইজ অক্সিজেন বহন করে এবং এই সিলিন্ডারের রং সাদা। যদি সিলিন্ডারে অক্সিজেন ও হিলিয়াম
থাকে তবে তাকে Heliox মিক্সচার বলে। এই সিলিন্ডারে সাদা+বাদামি ব্যান্ড থাকে। আরেকপ্রকার সিলিন্ডার আছে যাতে Trimix অর্থাৎ অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হিলিয়াম গ্যাস মিক্সচার থাকে। এই সিলিন্ডারে সাদা+বাদামি+কালো রঙের ব্যান্ড থাকে। পানির খুব গভীরে ডাইভ দিতে হলে এসব সিলিন্ডার দরকার হয়।
ডিকমপ্রেশন স্টপ জানার আগে জানতে হবে Narcosis ইফেক্ট সম্পর্কে।
পানির উপরে স্বাভাবিক তাপ ও চাপে আমরা গ্রহণ করি। কিন্তু যতই পানির নিচে যাবেন ততই আপনার শরীরের উপর পানির প্রচন্ড চাপ পড়বে। আবার আপনারা জানেন, সিলিন্ডারে প্রচন্ড চাপ দিয়ে গ্যাসকে তরল করে ঢোকানো হয়। এই গ্যাস বের হওয়ার সময়ও প্রচন্ড চাপ দেয়। এই চাপ গ্যাস ভাল্ভ এবং রেগুলেটর দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তারপরও আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চাপের অক্সিজেন গ্রহণ করি পানির নিচে। সাধারণভাবে বলতে গেলে- চাপের এই দুই বিপরীত অবস্থার কারণে সৃষ্টি হয় Narcosis ইফেক্ট। এখানে আসলে একপ্রকার আচ্ছন্নতার সৃষ্টি হয়। অনেকে সামান্য সময়ের জন্য সংজ্ঞাহীন হয়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত অক্সিজেন গ্রহণ এবং তা ঠিকমতো ব্যবহার না হওয়া, কার্বন ডাইঅক্সাইড ঠিকমতো নিষ্কাশন না হওয়া, কার্বন মনোক্সাইড গ্রহণ করে ফেলা, নাইট্রোজেন বুদবুদ তৈরি হওয়া ইত্যাদি কারণে Narcosis ইফেক্ট হয়।
পানির নিচে যাওয়ার সময় ধীরে ধীরে আপনার শরীরে চাপ বাড়তে থাকে। রসায়ন ক্লাসে ফাঁকি না দিয়ে থাকলে আপনি জানেন, বয়েলের সূত্রানুযায়ী চাপ বাড়লে গ্যাসের আয়তন কমে। যখন আপনি পানির নিচে যাবেন তখন চাপ বাড়বে এবং আপনার শরীরের ভেতর প্রবেশ করা গ্যাসসমূহের আয়তন কমবে।আবার যখন পানির নিচ থেকে আপনি উপরে উঠতে থাকবেন তখন ধীরে ধীরে পানির চাপ কমবে এবং গ্যাসের আয়তন বাড়বে। তখন রক্তের মধ্যে নাইট্রোজেনের বুদবুদ বা বাবল তৈরি হবে। এই বাবল/বুদবুদ যত বড় হবে, ততই আপনার পাতলা রক্তনালীর উপর চাপ পড়বে এবং একে যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তবে আপনি কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার রক্তনালী ফেটে যাবে!
