![](https://assets.roar.media/assets/zurFlnh38EZhk0N0_7256957c7d8c464995c7e6bf08b4e1f3_18.jpg?w=1200)
করোনাভাইরাস মহামারির বদৌলতে চলমান বিশ্বের বহু স্বাভাবিক বিষয় স্তিমিত হয়ে গেছে। আলোচনার টেবিল কিংবা চায়ের আড্ডায় নিয়মিত ঝড় তুলত যেসব বিষয়, সেগুলোর বদলে নতুন অনেক বিষয় এখন মানুষের মুখে মুখে। আর সবকিছুর মতোই বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে এতটা আমূল বদলে যাবে, তা বোধহয় কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। রাজনীতির এক নব্য সংজ্ঞায়ন করে দিয়ে যাচ্ছে করোনাভাইরাস। একসময় মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ইরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই দোদুল্যমানতায়; আপদকালীন এই যাত্রায় ইরানের দীর্ঘকাল ধরে অর্জিত সুদৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থান কীভাবে হুমকির মুখে, তা নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইরানের গোর্গান শহরের একটি হাসপাতালে এক রোগীর আগমন ঘটে। কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগীর একটি সিটিস্ক্যান এবং বুকের বেশ কিছু এক্সরে করানোর পর অবাক হয়ে গেলেন। কেননা, এ ধরনের লক্ষণের সাথে চিকিৎসক পরিচিত ছিলেন না। কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের আগেই রোগীর অবস্থা ভাইরাসের আক্রমণে আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ে। চীনের উহান থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন পড়ে ঐ চিকিৎসক এ সিদ্ধান্তে আসেন যে, রোগীটি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। এরপর থেকেই শুরু হয় একদিকে ভাইরাসের প্রবল সংক্রমণ আর অন্যদিকে রাজনীতিবিদদের জঘন্যতম কূটচাল।
![](https://assets.roar.media/assets/Z55vl2O1geONuXr9_ababab.jpg)
ধীরে ধীরে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং পাল্লা দিয়ে মৃতের সংখ্যাও ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে, কিন্তু ইরানের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের আদেশ অনুযায়ী এসব আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তিদের খবর অজানা রয়ে যেতে থাকে। এমনকি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সকল ব্যক্তিদের উপর যেকোনো ধরনের সুরক্ষা সরঞ্জামাদি ব্যবহারের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, যাতে জনমনে ভীতি সঞ্চারের কোনো সুযোগ তৈরি না হয়। শেষপর্যন্ত করোনা মহামারির উৎসস্থল চীনের উহান শহরে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করলে সারা পৃথিবী জেনে যায়।
কিন্তু ইরানের গণমাধ্যম একেবারে নীরব থাকে রাষ্ট্রীয় বিধি-নিষেধের দরুন। সকল গণমাধ্যমের প্রধানদের পরামর্শ অনুযায়ী সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশ থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হন। এসবের পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা। জনমানুষকে অন্ধকারে রেখে দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যাতে তাদের কার্যকলাপ বহাল তবিয়তে চালিয়ে যেতে পারেন, সে লক্ষ্যেই ইরান করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কথা শুরুতেই স্বীকার করেনি।
সংসদ নির্বাচনের ঠিক দুদিন আগে ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে যে, করোনাভাইরাসের কারণে তাদের দুজন নাগরিক মারা গেছেন। সেই মুহূর্তে ইরানের গণমাধ্যমগুলোর অফিসে এক নীরব পরিহাসের হাসি হাসে সবাই। এমনও দেখতে হলো যে, কোনো রাষ্ট্র তার নিজ ভূখণ্ডে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কথা ঘোষণার পূর্বেই মৃত্যুর কথা স্বীকার করে- হাস্যকরই বটে! শীঘ্রই ইরান হয়ে উঠল করোনাভাইরাসের অন্যতম বৈশ্বিক হটস্পট। ফাঁস হওয়া তথ্যমতে, ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের নির্দেশ অমান্য করে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই সরাসরি গণমাধ্যমকে জানাতে পারত না।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখ অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ইরাজ তথ্য গোপনের সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং তাকে বেশ ক্লান্ত ও মলিন দেখায়। বারবার ঘাম মুছতেও দেখা যায় তাকে এবং পরের দিনই তার করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/5t5uMp2BWk1XDJlS_200525_r36504.jpg)
দেড় লাখেরও বেশি আক্রান্ত নিয়ে ইরান এখন বেশ ক্রান্তিকাল পার করছে। সম্প্রতি ইরানের বিজ্ঞান মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয় যে, কঠোর আইসোলেশন না মানলে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ করোনা আক্রান্ত হতে যাচ্ছে, যার মাঝে সম্ভাব্য মৃত্যুর সংখ্যা হবে ৩০,০০০। অন্যদিকে সঠিক সামাজিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টিন ইত্যাদি মেনে চললে মৃতের সংখ্যা প্রায় চারভাগ কমে আসতে পারে।
![](https://assets.roar.media/assets/WADrTmRS6s7dyliJ_03906439f8bb4b7facbb8b28225b78ca_18.jpg)
