খুব বেশি দিন আগের কথা না। এই মাসের ৫ তারিখের সন্ধ্যাবেলার কথা। আমেরিকার ওয়েস্টপোর্ট শহরের এক বাড়িতে তখন বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ। গল্প, হাসি-ঠাট্টা, খাওয়াদাওয়ায় মেতে উঠেছিল সবাই। সেদিনের সেই পার্টিতে এসেছিল ৫০ জন অতিথি। পার্টি দিয়েছিলেন এক নারী, যার চল্লিশতম জন্মদিন পালন করতেই এসেছিল সবাই। নিশ্চিতভাবেই সেই নারী সবার কাছে বেশ প্রিয়পাত্র ছিলেন, তা নাহলে এক লোক সেই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই বা কেন ছুটে আসবেন?
খাওয়াদাওয়া, হৈ-হুল্লোড়, নাচ-গান শেষে সবাই যে যার মতো বাড়ির পথ ধরেন। সবাই তখন মনে এক আনন্দময় পার্টির স্মৃতি নিয়েই যাচ্ছিলেন। হায় আফসোস! যদি তারা জানতেন যে সাথে করে নভেল করোনাভাইরাস নামক এক মৃত্যুদূতকেও সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন তারা!
…
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যিনি এসেছিলেন পেশায় তিনি একজন ব্যবসায়ী, বয়স তেতাল্লিশের ঘরে। দুর্ভাগ্য তার। প্লেনে করে ফেরার সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। না, আসলে তিনি একা অসুস্থ হননি। অজ্ঞাতসারেই অসুস্থ হবার ব্যবস্থা করে দিলেন সেই প্লেনে থাকা যাত্রীদের, আরও ব্যাপক ও ভয়ঙ্করভাবে চিন্তা করলে, তার দেশবাসীর।
ঐ ভিনদেশীর কথা নাহয় বাদই দিলাম। যার জন্মদিন তার স্বদেশী অতিথিদের কথাই বা বাদ যাবে কেন? সেদিন বাড়িতে ফেরার পর তো তারা স্বাভাবিকভাবেই দৈনন্দিন কাজকর্ম করছিলেন; অফিসে যাচ্ছিলেন, বাজারঘাট করছিলেন, মেলামেশা হচ্ছিল লোকজনের সাথেও। তাদের ছেলে-মেয়েরাও স্কুল-কলেজে যাচ্ছিল, যাচ্ছিল খেলাধুলা আর অন্যান্য ইভেন্টগুলোতে।
অর্থাৎ… চেইন রিঅ্যাকশন ঠিকই শুরু হয়ে গিয়েছিল।
…
মাত্র তিন দিন পর, অর্থাৎ মার্চের ৮ তারিখে, সেই পার্টিরই এক অতিথি, নাম যার জুলি এন্ডিচ, জ্বর নিয়ে সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। জ্বরের মাত্রাও একেবারে ফেলনা না, ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট! সাথে মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার বুকের ওপর চেপে বসেছে- এতটাই ছিল সেই ব্যথা। শরীরের এমন অবস্থা দেখেই তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন, নির্ঘাত নভেল করোনাভাইরাসের কবলে পড়েছেন তিনি। তখনও অবশ্য তিনি পরীক্ষা করাননি। কারণ, পরীক্ষা করলে এর ফল পেতে আরও চার দিন অপেক্ষা করতে হতো তাকে।
…
আরও তিন দিন পর, অর্থাৎ ১১ মার্চ, নিজের অফিসেই বসে ছিলেন ওয়েস্টপোর্ট ওয়েস্টন হেলথ ডিস্ট্রিক্টের পরিচালক মার্ক এ. আর. কুপার। হুট করে বেজে উঠলো তার টেলিফোনটা। অপরপ্রান্তে তখন দক্ষিণ আফ্রিকার সেই ভদ্রলোক। ফোন দিয়েই তিনি জানালেন, তার শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। সেদিন পার্টিতে যাবার ব্যাপারেও তিনি জানাতে ভুললেন না।
এটুকু শুনেই তো কুপারের মাথা ঘুরিয়ে উঠেছে। সাথে সাথেই ন’জন সহকর্মীকে নিয়ে কী করা উচিত তার পরিকল্পনা করতে বসলেন তিনি। এরপর সেদিন জন্মদিনের পার্টি যার ছিল সেই নারীর সহায়তায় অতিথিদের সাথে যোগাযোগ হলো শুরু। একটু আগে যা বলেছিলাম, অর্থাৎ তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ও সন্তানদের স্কুলে যাওয়া-আসা, সবকিছুই শুনলেন সেই কর্মকর্তারা। এরপর আর একমুহুর্তও দেরি করলেন না তারা। ওয়েস্টপোর্টের স্কুল ও পাবলিক বিল্ডিংগুলোর অধিকাংশ সাথে সাথেই বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হলো।