শরীরের যেকোনো স্থানের রক্তনালী ফেটে যেতে পারে। এতে করে পানির চাপ বেশি থাকায় এবং আপনার রক্তের চাপ তার চেয়ে কম থাকায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেহের সমস্ত রক্ত বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব। রক্তের ঘ্রাণ পেয়ে হাজির হওয়া হাঙরের পেটে যাওয়া তখন কোনো ব্যাপারই না। এছাড়া উক্ত বাবল/বুদবুদ যদি আপনার হৃৎপিন্ডে বা মস্তিষ্কের/কিডনির সূক্ষ রক্তনালিতে যায়, তবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা যাবেন। এজন্য নিচ থেকে উপরে ওঠার সময় কিছু দূর পর পর (প্রায় ২০-৩০ ফুট) কমপক্ষে ৩-৫ মিনিট বিশ্রাম নিতে হয়। একেই ডিকমপ্রেশন স্টপ বলে। এই বিশ্রামের ফলে আপনি একই চাপযুক্ত এলাকায় কিছুক্ষণ অবস্থান করবেন, ফলে ধীরে ধীরে উৎপন্ন বাবলের আয়তন কমবে। যত নিচ থেকে উপরে উঠবেন তত বেশি সময় বিশ্রাম নিতে হয়ে। এজন্য ১০৯০ ফুট নিচ থেকে ওঠার সময় স্কুবা ডাইভার আহমেদ গাব্রকে ১৪ ঘন্টা ডিকম্প্রেশন স্টপ দিতে হয়েছিলো।
এই ডিকম্প্রেশন স্টপ টাইম কমানোর জন্য খুব গভীর সমুদ্রে ডাইভিংয়ের ক্ষেত্রে Trimix/Heliox গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়। আমরা জানি, হিলিয়াম সবচেয়ে হালকা গ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় সময় আমরা হিলিয়ামভর্তি বেলুন কিনে থাকি, যা বাচ্চাদের কাছে গ্যাস বেলুন নামে পরিচিত। এছাড়া নাইট্রোজেন পিল নামে ওষুধ খেতে হয় যা বাবলের আয়তন দ্রুত কমাতে সাহায্য করে। আবার Heliox মিক্সচারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে। এটি হ্যালুসিনেশন এবং টানেল ভিশনের মতো Narcosis ইফেক্ট সৃষ্টি করে। মূলত অক্সিজেন টক্সিসিটি ঠেকানোর জন্য নাইট্রোজেন মিক্সচার ব্যবহার করা হয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, পানির নিচের অনেক বিপদ, যেমন- হাঙরের আক্রমণ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও অনেক সময় ডিকম্প্রেশন স্টপের কারণে পালানো সম্ভব না।
বিভিন্ন নৌবাহিনীতে ডুবুরীদের পানির চাপে অভ্যস্ত করার জন্য এবং ডিকম্প্রেশন স্টপসহ অন্যান্য বিষয় শেখানোর জন্য ডিকম্প্রেশন চেম্বার ব্যবহার করা হয়। সেখানে বাতাসের চাপ বাড়িয়ে-কমিয়ে পানির নিচের অনুরূপ চাপ সৃষ্টি করা হয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ডুবুরীদের কাজ কতটা কঠিন এবং পানির নিচে নিজের শরীরটাই নিজের শত্রু। এভাবেই পানির নিচের কঠিন পরিবেশে টিকে থাকতে শেখে সিভিলিয়ান ডাইভার, ফায়ার সার্ভিস ডুবুরি, মিলিটারি ফ্রগম্যান বা নেভাল কমান্ডোরা।
যে কেউ হুট করে চাইলেই কিন্তু স্কুবা ডাইভিং করতে পারবে না। সিভিলিয়ানদের জন্য স্কুবা ডাইভিং একটি অ্যাডভেঞ্চার। এই অ্যাডভেঞ্চারের অংশ হতে হলে চাই প্রশিক্ষণ। আছে আরো কিছু শর্ত। আসুন জেনে নেয়া যাক কারা স্কুবায় অংশ নিতে পারবেন, কারা পারবেন না।
স্কুবা ডাইভিং করতে প্রথমত আপনাকে অবশ্যই সাঁতার জানতে হবে। পানির নিচে সাঁতার কাটা কিন্তু বেশ কঠিন। তাই শারীরিকভাবে সুস্থ-সবল হওয়াটা প্রথম শর্ত। দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আপনি যতই ভাল সাঁতারু হন না কেন, পানির নিচে বেশিক্ষণ ডুবে থাকা একটি ভিন্ন বিষয়, যা আপনাকে শিখতে হবে। সবশেষে, স্কুবা ট্যাংক ও রেস্পিরেটরি সিস্টেমের ব্যবহার শিখতে হবে। যন্ত্রটি কীভাবে কাজ করে, কীভাবে বন্ধ করা যায়, হঠাৎ বন্ধ হলে কী করতে হবে- এ সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা নিতে হবে।
বেশিরভাগ স্কুবা অ্যাডভেঞ্চার সাইটে আন্ডারওয়াটার রেডিও কমিউনিকেশন সিস্টেম নেই। তাই পানির নিচে যোগাযোগ রক্ষার জন্য ইশারার ভাষা জানতে হবে। শরীরে বড় কোনো অপারেশন হয়ে থাকলে বা ফুসফুসের রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক হয়ে থাকলে আপনি স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য আনফিট। এমনকি আপনার ঠান্ডাজনিত কোনো অসুস্থতা থাকলেও আপনার জন্য পানির নিচে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
এবার আপনাদের জানানো যাক সাবমেরিনে করে কত গভীরে যাওয়া সম্ভব। বিশ্বের সবচেয়ে গভীর খাদ হচ্ছে এই মারিয়ানা ট্রেঞ্চ যা ১০,৯৯৪ মিটার গভীর! এটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়াম থেকে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা গ্রান্ড ক্যানিয়নের গভীরতা থেকে প্রায় ১২০ গুণ বেশি। এছাড়া এভারেস্ট পর্বত শৃঙ্গের উচ্চতা থেকেও এর গভীরতা ১.৬ কিলোমিটার বেশি।মানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাহাড় মাউন্ট এভারেস্ট (৮,৮৪৮মিটার) কেটে এনে এখানে আস্ত বসিয়ে দিলেও এই খাদ পূরণ হবে না!