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ধর্ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চলমান মহামারিকে জ্বিনের প্রভাব বলে দাবি করেছেন দেশটির প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আয়াতোল্লাহ খামেনি। তেহরানের টিভি সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক গুল জাম্মাসের ভাষ্যমতে,
দেশের মানুষের অনেকেই মসজিদ বন্ধ করার বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না। যুক্তির নিরীখে তারা সতর্কতামূলক বিষয়গুলোকে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। মসজিদকে তারা বিবেচনা করেন যাবতীয় রোগ-শোকের বিরুদ্ধে আধ্যাত্মিক ও শারীরিক মুক্তি এবং সুরক্ষার উৎসস্থল হিসেবে এবং তারা কোনোভাবেই এসব ধর্মীয় উপাসনালয়কে রোগ ছড়ানোর জায়গা হিসেবে মানতে ইচ্ছুক নন।
ঠিক এ কারণেই ধর্মীয় উপাসনা কেন্দ্রগুলোতে গণজমায়েতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা একটি অত্যন্ত কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। তবে অধিকাংশ ইরানীই উগ্রপন্থী নন, যে কারণে বিজ্ঞান ও ধর্মের পারস্পরিক সহাবস্থানের ব্যপারে তারা খুব কঠোর অবস্থান নেননি। ইরান ভাইরাসকে একটি ঔপনিবেশিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার হাতিয়ার হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে, যাতে করে জনমনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিদ্বেষ প্রবলতর হয়।
অন্যদিকে জার্মান ইন্সটিটিউট অভ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স-এর ইরান বিশেষজ্ঞ আজাদেহ জামিরিরাদ বিষয়টিকে দেখছেন ভিন্নভাবে। তার মতে,
ইরানের শাসন ব্যবস্থার মূলনীতির সাথে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন- এ বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক। দেশের শাসন ব্যবস্থার চূড়ায় অবস্থানকারী ব্যক্তি আয়াতোল্লাহ আল খামেনির রাজনৈতিক ভাবমূর্তি অনেকাংশেই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে ধর্মীয় উপাসনালয়ে নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে। সরকার শুধু এসব স্থানে মানুষের জমায়েত বন্ধই করেনি, বরং প্রকাশ্যে অথবা সম্মিলিতভাবে ধর্মচর্চাকে নিরুৎসাহিত করেছে। গৃহীত এসব পদক্ষেপের স্বপক্ষে ইরানকে তার জনগণের কাছে খুব সুস্পষ্ট ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে হবে তাদের নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার নিমিত্তেই।
![](https://assets.roar.media/assets/WGe6mvHBwVIynLt3_52806228_401.jpg)
২০২০ সালের জানুয়ারির শুরুর দিকে দুর্ঘটনার দরুন একটি ইউক্রেনীয় যাত্রীবাহী প্লেন আঘাতের পর থেকে সারা বিশ্বেই ইরান রাজনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও যেকোনো ইস্যুতে ইরানের শ্লথ গতির যোগাযোগ পন্থা তাদেরকে আরও চাপের সম্মুখীন করে তুলছে। এসবের রেশ কাটতে না কাটতেই চলে এলো করোনা মহামারি, যা প্রকারান্তরে দেশটির ধর্মীয় অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে; যার প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে দেশটিতে সেক্যুলারিজমের উত্থান ঘটতে চলেছে।
থিওক্র্যাটিক শাসন ব্যবস্থার উর্বর ভূমি ইরানে রাজনীতি ও ধর্মকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। দীর্ঘকাল ধরে দেশটিতে বিরাজমান দিব্যতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রাণভোমরা ধর্মই; এ কথা বললে বোধ করি অত্যুক্তি করা হবে না। ইরানের শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের পৃথকীকরণ ইসলামি প্রজাতন্ত্রের মূলনীতির প্রতি একটি অত্যন্ত মৌলিক ও গুরুতর সাংঘর্ষিক পদক্ষেপ, যা কি না সেক্যুলারিজমের উত্থানকে প্রত্যক্ষভাবে মদদ দেয়।
আয়াতোল্লাহ আল খামেনির সামনে যখন প্রথমবারের মতো শাসন ব্যবস্থার শীর্ষে আসীন হওয়ার সুযোগ আসে, তখন তিনি আজকের মতো এতটা পরাক্রমশালী ছিলেন না। রাজনৈতিক বলয়ের বাইরেও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি একজন দুর্বল, ভীরু ব্যক্তিত্ব হিসেবেই সুপরিচিত ছিলেন। ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেই শুধু তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং তিনি যে একজন লম্বা দৌড়ের ঘোড়া- তা সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য পদবী, আত্মমর্যাদাবোধ সবকিছু খুইয়ে তিনি আইআরজিসি’র মুখাপেক্ষী হন। এ বাহিনীর সবচেয়ে নিচু পদের কমান্ডারদের এমনকি তাদের সন্তানদের নাম পর্যন্ত তিনি জানেন। মাইক্রোম্যানেজমেন্টের এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ বোধ করি আর হয় না। আইআরজিসিকে সুদক্ষ হাতে, অসাধারণ নৈপুণ্যের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিষিক্ত করার মাধ্যমে তিনি একে নিজের শাসন ব্যবস্থার মজবুত ভিত হিসেবে নিযুক্ত করেছেন এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের প্রসিদ্ধতম সিকিউরিটি ফোর্স হিসেবেও তারা কাজ করছে।
কাশেম সোলায়মানির মৃত্যুর পর বিপদ যেন ইরানের পিছু ছাড়ছে না। একের পর এক বৈরী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে ইরানের অবস্থা বর্তমানে অনেকটাই টলটলায়মান। ইরানের জনসাধারণ বর্তমান পরিস্থিতিকে দেখছেন একটি অন্ধ গলি হিসেবে; এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যার পুনর্গঠনের ন্যূনতম শক্তি তার নিজের নেই।