৩৮ জন অতিথির পরীক্ষা শেষে অর্ধেকেরই বেশির দেহে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেল। একটু আগে যে জুলির কথা বলা হলো, তিনিও ছিলেন সেই করোনাভাইরাস পজিটিভদের দলেই।
…
সেদিনের সেই পার্টিতে যদি মাত্র ৫০ জন থাকত তাহলেও কথা ছিল। নাচ-গানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল আরও ১২০ জনকে! এখানেই শেষ না। সেই অতিথিদের একজন এই ক’দিনের মাঝে এমন আরেক আয়োজনে গিয়েছিলেন যেখানে উপস্থিত ছিল ৪২০ জন! এবার তো স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মাথা ঘুরে পড়ার দশা।
…
ওয়েস্টপোর্ট শহরটি আমেরিকার কানেক্টিকাট অঙ্গরাজ্যের ফেয়ারফিল্ড কাউন্টিতে অবস্থিত। যেদিন পার্টিটি হয়েছিল, সেদিন পর্যন্ত সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি কেউই। কিন্তু এই পার্টি হবার অল্প কিছুদিনের ভেতরেই ফেয়ারফিল্ডে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলো। ১৬ মার্চ গভর্নর ল্যামন্টের নির্দেশে পুরো অঙ্গরাজ্য জুড়েই সকল রেস্টুরেন্ট ও পাবলিং বিল্ডিং বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ততক্ষণে এই পার্টির খবর ছড়িয়ে গেছে পুরো শহরে, শুধু মানুষজন জানত না কার বাসায় হয়েছিল সেটা। রাজনৈতিক নেতাদের কাছে কল আসতে লাগলো বারবার, “কে দিয়েছে এই পার্টি?” “কারা গিয়েছিল সেখানে?” কেউ কেউ তো আবার ভয়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে সেই পার্টিতে যাবার ব্যাপারে মিথ্যাও বলতে লাগল। তারা এটা বলেছিল যেন এই মিথ্যা শুনে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য! না, তাদের পরীক্ষা যেমন করা হয়নি, তেমনই নিরাপত্তার বিষয় চিন্তা করে সেই পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট কারও নামই প্রকাশ করেনি কর্তৃপক্ষ।
তবে এতে করে লোকজনের অনুমানের বিষয়টা থেমে নেই। অতিথিদের মাঝে কেবলমাত্র দুজন নিজে থেকেই পরিচয় প্রকাশ করেছেন- জুলি এন্ডিচ এবং চেরিল চাটার। চাটার নিজে থেকেই তার ছেলের স্কুলে নিজের অসুস্থতার বিষয়টি জানান। তিন ঘণ্টার মাঝে স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ছেলেটি যে ইয়ুথ সকার লিগে খেলত সেখানে গিয়ে কিছুদিন আগেই অন্যদের সাথে খেলা উপভোগ করেছিলেন তার মা। কিন্তু এখন তার এমন অসুস্থতার খবরে নিরাপত্তার জন্য মৌসুমের বাকি দিনগুলোর জন্য সবই বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
তাদের দুজনের ব্যাপারে জানার পর প্রতিবেশীরা কিন্তু তাদের থেকে দূরে সরে যাননি, বরং এগিয়ে এসেছেন তাদের সাহায্যার্থে। কোয়ারেন্টিন চলাকালে এই মানুষগুলোই তাদের পরিবারের জন্য খাবার, পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিল, জানিয়েছিল সহানুভূতির উষ্ণ বার্তা।
…
সর্বশেষ পাওয়া খবরে ওয়েস্টপোর্টে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৮৫। সেদিনের সেই পার্টিতে কে যে আগে থেকেই ভাইরাসটি তার শরীরে বহন করছিল সেটা জানা না গেলেও অন্তত এটা জানা যায় যে, দক্ষিণ আফ্রিকার সেই ব্যবসায়ীই প্রথম নিজের দেহে ভাইরাসের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি এখন সুস্থও হয়ে উঠেছেন। যদিও অন্যদের ব্যাপারে তেমন কিছু একটা জানা যায়নি।
…
গতকাল রাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরে ট্রেন স্টেশনগুলোতে জনগণের উপচে পড়া ভিড়ের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। একবার ভাবুন তো, ওয়েস্টপোর্টে সেই ৫০ জনের এক পার্টি থেকে যদি এই দশা হয়, তাহলে গতকাল এই যে শত-সহস্র মানুষ বাড়ির পথ ধরল, সেখানে একজনও যদি ভাইরাসটির বাহক হয়ে থাকেন, তাহলে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হতে পারে!