২০১২ সালে বিখ্যাত কানাডিয়ান চিত্রপরিচালক জেমস ক্যামেরন এককভাবে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতম খাদ ‘দ্য চ্যালেঞ্জার ডিপ’-এ দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি তার বিশেষভাবে তৈরি Deepsea Challenger নামের ১২ টনের সাবমার্সিবলে (সাবমার্সিবল মানে ধরে নিন সাবমেরিনের ছোট ভাই) করে ২ ঘন্টা ৩৭ মিনিট সময় নিয়ে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের ১০,৮৯৮ মিটার (৩৫,৭৫৬ ফুট) গভীরে পৌঁছান। তিনি হচ্ছেন তৃতীয় মানবসন্তান যিনি পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম জায়গায় গিয়েছেন। তিনি সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় কাটান, বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য নমুনা সংগ্রহ করেন, ছবি তোলেন-ভিডিও করেন। বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি নতুন প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীর সন্ধান পান ক্যামেরনের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে।
এর আগে Trieste নামের এক রিসার্চ সাবমেরিনের ১০,৯১১ মিটার নীচে যাওয়ার রেকর্ড আছে।২০ জানুয়ারি, ১৯৬০ সালে এটি মারিয়ানা ট্রেঞ্চে ডাইভ দেয়। এতে ছিলেন এর ডিজাইনার অগাস্ট পিকার্ডের ছেলে জ্যাক পিকার্ড এবং মার্কিন নেভির লেফটেন্যান্ট ডন ওয়ালশ। এটি মূলত Bathyscaphe টাইপের একটি সাবমার্সিবল, মানে ফ্রি ডাইভিং এবং সেলফ প্রোপেলার্ড ক্যাপসুল। তারা দুজন মাত্র ২০ মিনিট চ্যালেঞ্জার ডিপে অবস্থান করে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
অনেক গভীর হওয়ার কারণে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে সব সময় ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকে এবং এখানকার তাপমাত্রা হিমাঙ্কের মাত্র কয়েক ডিগ্রি ওপরে। এর তলদেশে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে পানির চাপ প্রায় আট টন, যা সমুদ্রের উপরিভাগের পানির স্বাভাবিক চাপের চেয়েও এক হাজার গুণ বেশি।
পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম অংশে যাওয়ার ব্যাপারে ক্যামেরনের রেকর্ডটি সম্প্রতি ভেঙেছেন মার্কিন নেভির সাবেক অফিসার, বর্তমানে ব্যবসায়ী ও সাগরতলের দুঃসাহসিক অভিযাত্রী ভিক্টর ভসকোভো।ডালাসের ধনী ব্যবসায়ী ভিক্টর ভসকোভোর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বিশ্বের প্রধান ৫ সাগরের সবচেয়ে গভীরতম অংশে যাওয়া এবং বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা। ফ্লোরিডাভিত্তিক ট্রাইটন সাবমেরিন ডিজাইনার এন্ড ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানির নির্মিত DSV Limiting Factor (Triton 36000/2 Hadal ) নামের একটি ডিপ সি ডাইভিং ভেহিকেল ব্যবহার করে গত ২৮ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত চারবার চেষ্টা চালিয়ে ৫৩ বছর বয়সী অভিযাত্রী ভিক্টর ভসকোভো সফল হন। চতুর্থ মানবসন্তান হিসেবে চ্যালেঞ্জার ডিপের গভীরতম অংশে ডাইভ দিলেও সবচেয়ে বেশি নিচে যাওয়া প্রথম মানুষ হিসেবে নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় লিখে ফেলেন। এসময় তিনি ১০,৯২৮ মিটার (৩৫,৮৫৩ ফুট) গভীরে যেতে সক্ষম হন, যা আগের তিনজনের থেকে বেশি। উল্লেখ্য, একদম শেষ দিকে ঘন নরম থকথকে কাদার স্তর থাকায় একদম সি ফ্লোরে ল্যান্ড করাটা বেশ অসুবিধাজনক। এসময় তিনি ৪ ঘন্টা সময় কাটান, ভিডিও করার একপর্যায়ে তিনি প্লাস্টিকের বর্জ্যও দেখতে পান! একবার চিন্তা করুন, সমুদ্রকে আমরা কী পরিমাণ দূষিত করলে পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম খাদে প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যায়!
অপ্রাসঙ্গিক হলেও মিলিটারি সাবমেরিন নিয়ে দু-চার লাইন বলতেই হচ্ছে। মিলিটারি সাবমেরিনের মধ্যে রাশিয়ার K728 Komsomolets-এর সর্বোচ্চ ১,০০০ মিটার নিচে যাওয়ার রেকর্ড আছে। এর ডিজাইন ডেপথ ১,২৫০ মিটার এবং ক্রাশ ডেপথ ১,৫০০মিটার (দেড় কিলোমিটার)। ১৯৮৯ সালে এটি এক দুর্ঘটনায় ডুবে যায়। এছাড়া রাশিয়ার আকুলা ক্লাসের সাবমেরিনগুলো সর্বোচ্চ ৬০০ মিটার নিচে যেতে পারে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গভীরে যাওয়ার ক্ষমতা আছে মার্কিন সি-উলফ ক্লাস নিউক্লিয়ার সাবমেরিনের (৭৫০ মিটার)। চিন্তা করুন, ৭৫০ মিটার কিন্তু কম কথা নয়। তবে এর টেস্ট ডাইভ ডেপথ হলো ৪৯০ মিটার। মানে এই গভীরতায় এটি স্বাভাবিক অবস্থায় চলতে সক্ষম। ক্রাশ ডেপথ ৭৫০ মিটার।
এবার আসা যাক কিছু সংজ্ঞায়। ডিজাইন ডেপথ মানে সাবমেরিনের ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে যে ডেপথের সীমা নির্ধারণ করা হয়। এটি হচ্ছে সেফ ডাইভ লিমিট। এই গভীরতায় সাবমেরিনের কোনো ক্ষতি হবার কথা না। অন্যদিকে টেস্ট ডেপথ হচ্ছে অপারেশন টাইমে যে সর্বোচ্চ গভীরতায় সাবমেরিন যেতে সক্ষম। এতে সাবমেরিনের বডির উপর হাজার হাজার লিটার পানির চাপ পড়ে, কিন্তু সাবমেরিন তা ঠিকই সহ্য করতে পারে। সাধারণত টেস্ট ট্রায়ালের সময় টেস্ট ডেপথের সর্বোচ্চ মান নির্ণয় করা হয়।
এবার আসা যাক ক্রাশ ডাইভের বেলায়। মনে করুন, টর্পেডোর তাড়া খেয়ে অথবা কোনো কারণে সাবমেরিনের সিস্টেম ফেইলিউর হয়ে টেস্ট ডেপথের চেয়েও অনেক বেশি নিচে ডাইভ দিল। অর্থাৎ ডেঞ্জার জোনে চলে গেছে। এমন অবস্থায় সাবমেরিনের মেটাল বডি যে সর্বোচ্চ গভীরে যেতে সক্ষম তা হলো ক্রাশ ডাইভ বা কলাপস ডাইভ। এর বেশি আর এক ইঞ্চিও যেতে পারবে না। গেলে প্রচন্ড পানির চাপে সাবমেরিন চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে!
তাহলে ১৯৬০ সালের Trieste সাবমেরিন (আসলে সাবমার্সিবল) যখন মারিয়ানা ট্রেঞ্চের একদম প্রায় শেষ প্রান্তে গিয়েছিল, তখন এটি কেমন পানির চাপ সহ্য করেছিল জানেন? আপনার হাতের এক আঙ্গুলের উপর যদি একটি ৮ টনি আফ্রিকান হাতি দাঁড়ায় তবে আপনি যে চাপ অনুভব করবেন, Triste-এর বডিকে তেমনই চাপ সহ্য করতে হয়েছিল। আর একে প্রচন্ড চাপ সহ্য করার মতোই বানানো হয়েছিল। জেমস ক্যামেরন বা ভিক্টর ভসকোভার মিনি সাবমেরিনগুলোর বডিও তেমন শক্তিশালী ছিল, প্রায় ১১ হাজার মিটার গভীরেও অনায়াসে যেতে পারত।